Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
স্বাধীনতার পর প্রথম পূর্ণকুম্ভ ছিল নেহরুর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ

নেহরু চেপে যাবেন কেন

দেশজোড়া উত্তাল, সরকারবিরোধী আবহেই সে দিনের অধিবেশন শুরু। প্রথমেই মৃতদের প্রতি শোক জানিয়ে উদ্বোধনী বক্তৃতা দিতে উঠলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ। বিরোধী হিন্দু মহাসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি একযোগে বেরিয়ে গেল। এই বক্তৃতা আজ তারা বয়কট করছে।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

লোকসভা, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪। অধিবেশনের শুরু থেকেই সে দিন তুমুল হট্টগোল। কয়েক দিন আগে, ৩ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতার পর প্রয়াগের প্রথম পূর্ণকুম্ভে মৌনী অমাবস্যার শাহি স্নানে ভিড়ের চাপে অনেকে মারা গিয়েছেন। ঠিক ক’জন, তার হিসেব নেই। তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের হিসেব, সব মিলিয়ে ৩১৬ জন। মৃতদের মধ্যে ২৫৩ জন মহিলা, ৪৯ জন পুরুষ ও ১৪ জন শিশু। কিন্তু জনতা এই সরকারি হিসেব মানতে নারাজ। তারা বলছে, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। অন্তত আটশো থেকে হাজার। কয়েকশো লাশ নাকি গোপনে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দেশজোড়া উত্তাল, সরকারবিরোধী আবহেই সে দিনের অধিবেশন শুরু। প্রথমেই মৃতদের প্রতি শোক জানিয়ে উদ্বোধনী বক্তৃতা দিতে উঠলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ। বিরোধী হিন্দু মহাসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি একযোগে বেরিয়ে গেল। এই বক্তৃতা আজ তারা বয়কট করছে।

অতঃপর সভা শুরু। আজই হবে কুম্ভ দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা। কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি একজোট। অন্য কিছু নয়, আজ শুধু কুম্ভ-দুর্ঘটনা এবং সরকারের অপদার্থতা নিয়েই আলোচনা করতে হবে। স্পিকার গণেশ বাসুদেব মভলঙ্কর জানালেন, মেলা উত্তরপ্রদেশ সরকারের দায়িত্বে ছিল। ফলে সব প্রস্তাব মুলতুবি রেখে শুধু কুম্ভ-দুর্ঘটনা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে না। ফের জনসঙ্ঘ এবং কমিউনিস্ট পার্টি একযোগে ‘ওয়াক আউট’ করে বেরিয়ে গেল। সরকারের বিরোধিতা করার জন্য বিরোধী বেঞ্চে বসে রইলেন শুধু প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টির আচার্য জে বি কৃপালনী।

আচার্য সে দিন বক্তৃতায় আগুন ঝরালেন। বললেন, বিশেষ ট্রেনের বন্দোবস্ত থেকে রেডিয়োতে পূর্ণকুম্ভ নিয়ে প্রচার, সরকার কিছুই বাকি রাখেনি। মনে করালেন, মহাত্মা গাঁধীও ১৯১৫ সালে পূর্ণকুম্ভে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি সমাজসেবার জন্য। সাধুদের শাহি স্নানে ধুয়ো দিতে নয়। ‘‘জওহরলালের নেতৃত্বে এই সরকার কুম্ভমেলা থেকে রাজনৈতিক পুঁজি জোগাড় করতে চায়। দেশকে ফের মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওযাই ওঁর লক্ষ্য’’, বললেন তিনি। স্পিকার উঠে বাধা দিলেন, ‘‘কৃপালনীজি, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এই ভাবে সভায় বলা যায় না।’’ দেখা গেল, নেহরু নিজে স্পিকারকে অনুরোধ করছেন, ‘‘ওঁকে বলতে দিন।’’ সংসদের সে সময়কার বিবরণীতে ঘটনাটি আছে, উপরন্তু পর দিন খবরের কাগজ হেডিং করেছিল, ‘নেহরু’জ় স্টাউট ডিফেন্স অব কৃপালনী’। কৃপালনীকে নেহরুর নির্ভীক সমর্থন।

এতগুলি নথি, তবু মে দিবসে উত্তরপ্রদেশের জনসভায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জানালেন, নিজের সরকার বাঁচাতে নেহরু সেই দুর্ঘটনার খবর চেপে গিয়েছিলেন। এবং একা রামে রক্ষা হয়নি, সুগ্রীবও দোসর ছিল— তৎকালীন সংবাদমাধ্যম নাকি নেহরু সরকারের পাশে দাঁড়াতে খবর গোপন করেছিল।

নেহরু অবশ্য সত্যিই একটি ব্যাপার চেপে গিয়েছিলেন! ব্রিটিশ আমলে কুম্ভমেলায় জনস্বাস্থ্য ছিল প্রধান সমস্যা। হেন কোনও কুম্ভ ছিল না, যেখানে কেউ-না-কেউ কলেরায় আক্রান্ত হননি। ইতিহাস দরকার নেই, কালকূটের ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরাই জানেন, সেই উপন্যাসে দিদিমা এবং শ্যামারা ‘ডাগদরবাবু’র সুই নিতে কী ভাবে ভয় পাচ্ছিলেন! বাস্তব, সেই ’৫৪ সালেই সরকার জানিয়েছিল, প্রয়াগে সবাইকে কলেরার ইঞ্জেকশন নিয়ে ঢুকতে হবে। ফল হয়েছিল চমৎকার। সে বার তীর্থযাত্রী বা সাধুরা কেউ কলেরা-আক্রান্ত হননি। এ বারে অর্ধকুম্ভে নরেন্দ্র মোদী ও যোগী আদিত্যনাথের হাসিমুখ দিয়ে ‘স্বচ্ছ কুম্ভ’, ‘দিব্য কুম্ভ, ভব্য কুম্ভ’ ইত্যাদি হরেক পোস্টার দেখেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরু নিঃশব্দে সেই কাজ করেছিলেন। পোস্টারে হাসিমুখ দেখিয়ে ‘কলেরামুক্ত কুম্ভ’ গোছের স্লোগান তোলেননি, কাউকে তুলতেও দেননি।

প্রথম প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আরও গুরুতর অভিযোগ, ‘‘পদপিষ্ট হয়ে মৃতদের নাম জানানো হয়নি, তাঁদের কানাকড়ি ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি।’’ সত্যিই দেওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণের রাজনীতি তখন লক্ষ্য ছিল না।

বস্তুত, ১৯৫৪ সালে কুম্ভ-দুর্ঘটনার পর কমলাকান্ত বর্মার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির বিচার্য বিষয় ছিল দু’টি: ১) কোন পরিস্থিতিতে ট্র্যাজেডি ঘটল, তা খতিয়ে দেখা; ২) যাতে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনা না ঘটে, তার দিক নির্দেশ। প্রয়াগে তখন লোকমুখে ছড়াচ্ছিল, মা গঙ্গার অভিশাপেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেনারা গঙ্গার ওপর অস্থায়ী সেতু তৈরি করার সময় খাওয়াদাওয়া করছিলেন, সেই পাপেই এতগুলি জীবন গেল! কেউ বলছেন, স্বাধীন ভারতে ভিআইপি নামে একটা নতুন সংস্কৃতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সবাই কুম্ভে আসেন, পুলিশ তাঁদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কারও বক্তব্য, গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ সে দিন লাঠি চালিয়েছিল। সেখান থেকে বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি। কেউ বলছেন, ও সব নয়। আখড়ার নাগা সাধুরা ত্রিশূল দিয়ে লোককে আক্রমণ করেছিলেন। কারও আবার বক্তব্য, আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ভিড়ের চাপে সঙ্গমের রাস্তায় অনেকে পিছলে পড়েছিলেন, টাল সামলাতে না পেরে একে একে পিছনের লোকেরাও।

নেহরুরা জানতেন, গুজবের এই জনসংস্কৃতিতে তদন্তের বিচার্য বিষয়টাই আগে স্থির হওয়া উচিত।

৩ ফেব্রুয়ারি, সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে সেই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার একটি নয়, অনেক কারণ ছিল। বৃষ্টি, অপ্রশস্ত রাস্তা। আখড়ার সাধু এবং জনতা একই রাস্তায় সঙ্গম থেকে ফিরছিলেন। তখনই আর একটি আখড়া সেই একই রাস্তা বেয়ে সঙ্গমের দিকে এগোচ্ছিল। চলমান জনতা ভয়ে, ভক্তিতে থমকে গিয়েছিলেন। ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।

ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা ঠেকাতে বর্মা কমিটি ২২টি সুপারিশ করেছিল। বলা হয়েছিল, পুরো মেলাকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করতে হবে। প্রতিটি সেক্টরে থাকবে পর্যাপ্ত পুলিশ, প্রশাসন, চিকিৎসক। শাহি স্নানের দিন ভিড় সঙ্গমের দিকে এক রাস্তায় যাবে, অন্য রাস্তাগুলি বেয়ে ফিরবে। দরকারে চলমান ভিড়কে এ দিক-ও দিক ছড়িয়ে দিতে হবে, কিন্তু কোথাও যেন সেটি অহেতুক থমকে না যায়।

সেই ট্র্যাডিশন এখনও! ২০১৩ সালের প্রয়াগ পূর্ণকুম্ভে দেখেছিলাম ১৪টি সেক্টর, এ বার মোদী-যোগীর অর্ধকুম্ভে ২০টি। মৌনী অমাবস্যায় দেখলাম, কোটি মানুষের ভিড়ও থমকাচ্ছে না, সঙ্গমে তারা এক রাস্তায় যাচ্ছে, অন্য রাস্তা বেয়ে ফিরছে। ভাগ্যিস নেহরুরা সে দিন তদন্ত কমিটির বিচার্য বিষয়গুলি ঠিক করে দিয়েছিলেন! মোদী-যোগীদের আজকের কুম্ভসাফল্য ৫৫ বছর আগের সুপারিশগুলির ওপরেই দাঁড়িয়ে।

আখড়া সংক্রান্ত লোকগাথাগুলি সে দিন কমিটির সামনে প্রমাণ করা যায়নি। অতএব, ২২টি সুপারিশের মধ্যে মাত্র দু’টি আখড়াগুলিকে নিয়ে। প্রথমত, শাহি স্নানের দিন আখড়ার জুলুস বা মিছিলের রাস্তা আলাদা থাকবে। সাধারণ পুণ্যার্থীরা যেন ওই রাস্তায় না যান। দ্বিতীয়ত, শাহি স্নানে একটি আখড়া চলে যাওয়ার পর বেশ কিছু সময়ের ব্যবধান রেখে যেন অন্যটি আসে।

এই ২০১৯-এও কাজ হল সেই কাঠামো মেনে। মৌনী অমাবস্যার দিন সঙ্গমের ওয়াচ টাওয়ার থেকে অজস্র আলো, রাস্তায় বাঁশের ব্যারিকেড। আখড়ার জুলুস যাবে ব্যারিকেডের ও-পাশ দিয়ে, যাত্রীরা এ-দিক দিয়ে। জানানো হল, প্রথম স্নানে আসবে মহানির্বাণী আখড়া। তারা চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পরে জুনা।

সংসদে কৃপালনীর সে দিনের অভিযোগে ফিরে আসি। কুম্ভমেলায় কেন বিশেষ ট্রেন চালিয়ে ভিড় বাড়ানো হল, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। আচার্যের স্মরণে ছিল না, তার আগে ১৯৪২ সালে প্রয়াগের পূর্ণকুম্ভ বিশেষ জমেনি। যুদ্ধের বাজার, জাপান বারাণসী ও প্রয়াগে বোমা ফেলবে বলে গুজব ছিল।

ফলে স্বাধীনতার পরে প্রথম পূর্ণকুম্ভ নেহরুর কাছে প্রায় একটা চ্যালেঞ্জ ছিল! দেশপ্রেম বুকের ভিতরে থাকে, জামায় লটকে রাখা নিরর্থক।

এ বারের অর্ধকুম্ভেও ছিল ৮০০ বিশেষ ট্রেন। ভিড় সামলাতে ইলাহাবাদ ছাড়াও সঙ্গম, নৈনি, ছিউকি ইত্যাদি হরেক স্টেশন দিয়ে ছিল যাতায়াতের বন্দোবস্ত। আমি নিজেই কলকাতা থেকে ছিউকি স্টেশনে নেমেছিলাম, মনে আছে।

মোদী-যোগীরা কার ফসল কেটে নিজেদের গোলায় ভরছেন আর বড় বড় কথা বলছেন, নিশ্চয় এত ক্ষণে পরিষ্কার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jawaharlal Nehru Kumbh Mela
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE