Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ওঁদের আমরা সর্বনাশের প্রান্তে ঠেলে দিচ্ছি না তো?

ওঁরা আধা-কাশ্মীরি! বছরের অর্ধেক সময় যেখানে ওঁরা থাকেন সেখানে পেলেট, কার্ফু, এনকাউন্টার শব্দগুলো আবছা জলছবির মতো— দৈনন্দিন বাস্তবের চৌহদ্দির মধ্যে নেই। লিখছেন সুস্মিত হালদার।ওঁরা আধা-কাশ্মীরি! বছরের অর্ধেক সময় যেখানে ওঁরা থাকেন সেখানে পেলেট, কার্ফু, এনকাউন্টার শব্দগুলো আবছা জলছবির মতো— দৈনন্দিন বাস্তবের চৌহদ্দির মধ্যে নেই।

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৯ ০১:১৬
Share: Save:

ফেব্রুয়ারি পার করে যখন বাংলার হাওয়ায় বসন্তের পলাশ-ছোঁয়া, ওঁদের তখন পাট গোটানোর পালা।

বছরের অর্ধেকটা এখানেই কেটে যায় দোকানপাট সামলে— কারও রানাঘাট, তো কারও বহরমপুর। রোজই মনে পড়ে প্রিয়জনের মুখ— সেই সুদূর পাহাড়-ঘেরা উপত্যকায় পহলগাম, কুলগাম, বান্দিপোরায় যাঁদের তিনি আল্লার ভরসায় রেখে এসেছেন। যাঁদের দরজার বাইরে সেনার ভারী বুটের শব্দ, জানলার পাশে জঙ্গির ফিসফিস। হাওয়া জুড়ে শুধু ভয়, ভয় আর ভয়। চিন্তা লেগেই থাকে।

আজ কার্ফু তো কাল অভিযান। আজ বিস্ফোরণ তো কাল হরতাল। ছেলেমেয়েগুলো স্কুলে যেতে পারল? বুড়ো বাবা দাওয়াই পেল তো? কোনও দিন ফুরফুরে বিকেলে সঙ্গীতা সিনেমা হলে ‘পদ্মাবত’ দেখে বেরিয়ে মনে হয়, আহা, বিবিটা আমার কত দিন এ ভাবে জমিয়ে সিনেমা দেখেনি। কাশ্মীরে সিনেমা হলই যে বন্ধ দু’দশক!

ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে এলেই ওঁদের বুকে পর্ণমোচী মেপলের কাঁপুনি— এক দিকে ঘরে ফেরার ভাল লাগা, অন্য দিকে জঙ্গি উপদ্রুত, মিলিটারি মোড়া অবরুদ্ধ জীবনে ফিরে যাওয়ার শ্বাসরোধী আতঙ্ক। যে কাশ্মীরিরা মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার স্বাদই জানেন না, তাঁদের হয়তো ততটা মনে হবে না। কিন্তু ওঁরা যে আধা-কাশ্মীরি! বছরের অর্ধেক সময় যে সব লোকালয়ে ওঁরা ছড়িয়ে থাকেন সেখানে পেলেট, কার্ফু, এনকাউন্টার শব্দগুলো আবছা জলছবির মতো— দৈনন্দিন বাস্তবের চৌহদ্দির মধ্যে নেই। তার বদলে আছে আড্ডা, মিছিল, সিরিয়াল, পেঁচো দাদাগিরি। বোমা বললে লোকে বড় জোর পেটো বোঝে, আইইডি নয়।

কৃষ্ণনগরের তস্য গলির ভিতরে প্রশস্ত ঘর। ঘরের ভিতরে ছোট-বড় বস্তা— কোনওটায় শীতের পোশাক, কোনওটায় বা শাল। এক কোণে তোশক পাতা। তাতে বসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে উদাস বছর চল্লিশের যুবক। সারা দিনমান সাইকেল চালিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় শাল ফিরি করে ঘরে ফিরেছেন। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। দেশের কথা তুলতেই চুপ। তার পর আস্তে আস্তে বলেন, “বাড়ি ফিরতে হবে ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। বিশ্বাস করুন, ওখানে পরিবার না থাকলে আর ফিরতাম না।”

পাশ থেকে মাথা নেড়ে সায় দেন বছর পঁয়ষট্টির বৃদ্ধ। কৃষ্ণনগরে ওঁদের প্রায় চার দশকের দোকান। আশপাশে কারও দোকান আঠারো বছরের তো কারও আঠাশ। যখন থেকে ওঁরা বা ওঁদের বাপ-দাদারা আসতে এ তল্লাটে শুরু করেছিলেন, তখনও খুনোখুনি শুরু হয়নি। কাশ্মীর বলতে লোকে বুঝত ভূস্বর্গ, ডাল লেক-পহলগামের অপার্থিব সৌন্দর্য। শাম্মী কপূর তখনও ‘কাশ্মীর কি কলি’র চারপাশে নেচে-গেয়ে ঘুরছেন, জঙ্গিদের হাতে অপহৃত স্বামীর খোঁজে ‘রোজা’ পাগলপারা দৌড় লাগায়নি। উপত্যকার হৃদয়যন্ত্রণা নিবিষ্ট আঙুলে ছুঁয়ে দেখেনি ‘হায়দর’।

ওঁদের চোখের সামনে পাল্টে গিয়েছে সব। নিজভূমে হারিয়ে যাওয়া শান্তি, স্বাধীনতা, ফুর্তি ওঁরা ফিরে পান সেই ভারতে এসে যারা কাশ্মীরকে ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করে এবং যাদের বিরুদ্ধে কিছু ভূমিপুত্র যুদ্ধ ঘোষণা করায় গোটা উপত্যকা রণাঙ্গন হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর নভেম্বরে যখন শ্রীনগর স্টেশন থেকে হুইসল দিয়ে ওঁদের ট্রেন ছাড়ে, মন কেমনের পাশপাশি খানিক স্বস্তিও যেন বয় কুলকুল করে। কৃষ্ণনগরের দোকানে বসে কাশ্মীরি যুবক বলেই ফেলেন, “রিল্যাক্সড লাগে, জানেন! মনে হয়, এ বার একটু স্বাধীন ভাবে শ্বাস নিতে পারব।” কিন্তু সেই ভারতও যদি তাঁদের সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে থাকতে না দেয়? যদি হাজার মাইল দূরে সেনা কনভয়ে জঙ্গি হামলা হতেই তাঁদের মুখ লক্ষ্য করে ছুটে আসে ঘুসি? যদি বাড়ি ফেরার সময়ে শুধু কাশ্মীরি বলে ট্রেনে তাঁদের আলাদা ‘চেকিং’ করা হয়? পোশাক খুলে চালানো হয় তল্লাশি?

এ সব যন্ত্রণা বুকে লুকিয়েই এই শহরে ওই গাঁয়ে ওঁরা হাসি মুখে বাড়ি বাড়ি শাল বিক্রি করে বেড়ান। কিন্তু বুকের চিনচিনে যন্ত্রণাটা উসকে ওঠে যখন দীর্ঘদিনের পরিচিত খরিদ্দার একরাশ কৌতুহল ভরে জানতে চান, “আচ্ছা, তোমাদের গ্রামে অনেকেই বুঝি জঙ্গি?” যখন গোলগাল নিরাপদ দেখতে কোনও মাসিমা বলে ওঠেন, ‘‘তোমরা তো এ দেশেরই লোক, এক বার বলো তো বাপু ‘জয় হিন্দ’! দেখি, কেমন বলতে পারো?’’ চারপাশের অবিশ্বাসী চোখগুলো ওঁরা তখন দেখতে পান। কুঁকড়ে যান। ঠিক যে ভাবে কুঁকড়ে থাকেন কাশ্মীরে, সেনার রক্তচক্ষুর সামনে।

শুধু যে শাল ফিরি করতেই কাশ্মীর ছেড়ে লোকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যান তা তো নয়। নানা পেশায়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হতে আসেন। তাঁদের বুকে বাকি ভারতের কোটি-কোটি মানুষের মতোই মুক্তি আর মর্যাদার বাসনা। পথে-পথে সেনার খানাতল্লাশ থেকে মুক্তি, কথায়-কথায় ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা’র স্বার্থে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে মুক্তি, নিরন্তর অপমান থেকে মুক্তি।

দু’দশক ধরে কৃষ্ণনগরে আসছেন, এমন এক শালওয়ালা মাথা নেড়ে বলছেন, “ওখানে এতটুকু স্বাধীনতা নেই। প্রতি মুহূর্তে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানে তার উল্টোটা। রাতে রাস্তায় হেঁটে যাও, কেউ কিছু বলবে না। মিলিটারি নেই। হাজার চেকিং নেই। জঙ্গি সন্দেহে যখন খুশি ধরে নিয়ে যাওয়া নেই।”

ছায়াযুদ্ধে যখন গা-গরম করছে গোটা দেশ, নিজের দোকানে বসে বৃদ্ধ শুধু বলছেন, ‘‘আমরা কোথায় যাব? কোথায় আমাদের ভয় নেই?’’

যাঁরা আছেন মাঝখানে, তাঁদেরই আমরা কোনও সর্বনাশা প্রান্তের দিকে ঠেলে দিচ্ছি না তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kashmiri Pulwama Terror Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE