মাত্র তিন দিন আগেই পশ্চিম বিশ্বের ‘মিত্র’ দেশগুলির সহিত সম্পর্ক চুকাইবার হুমকি দিতে দেখা গিয়াছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। তাহার পর পরই বিশ্বদুনিয়া দেখিল, তিনি পূর্ব বিশ্বের ‘শত্রু’ দেশটির প্রধানের সহিত করমর্দন করিয়া বন্ধুত্ব ঘোষণা করিতেছেন। উত্তর কোরিয়ার একনায়ক নেতা কিম জং উনকে নিরন্তর চাপে রাখিয়া চলিবার শপথ ট্রাম্প ইতিমধ্যে বহু বার উচ্চারণ করিয়াছেন। কার্যকালে দেখা গেল, মার্কিন পক্ষের নির্ধারিত ও সঙ্গত দাবিগুলি পর্যন্ত বৈঠকে উঠিতেছে না, বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্রের ‘সম্পূর্ণ এবং প্রমাণসাপেক্ষ অপরিবর্তনীয় বিলোপ’-এর (সিভিআইডি) শর্তটিই চুক্তিপত্রে নাই। কিম জং উন বৈঠকে বসিয়া দরাজ ভাবে পরমাণু-অস্ত্র সংবরণের কথা বলিলেন, কিন্তু অতি সতর্ক ভাবে এড়াইয়া গেলেন কী ভাবে কবে সেই সংবরণ সাধিত হইবে তাহার গুরুত্বপূর্ণ বিবরণী। ট্রাম্প এবং কিম, দুই জনেই বিশ্ব-দরবারে নিজেদের একনায়ক হিসাবে প্রমাণ করিয়া ফেলিয়াছেন, দেশের স্বার্থচর্চার উপরে ক্ষমতার চর্চাকে বেশি গুরুত্ব দিয়াছেন, কূটনীতিকে জরুরি বলিয়া মনে করেন নাই। দুই নেতার কেহই শান্তির লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ নহেন। স্বদেশি রাজনীতিতেও কেহই ক্ষুদ্র স্বার্থের উপরে উঠিয়া বৃহৎ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দানের দৃষ্টান্ত দেখান নাই। দুই জনই নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিতে যথেষ্ট পারঙ্গম। এই সব কারণেই, পঞ্চাশ বৎসরের বেশি ধরিয়া যে দুইটি দেশের মধ্যে জলচল বন্ধ তাহাদের নেতারা সূর্য-চন্দ্রের মতো এক মঞ্চাকাশে উপস্থিত হইলেন, দুইটি পতাকা এই প্রথম পাশাপাশি উড়িল, কিন্তু তবু ভরিল না চিত্ত। সিঙ্গাপুরে মঙ্গলবারের বৈঠকটি বহুবিজ্ঞাপিত, বহু-উদ্যাপিত, ঐতিহাসিক এবং ভুবনমোহন হইলেও তাহার ফলে বিশ্বশান্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনাটি কিন্তু মোটেই আশানুরূপ ভাবে জাগিল না।
নিরাপত্তার কথাই যদি উঠে, দেখা যাইবে প্রাথমিক সদর্থক বাক্যগুলির মধ্যেই প্রভূত অস্পষ্টতা। যেমন, কোরীয় উপদ্বীপে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ নির্মাণের লক্ষ্যে দুইটি দেশ নাকি একমত, কিন্তু উত্তর কোরিয়ার যে পরমাণু অস্ত্র কার্যক্রম তাহার প্রধান বাধা, তাহা সরাইবার লক্ষ্যে পিয়ংইয়্যাং ‘অগ্রসর হইবে’, এইটুকুর বেশি কিছুমাত্র জানাও গেল না, কোনও প্রশ্নও উঠিল না। বস্তুত মার্কিন কূটনৈতিক উপদেষ্টারা তাঁহাদের প্রেসিডেন্টের কাজে আপাতত বিস্ময়াভিভূত, কেননা গত দশ মাস ধরিয়া লাগাতার ফোঁসফাঁস করিবার পর ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র সংবরণ বিষয়ে একটি ‘ডেডলাইন’ প্রস্তাব পর্যন্ত উত্থাপন করেন নাই। মে মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার সহিত বৈঠক ও জুন মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহিত বৈঠক— দুই ক্ষেত্রেই কিম জং উন তাঁহার পরমাণু-বক্তব্য একই রাখিয়াছেন, ফলে আশা থাকিতেছে যে তিনি কথানুযায়ী কাজ করিবেন। কিন্তু কূটনীতিতে আশা বস্তুটি বড়ই দুর্বল ও অনিশ্চিত। সেই দুর্বলতা হইতে বাহির হইবার পথ রাখিল না সিঙ্গাপুরের ঐতিহাসিক শীর্ষবৈঠক।
তবে, শুরুরও শুরু থাকে। সেই যুক্তিতে, আশায় বুক বাঁধাই বোধ করি এখন বিশ্বের কর্তব্য। ওয়াশিংটন-পিয়ংইয়্যাং যে মুখোমুখি বসিতে পারিবে, কয়েক মাস আগে অবধি ইহা নেহাত কল্পকথা ছিল। সেই অভাবিত ঘটনা যে শেষ পর্যন্ত ঘটিল, কম কথা নয়। চিন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের সক্রিয় প্রচেষ্টা ছাড়া ইহা সম্ভব হইত না। বিশেষ করিয়া সিঙ্গাপুর সরকারের বিরাট কৃতিত্ব: দক্ষিণ-পূর্ব চিন সমুদ্র অঞ্চলে শান্তি রক্ষা ও আন্তর্জাতিক স্থিতি বজায় রাখিবার লক্ষ্যে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা। এমন অসাধারণ কূটনৈতিক প্রয়াস প্রমাণ করে, শুভসঙ্কল্পে কত কী হইতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য শত্রুভাবাপন্ন দেশ, যাহারা নিয়মিত পরস্পরের চৌদ্দ পুরুষ স্মরণ করিয়া দিনাতিপাত করে— এই দৃষ্টান্ত হইতে শিক্ষা লইতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy