Advertisement
E-Paper

জেএনইউ: একটি পরিকল্পিত আক্রমণ

যে ভারতবর্ষ সমস্ত জাতি, ধর্ম, ভাষা, জনগোষ্ঠী ইত্যাদিকে জায়গা করে দেয়, ফ্যাসিস্টরা সেই ভারতবর্ষের গোড়ায় আঘাত হানতে চায়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু দর্শনের শুরুতে অনেকেই হয়তো ঠাহর করতে পারিনি ঠিক কী আকার নেবে এই ঘটনা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বাদেই পরিষ্কার হয়ে যায়, পড়ুয়াদের নিয়ে মামুলি কিছু বাদানুবাদের ঘটনা এটা নয়, একটা বিরাট পরিকল্পনা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। জানা দরকার কী এবং কেন সেই পরিকল্পনা।

সায়নদেব চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০১
প্রত্যয়। কানহাইয়া কুমারের গ্রেফতারির প্রতিবাদে। জেএনইউ, দিল্লি। ১৪ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

প্রত্যয়। কানহাইয়া কুমারের গ্রেফতারির প্রতিবাদে। জেএনইউ, দিল্লি। ১৪ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু দর্শনের শুরুতে অনেকেই হয়তো ঠাহর করতে পারিনি ঠিক কী আকার নেবে এই ঘটনা। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বাদেই পরিষ্কার হয়ে যায়, পড়ুয়াদের নিয়ে মামুলি কিছু বাদানুবাদের ঘটনা এটা নয়, একটা বিরাট পরিকল্পনা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। জানা দরকার কী এবং কেন সেই পরিকল্পনা। দু’দিন আগেই এই পাতাতেই (‘লেঠেল দিয়ে...’, ১৬-২) ‘সিডিশন’ নিয়ে অত্যন্ত জোরালো ভাবে বোঝানো হয়েছে, কোথায় দক্ষিণপন্থীদের চিন্তায় দৈন্য, কেন বারে বারে সেই দৈন্য এতটা ঝাঁঝালো আকার ধারণ করে। তাই ওই প্রসঙ্গ আবার আওড়ানোর দরকার নেই। বরং যে পরিকল্পনার কথা বললাম, সেই সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার।

জেএনইউ ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ তো বটেই, বেশ কিছু বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি হবে না। সারা পৃথিবী জুড়ে তার সুনাম। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স চল্লিশ বছরের বেশি, প্রায় শুরু থেকেই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার একটি পীঠস্থান বলে পরিচিত। সারা পৃথিবীতে অগণিত ছাত্রছাত্রী এবং মাস্টারমশাই জেএনইউ-এর কাছে ঋণী। স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ বহু পণ্ডিতের কর্মক্ষেত্র এটি। শুরু থেকেই জেএনইউ বামপন্থী ভাবাদর্শের অনুরাগী, কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময়ে তার একাধিক কাজ ও চিন্তার অংশীদার হিসেবে অকপটে বলতে পারি, এ কথা একেবারেই ঠিক নয় যে, জেএনইউ’তে ঘাড় ধরে এই ভাবাদর্শ শেখানো হয়ে থাকে। বরং স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মতামত— যা কিনা যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েরই পাথেয়— সেটাই মূলধন হিসেবে তৈরি করতে শেখায় এই প্রতিষ্ঠান। বহু আমলাও তাঁদের প্রাথমিক পাঠ নেন এখানে। এনজিও ও মিডিয়াতেও যান অনেক পড়ুয়া। কাজেই জেএনইউ মানেই কিছু ঝানু বামপন্থী ছেলেমেয়ে দেশ বা দশের টাকায় স্লোগান দিয়ে বেড়ায়— এই ধারণা শুধু অত্যন্ত স্থূল এবং কুরুচিকর নয়, সম্পূর্ণ ভুল।

দীর্ঘকাল ধরে জেএনইউ একটা উন্নত মানের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। এক কথায় এটি এক বহুমাত্রিক, বহুকৌণিক ‘রিপাবলিক’। খুব সাধারণ পরিবার থেকে এসে জেএনইউ’তে পড়াশোনা করা যায়, ভাল ফল করা যায়, ছাত্র রাজনীতি করা যায়, সেখানকার প্রেসিডেন্টও হওয়া যায়। যেমন হয়েছেন বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের কানহাইয়া কুমার বা কাশ্মীরের শেইলা রশিদ। এই ‘মবিলিটি’, সামাজিক উত্থান, মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখানোটা জেএনইউ-এর নিজস্ব। অম্বেডকর বা রবীন্দ্রনাথ যে ভারতের কথা ভাবতে চেয়েছিলেন, এখানে সেটাই কিছুটা সম্ভব হয়েছে। ভারতীয় হওয়ার যে গুটিকয় গর্ব থাকতে পারে, জেএনইউ-এর মতো প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে একটি। অ্যান্টি-ন্যাশনাল কথাটা যদি কারও ক্ষেত্রে খাটে, তবে জেএনইউ’কে যারা ধ্বংস করতে চায় তাদের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য। সেখানেই প্রশ্ন, কে বা কারা এবং কেন জেএনইউ’কে ধ্বংস করতে চায়।

যে ভারতবর্ষ সমস্ত জাতি, ধর্ম, ভাষা, জনগোষ্ঠীকে জায়গা করে দেয়, ফ্যাসিস্টরা তার গোড়ায় আঘাত হানতে চায়। সেই আঘাত হানার পক্ষে দারুণ জায়গা জেএনইউ। জেএনইউ স্বাবলম্বী, গবেষণায় ব্রতী, রাজনীতির দুরূহ তত্ত্বে দক্ষ, কিন্তু জেএনইউ তো গুন্ডামিতে পঠনপাঠন দেয় না, পুলিশ লেলিয়ে দিলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, ত্রিশূলধারী গেরুয়াদের নোংরা গালিসর্বস্ব আঘাতে হতচকিত। অর্থাৎ তাকে কোণঠাসা করা সহজ। এবং তাকে আঘাত করতে পারলে ভারতবর্ষ নামক কাঙ্ক্ষিত দেশটার মূলে আঘাত করা যায়। এফটিআইআই বা পুণে বা হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কিছুমাত্র খাটো না করেও বলা যায় যে, এই সব প্রতিষ্ঠানে নিজমূর্তি জাহির করা হয়ে গেলেও যতক্ষণ না জেএনইউ’তে ক্ষত তৈরি করা যাচ্ছে, হানাদারদের শান্তিনিদ্রা নেই।

এ পরিকল্পনা আজকের নয়। জরুরি অবস্থার সময়, পরে ১৯৮৩ সালে এবং ১৯৯৯-২০০০ সালেও জেএনইউ’কে লক্ষ্য করেছে রাষ্ট্র। এবং প্রতি বারই পিছু হঠতে হয়েছে তাকে। এ বারে তাই ভাবনাচিন্তা করেই নেমেছেন ওঁরা। নয়া উপাচার্য এসেছেন দু’সপ্তাহ হয়েছে কি না সন্দেহ। তার পরেই একটা ‘ঘটনা’, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হাতে ক্যাম্পাস তুলে দেওয়া। সঙ্গে রইল কিছু টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারকবাহিনী। আর মন্ত্রীসান্ত্রিরা তো আছেনই। ব্যস, কাজ হাসিল। জেএনইউ’তে আছড়ে পড়ল ‘দেশদ্রোহ’ নামক বিচিত্র এক ঔপনিবেশিক দোষ এবং রোষ।

আর একটা কাজও হল এতে। রোহিত ভেমুলার মর্মান্তিক মৃত্যুতে প্রায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বিজেপির কিছুটা রেহাই মিলল। রেহাই মিলল মূল্যবৃদ্ধি, ওষুধের দামের ওপর চড়া শুল্ক, পড়ুয়াদের ভাতা বন্ধ করা, পঠানকোট, সেনসেক্স এবং আরও নানা সমস্যা থেকে। বাজেট অধিবেশনের আগে দেশকে একটু অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখার রসদ দেওয়া গেল।

এ সবের পরেও রয়েছে আর একটা বিরাট ষড়যন্ত্র। সেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত। এই ধরনের নির্লজ্জ এবং রাষ্ট্রীয় আঘাতের একটা লক্ষ্য আস্তে আস্তে দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে হত্যা করা। দুই বা তিন দশক আগে এই আঘাত নেমে এসেছিল সরকারি হাসপাতালগুলোতে। ক্রমশ দেখা গেল, সাধারণ মধ্যবিত্ত ভারতবাসী সরকারি হাসপাতাল থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, নিতে বাধ্য হয়েছেন। গবেষণার যন্ত্রপাতি, উপযুক্ত ডাক্তার বা অন্যান্য সুযোগসুবিধে এবং প্রায় নিখরচায় চিকিত্সার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি বা আপনি আর ওই পাড়া মাড়াই না। ঘটিবাটি বেচেও আজ মধ্যবিত্ত মানুষ বেসরকারি চিকিত্সায় নিয়োজিতপ্রাণ। সরকারি হাসপাতাল খুন হয়েছে আমার আপনার সামনে। এখন যেমন তিলে তিলে নষ্ট করা হচ্ছে সরকারি স্কুল। যত বেশি মাইনে তত ভাল স্কুল, এমন একটা ভাবনা ভাবতে শেখানো হচ্ছে আমাদের। চোখ-ধাঁধানো এক একটা স্কুল বাড়ির নকশা তৈরি করছে একটা অতিরঞ্জিত, অসম্ভবের হাতছানি। এর পরের পালা পাবলিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর। জেএনইউ’কে উদেশ্য করে এই আঘাত হানার কারণ এখানেই। সেই কারণেই অস্ত্রাগারে যা যা মজুত আছে প্রায় সব ক’টাই ছোড়া হয়েছে, হয়ে চলেছে জেএনইউ’কে লক্ষ করে।

তবে, অন্যান্য বারের মতোই, ব্যর্থ হবে এই প্রয়াস। জেএনইউ আরও শক্তিশালী হবেই। এবং ‘অচ্ছে দিন’-এর মায়াজালে যাঁরা চোখে আবছা দেখছিলেন, তাঁরাও আশা করি অনেকেই কিছুটা দৃষ্টি ফিরে পাবেন।

লেখক দিল্লির অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy