Advertisement
E-Paper

আর্সেনিক দূষণের শিকার বেশি কালনা, কাটোয়া মহকুমায়

বিশ শতকের আটের দশকে প্রথম ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে শুরু করেন। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহারের পাশাপাশি বাংলাদেশের নানা জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক রয়েছে। লিখছেন মৃণালকান্তি ভট্টাচার্যআর্সেনিক। একটি মৌল। পারমাণবিক সংখ্যা ৩৩, আণবিক ভর ৭৪.৯২। এই মৌলটির নাম শুনলেই এখন অনেকের আতঙ্ক হয়। ভূগর্ভের জলে উপস্থিত এই আর্সেনিকের কারণে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বাংলার নানা প্রান্তের মানুষ।

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:২৮
আর্সেনিকের ফল। ফাইল ছবি

আর্সেনিকের ফল। ফাইল ছবি

আর্সেনিক। একটি মৌল। পারমাণবিক সংখ্যা ৩৩, আণবিক ভর ৭৪.৯২। এই মৌলটির নাম শুনলেই এখন অনেকের আতঙ্ক হয়। ভূগর্ভের জলে উপস্থিত এই আর্সেনিকের কারণে রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বাংলার নানা প্রান্তের মানুষ।

আর্সেনিকের ব্যবহার অবশ্য মানব ইতিহাসে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। পুরাতত্ত্ববিদরা দেখেছেন, ব্রোঞ্জ যুগেও এর ব্যবহার ছিল। ব্রোঞ্জকে শক্ত করতে আর্সেনিক কাজে লাগত। কয়েক হাজার বছর পরে রং তৈরি করতে আর্সেনিকের ব্যবহার হত। এ ছাড়া নানা রাসায়নিক দ্রব্যে আর্সেনিক ব্যবহার করা হত। পাশাপাশি, আর্সেনিক যে বিষাক্ত সেই ধারণাটিও বেশ প্রাচীন। শত্রু নিধনের পন্থা হিসেবে আর্সেনিক প্রয়োগ করা হত। আর্সেনিকের এই বিষক্রিয়তার কথা মাথায় রেখে

নানা কীটনাশকে আর্সেনিক ব্যবহার করা হত।

বিশ শতকের আটের দশকে প্রথম ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের উপস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে শুরু করেন। এই সময়েই শুরু হয় সমীক্ষার কাজ। সমীক্ষায় উঠে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহারের পাশাপাশি বাংলাদেশের নানা জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র এই তিনটি নদীর মাঝে যে বিপুল এলাকা রয়েছে সেখানে ভূগর্ভস্ত জলস্তরে আর্সেনিকের প্রভাব রয়েছে। যার ফলে এই অঞ্চলের বহু মানুষ আজ আর্সেনিক দূষণের কবলে পড়েছেন। বছরের পরে বছর, প্রজন্মের পরে প্রজন্ম এই ভয়াবহ বিষের কুফল ভোগ করে চলেছেন।

সাম্প্রতিক সমীক্ষা থেকে পশ্চিমবঙ্গের ১২টি জেলা জুড়ে ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের উপস্থিতির কথা জানা গিয়েছে। মোটামুটি ১১৫ থেকে ১২০টি ব্লকে এই আর্সেনিক দূষণের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া এমনকী, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুরের মতো জেলাগুলিতে আজ আর্সেনিক দূষণের শিকার।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া এবং কালনা শহর দু’টি ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত। এই দুই মহকুমার অন্তর্গত এলাকাগুলি অন্য জায়গাগুলির তুলনায় বেশি আর্সেনিক দূষণের শিকার হয়েছে। এই জেলার অন্তর্গত কেতুগ্রাম-২, কাটোয়া-১, পূর্বস্থলী-১, পূর্বস্থলী-২, কালনা-১, মেমারি-২ এবং বর্ধমান সদর-১— মূলত এই সাতটি ব্লক আর্সেনিক কবলিত। ফলে এই এলাকাগুলিতে বসবাসকারী কয়েক লক্ষ মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে আর্সেনিক বিষ শরীরে গ্রহণ করছেন। যার বেশির ভাগটাই আসছে পানীয় জল থেকে।

পূর্ব বর্ধমানের বেশির ভাগ গ্রামীণ এলাকা। এই এলাকাগুলির আশি শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। আর এই জেলার কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলের অন্যতম উৎস হল গভীর নলকূপ। গভীর নলকূপের মাধ্যমে তুলে আনা হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। বিজ্ঞানীদের করা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গভীর নলকূপের সাহায্যে অতিরিক্ত জল তুলে আনার কারণেই আর্সেনিকের থেকে দূষণ বাড়ছে। কাটোয়া ও বর্ধমান সদর মহকুমার দু’টি ব্লক এবং কালনা মহকুমার তিনটি ব্লক আগে থেকেই আর্সেনিক দূষণ কবলিত। এই সব এলাকায় ভূগর্ভস্থ জল অপরিমিত হারে সেচের কাজে ব্যবহার কারণে আর্সেনিকের দূষণ আরও বেশি ছ়ড়িয়ে পড়ছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, আর্সেনিক যুক্ত জল দিয়ে চাষ করলে খাদ্যশস্যে একটু একটু করে আর্সেনিক জমা হয়। পরে তা মানব শরীরে প্রবেশ করে। বর্ধমান, কাটোয়া, কালনার আর্সেনিক প্রবণ এলাকায় এ ভাবেই ভূগর্ভস্থ জল থেকে উৎপন্ন ফসলে আর্সেনিক সঞ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়াও আর্সেনিক যুক্ত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক যথেচ্ছ ব্যবহার করার ফলেও আর্সেনিক দূষণ ঘটে চলেছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

এখন প্রশ্ন হল এই মৌলের সহনশীল মাত্রা কতটা? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’-এর রিপোর্ট অনুসারে আর্সেনিকের সহনশীল মাত্রা হল ০.০১ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার জলে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক কবলিত অঞ্চলগুলিতে পানীয় জলে আর্সেনিকের উপস্থিতির হার এর থেকে অনেকগুণ বেশি।

পানীয় জল ও খাদ্যের মাধ্যমে আমরা প্রতি দিন যে আর্সেনিক গ্রহণ করে চলেছি তা হাড়, লিভার, কিডনি, ত্বক এবং মাংসপেশির মতো অংশে জমা হয়ে থাকে। এই আর্সেনিক লোহিত রক্তকণিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রক্তাল্পতা ঘটায়। প্রোটিন ও উৎসেচকের স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট করে। ক্ষয়পূরণের শক্তিকে দুর্বল করে তোলে। এর জেরে সামগ্রিক ভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এমনকী, আর্সেনিকের প্রভাবে ত্বকের ক্যানসার এবং ব্ল্যাকফুট ডিজিজের মতো রোগ হতে পারে।

আর্সেনিক দূষণ ভয়াবহ মাত্রায় আবির্ভূত হওয়ার আগেই আমাদের সকলকে সতর্ক হতে হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারকেই এ বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের পরামর্শ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ করতে হবে। আর্সেনিক প্রবণ এলাকাগুলিতে চাষের কাজে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কমানো, বৃষ্টির জলকে জমিয়ে রাখার প্রকল্প তৈরি, ভূপৃষ্ঠের উপরের জলাশয়গুলির জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি— প্রভৃতির মাধ্যমে আর্সেনিকের দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। বৃহত্তর স্বার্থে প্রয়োজনে আর্সেনিক কবলিত অঞ্চলগুলিকে ‘ব্ল্যাক স্পট’ হিসেবে চিহ্ণিত করে খাদ্যদ্রব্য আনায় বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে।

সরকারি কর্মী ও কাটোয়ার সাহিত্যকর্মী

Health Arsenic Pollution Pollution
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy