Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সংখ্যাগুরু না ক্ষমতাগুরু

সংখ্যালঘু এক গোষ্ঠী নিজেদের মত চাপিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতার জোরে

এই ‘সবাই’ ব্যাপারটা খুব খুব গোলমেলে। ‘ক’ বলছে যে, ‘খ’ বলেছে, এবং সে ‘গ’-এর কাছে শুনেছে। অসত্যকে সত্য, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য ধারণার বিপণন। নিজে পরখ করে দেখার, নিজে দেখে, নিজে পড়ে, নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে কোনও কিছু জানার সক্ষমতার বিপরীতে অবাস্তবকে সহজেই বাস্তব করে তোলার প্রচারকুশলতায় গড়ে ওঠে ক্ষমতার কাঠামো, তার এক ক্ষুদ্র অংশ হয়ে ওঠে সংখ্যাগুরু।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৯ ০০:১৭
Share: Save:

পান-বিড়ির দোকানের সামনে সাইকেলটা দাঁড় করাতে মানুষটিকে কিঞ্চিৎ কসরত করতে হল। সাইকেলের পিছনে বিরাট বোঝা, দোকানে দোকানে বিড়ি সাপ্লাই করা তাঁর পেশা। এ-জাতীয় বাণিজ্যের ধারাই এমন যে, কারবার ছাড়াও দুই ব্যাপারীর মধ্যে বন্ধু-সম্পর্ক ঘটে, কারবারের কথা ছাড়াও ভুঁই-বিভুঁইয়ের নানা কথা হয়। রোদ-বৃষ্টি-শীতের কথা, আলুর বাম্পার ফলনের কথা, পড়শির অ্যাক্সিডেন্ট কিংবা পাশের গাঁয়ের যুবতী বিধবার কলেজ ছাত্রের সঙ্গে পালানোর কথা। সে সব স্বাভাবিক সময়ের কথা, এখন দেশে চলকে পড়ছে বীররস— প্রধানমন্ত্রী ‘মরদ বটে! ছাড়ব্যেক নাই!’ পাকিস্তান দেশটাকেই নাকি মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হবে। “একটা দেশকে কেন উড়িয়ে দেওয়া হবে? ধরে নিলাম পাকিস্তানের সরকারই আসল দোষী। সরকারের দোষে সেখানকার মানুষগুলোকে উড়িয়ে দেবেন?” প্রশ্ন করেন এক ক্রেতা। বিড়ি-ব্যাপারী খানিক আমতা আমতা করে বলেন, “সবাই ব্যুলছে যে তবে?”

এই ‘সবাই’ ব্যাপারটা খুব খুব গোলমেলে। ‘ক’ বলছে যে, ‘খ’ বলেছে, এবং সে ‘গ’-এর কাছে শুনেছে। অসত্যকে সত্য, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলার জন্য ধারণার বিপণন। নিজে পরখ করে দেখার, নিজে দেখে, নিজে পড়ে, নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে কোনও কিছু জানার সক্ষমতার বিপরীতে অবাস্তবকে সহজেই বাস্তব করে তোলার প্রচারকুশলতায় গড়ে ওঠে ক্ষমতার কাঠামো, তার এক ক্ষুদ্র অংশ হয়ে ওঠে সংখ্যাগুরু। গত জুলাইয়ে কলকাতায় ‘ভারত কোন পথে’ নামে এক আলোচনাসভায় অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ব্যাপারটা ‘সংখ্যাগুরুর ‘গুরুত্বের’ ওপর নির্ভরশীল’, সংখ্যার ওপর নয়। যেমন, “২০১৪’র নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় ৫৫ শতাংশ আসন পেল, তারা ভোট পেয়েছিল মাত্র ৩১ শতাংশ।” সে বিচারে, বিজেপি ‘হিন্দুদের মধ্যেও সংখ্যালঘু, ভারতবর্ষের মধ্যেও সংখ্যালঘু’। তবু তার দাপটে, হাতে-ভাতে দু’রকম মারের চোটে, সত্যিকারের সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষ অস্থির। রাজনীতি, অর্থনীতি ও মতাদর্শের যৌগিক সমীকরণে সঞ্জাত ক্ষমতার জোরে সংখ্যালঘু এক গোষ্ঠী নিজেদের মত-পথ চাপিয়ে দিচ্ছে সংখ্যাগুরুর ওপর। ক্ষমতাগুরু হওয়ার সুবাদে হয়ে উঠছে সংখ্যাগুরুর স্বঘোষিত প্রতিনিধি।

আন্তর্জাতিক স্তরে, আমেরিকার শাসকরা ক্ষমতাগুরুত্বের জোরেই কার্যত বিশ্বশাসক। বিশ্বের মোট জনসংখ্যায় সে দেশের অংশ মাত্র শতকরা চার ভাগ। তার মধ্যে আবার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ ক্ষমতার অধিকারী— কোটি কোটি আমেরিকান দারিদ্র, গৃহহীনতা, কর্মহীনতার শিকার। অন্য দিকে বিশ্বের ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখতে নিরন্তর অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ— ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া। জো অ্যান্ড্রিয়াস-এর বহু লক্ষ কপি বিক্রি হওয়া সচিত্র অ্যাডিক্টেড টু ওয়র (দেবু দত্তগুপ্তের বাংলা তর্জমা, যুদ্ধজীবী) বইতে দেখা যাচ্ছে, কী ভাবে মার্কিন রাষ্ট্র ও পরদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সমার্থক— যুদ্ধই তার টিকে থাকার শর্ত। এবং, কী ভাবে তার “যুদ্ধবাজ নীতি সারা পৃথিবীর মানুষকে বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।… সন্ত্রাসবাদ ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদন কম হওয়া তো দূর, এই নীতি তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।” এই যুদ্ধনির্ভরতাকে যাথার্থ্য দিতে, বিশ্বে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্ব চাপিয়ে দিতে শুধু যুদ্ধ যথেষ্ট নয়— লোকে মন্দ বলে! অতএব মন্দকে মন্দ বলে চিহ্নিত করতে পারার ক্ষমতা কেড়ে নাও, লোকের মনোজগতে ঢুকিয়ে দাও: এটাই পথ, একমাত্র পথ। দখল করো সংস্কৃতির পরিসর— অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাস্য, অবাস্তবকে বাস্তবপ্রতিম করে তুলতে সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের জুড়ি নেই।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বই (সংখ্যাধিকের চলচ্চিত্র, অসহিষ্ণুতার খতিয়ান, শিলাদিত্য সেন, প্রতিক্ষণ) এ বিষয়ে খুব কাজের কথা বলে। রাষ্ট্রনীতি ও তার সাংস্কৃতিক বৈধতা নিয়ে চমৎকার স্পষ্টতায় বলছেন লেখক, “বিশ্বের মঙ্গল চেয়ে এই যুদ্ধ ঘোষণা… কী হলিউডের ফিল্মে, কী আমেরিকার রাজনীতিতে। পৃথিবীকে নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব করতে গেলে শত্রুকে শায়েস্তা করা দরকার, তাই আমেরিকার এত সমরসম্ভার, শান্তি বজায় রাখতেই শক্তি প্রদর্শন।” মার্কিন ক্ষমতা বেছে নিয়েছে হলিউডকে, তার চেয়ে ভাল প্রচারমাধ্যম আর কী হতে পারে? দৃশ্যকাহিনির মধ্য দিয়ে মিথ্যাকে সত্য, সত্যকে অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার নির্বিকল্প ক্ষমতায় হলিউড ‘ভিন্ন বর্ণ বা ধর্মের মানুষকে অনগ্রসর আখ্যা দিয়ে একটা একীভূত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা’ করে, যে ‘একীকরণের কাজই হল বহুস্বরকে বিনষ্ট করে দেওয়া’।

আমেরিকা বা হলিউডের দার্শনিক ভূগোল নির্দিষ্ট সীমায় আটকে থাকে না, বিস্তৃত হয়। আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্যে যেমন ঢুকে পড়ে ক্ষমতাগুরুর আধিপত্যকে বৈধতা দেওয়ার মতাদর্শ। সিনেমা তার উৎকৃষ্ট প্রয়োগক্ষেত্র। শিলাদিত্যের বিশ্লেষণ: এখানে সিনেমার এক প্রধান ধারাই হচ্ছে স্বদেশপ্রেমের মোড়কে পরদেশ— পাকিস্তানকে একমাত্র শত্রু ও তাবৎ সমস্যার মূল বলে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া, একই সঙ্গে তথাকথিত হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। এবং পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতার নাম করে ভারতমাতা, হিন্দু ও সশস্ত্র বাহিনীর অবিচ্ছেদ্যতা প্রতিষ্ঠিত করা। “রাষ্ট্র বা তার সরকারকেই যে সামাজিক নেতৃত্বের প্রধান উৎস হিসেবে মেনে নিতে হবে প্রতিটি ব্যক্তি বা পরিবারকে, সেই যুক্তির এক বাধ্যতা তৈরি হয়ে যায়। এই ছদ্মযুক্তিতে রাষ্ট্রই আমাদের কাছে দেশ ও জাতির প্রতিরূপ হয়ে ওঠে।... রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন দমন সবই শুরু হয়ে যায় সন্ত্রাসবাদ বা ‘সন্ত্রাসবাদের দীক্ষাগুরু’ প্রতিবেশী দেশটিকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার নামে।”

কাশ্মীর ও কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে বিভীষিকাময় আক্রমণ, গোরক্ষার নামে তাণ্ডব, রামমন্দির নিয়ে বিভীষিকা, নারী-দলিত-মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুধর্মের তথাকথিত রক্ষকদের পশ্চাদ্‌মুখী, পেশিসর্বস্ব আক্রমণ, এ-সব শুধু সঙ্ঘ পরিবার থেকেই আসে না, আমাদের তথাকথিত মূলধারাও বিপুল ‘অবদান’ রেখে চলে। এই মূলধারা সংখ্যালঘু কিন্তু ক্ষমতাবান— ব্যাপক জনসাধারণের অতি ক্ষুদ্র কিন্তু প্রবল আধিপত্যকারী ও আরও আধিপত্যকামী এক অংশ সমাজ-সংস্কৃতি-বিনোদনের নিয়ামক হয়ে উঠেছে। সংখ্যাকে প্রভাবিত করে গলার জোর, গলার জোর আসে সামাজিক বিন্যাসে সুযোগের বৈষম্য থেকে। শিক্ষার সুযোগ, বেঁচে থাকার সুযোগ, বিশ্ব-পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ, নিজেকে আমিও-কেউ-বটে বলে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ— সর্ব বিষয়ে ঘোর বৈষম্য। বিশ্ব জুড়ে মার্কিন দখলদারি, বা ভারতে তথাকথিত হিন্দুদের দখলদারি প্রতিভাত হয়, আবার রসদও সংগ্রহ করে, সংস্কৃতির অঙ্গনে। এটা কাকতালীয় নয়, নিছক বিনোদনের ব্যাপার নয়, সংখ্যালঘুকে সংখ্যাগুরু হিসেবে দেখানোর, সমাজে আধিপত্য কায়েম রাখার গভীর, বিস্তৃত পরিকল্পনা।

পানের দোকানের ক্রেতা বিড়ি-ব্যাপারীকে প্রশ্ন করলেন, “ধরুন, পাকিস্তানকে উড়িয়ে দেওয়া হল। তাতে কি আপনার জীবনে কোনও বদল ঘটবে? সাইকেল টেনে বিড়ি বিক্রির জায়গায় একটু কম পরিশ্রমের কাজের সুযোগ পাবেন?” “তা-ই আবার হয়? আমরা কি সেই কপাল করে জন্ম্যাইছি?”

অথচ, কপালের দোষগুণে বিশ্বাসী মানুষ কখনও কখনও শ্রমসিক্ত চৈতন্যে জেগে ওঠে। ইতিহাসে সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষের মনোজগৎকে আচ্ছন্ন রাখা, তাকে অনুগত করে রাখা, তার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশকে রুদ্ধ করে রাখার পরিকল্পনা রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু তার সঙ্গেই আছে ইতিহাসের নানা অবিস্মরণীয় ক্ষণ, যেখানে সংখ্যালঘুর ক্ষমতাগুরুত্বকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে সংখ্যাগুরু— যথার্থ সংখ্যাগুরু— মানুষের সামূহিক চৈতন্য। ভারতের বহুস্বর, বহুচিন্তার বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের দাবিদার সংখ্যালঘু একাংশের জবরদস্তি যেমন বাস্তব, কৃষকের মিছিল, শ্রমিকের আন্দোলন, দলিতদের প্রতিবাদী সংহতির নির্মাণও ততটাই দৃশ্যমান। আসল কথা সামূহিক চৈতন্য— আলাদা আলাদা ব্যক্তি-গোষ্ঠী-সমাজ তার ভিন্নতা নিয়েই এক তাৎক্ষণিক অভিন্ন চৈতন্য গড়ে তোলে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থনীতিক-রাজনীতিক যাবতীয় ক্ষমতাগুরুত্বের বিপরীতে এই সামূহিকতাই, অবশেষে, পথ ও পাথেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE