Advertisement
E-Paper

লিপিকরের পরিচয়ে সেকালের সমাজচিত্র

তাঁদের কথা লেখা থাকত পুথির পুষ্পিকা অংশে। এই অংশে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে লিপিবদ্ধ হত তাঁদের পরিচয়, ক্ষেত্র বিশেষে তাঁদের মতামত। এই আত্মপরিচয়ে কখনও কখনও উঠে আসত সমাজজীবনের নানা অনুষঙ্গ। লিখছেন শ্রীকান্ত বসুএই প্রসঙ্গে প্রথমেই উঠে আসে খণ্ডঘোষের লিপিকর নন্দদুলাল দেবশর্মার কথা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের কথা ধরা আছে খণ্ডঘোষের গৈতানপুরের বাসিন্দা নন্দদুলালের নানা লিপিতে।

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:২৭
লিপিকর পদ্মলোচন রায়ের লেখা পুথির পুষ্পিকা। ছবি: উদিত সিংহ

লিপিকর পদ্মলোচন রায়ের লেখা পুথির পুষ্পিকা। ছবি: উদিত সিংহ

তখনও বাংলায় ছাপাখানা আসেনি। ছাপাযন্ত্রে কালো হরফে রাশি রাশি অক্ষরের কাগজবন্দি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। সেই সময় বাংলার বিভিন্ন পল্লিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন তাঁরা। তাঁদের হাত ধরেই রাশি রাশি তুলোট কাগজে লিপিবদ্ধ হয়েছে নানা কাব্য। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা ছড়িয়ে পড়েছে। নিরলস পরিশ্রমে আর অসীম মমতায় এই কাজ করেছেন লিপিকরেরা। কিন্তু তাঁদের কথা কী ভাবে জানতে পারলাম? তাঁদের কথা লেখা থাকত পুথির পুষ্পিকা অংশে। এই অংশে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে লিপিবদ্ধ হত তাঁদের পরিচয়, ক্ষেত্র বিশেষে তাঁদের মতামতও। এই আত্মপরিচয়ে কখনও কখনও উঠে আসত সমাজজীবনের নানা অনুষঙ্গ। কৃষিকেন্দ্রিক পূর্ব বর্ধমানের নানা প্রান্তে মধ্যযুগে বহু লিপিকর ছিলেন। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বর্গী আক্রমণের মতো ইতিহাসের নানা উত্থান-পতনের কথা ফিরে এসেছে এই সব লিপিকরদের আত্মপরিচয়ে।

এই প্রসঙ্গে প্রথমেই উঠে আসে খণ্ডঘোষের লিপিকর নন্দদুলাল দেবশর্মার কথা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের কথা ধরা আছে খণ্ডঘোষের গৈতানপুরের বাসিন্দা নন্দদুলালের নানা লিপিতে। এই লিপি চলিত বাংলায় অনুবাদ করলে হয়, ‘‘খরার বছরে দেবতা বৃষ্টি না দেওয়ায় কোনও কাজ নেই। গ্রামের লোকজন গৈতনপুর যেতে লাগল কাজের সন্ধানে। চালের দাম বৃদ্ধি পেয়ে এক টাকায় ২৪ সের হল। তাও পাওয়া যায় না। গ্রামের অর্ধেক মানুষ খাবার পায়নি। অন্য গ্রামে গেলে তাঁরা অপরিচিত ভিন্ন গ্রামের লোককে কাজে রাখেন না। তাঁরা বলেন, কার্তিক মাসে বৃষ্টি হলে এঁরা নিজের গ্রামে ফিরে যাবেন। তাই রাখেন না।’’

নন্দদুলালের লেখা থেকে জানা যায় সেই মন্বন্তরে কী ভাবে গ্রামের পরে গ্রাম শূন্য হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের সেই অভাবের দিনেও তহশিলদারেরা গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন খাজনা আদায়ের আশায়। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামে ধর্ম কর্ম বলে কিছু নেই। গ্রামে মানুষ নেই। গ্রামের মোড়ল তোষামোদকারী। বোঁয়াই গ্রামে অনেক নিঃশেষকারী ব্যক্তি আছে।

খবর এসেছে তহশিলদার তারাচাঁদ আর তালুকদার নারায়ণ পোদ্দার খাজনা আদায় করতে এসেছে।

তাঁদের পৌষ মাস শুরু হয়েছে যেন। ইতি ১৬ আষাঢ়।’’

নন্দদুলাল যখন এই ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করেন, তখন তিনি কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর একটি পুথি প্রস্তুত করছিলেন। সেই পুথির শেষ অংশে তিনি বাস্তব সমাজচিত্র তুলে ধরলেন। ইতিহাসবিদ হান্টার তাঁর ‘অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, এই দুর্ভিক্ষে এক কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আজকের উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যার যুগে এই সব লিপিকরদের আন্তরিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতা আমাদের অবাক করে।

সাধারণ ভাবে মধ্যযুগের লিপিকারদের দু’টি ভাগ ছিল। এক দল ছিলেন পূর্ণ সময়ের লিপিকর। আর এক দল ছিলেন আংশিক সময়ের লিপিকর। যাঁরা অবসর সময়ে অনুলিপি রচনা করতেন। খণ্ডঘোষ গ্রামের নন্দদুলাল ছিলেন দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত।

খণ্ডঘোষ গ্রামটি ছিল দামোদর নদ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। আর গৈতানপুর, কামালপুরের মতো গ্রামগুলো দামোদরের একদম তীরে হওয়ায় এখানে চাষবাস ভাল হত। নন্দদুলালের লিপি থেকে এই সব গ্রামের জীবনযাত্রার কথাও জানা যায়।

১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে আর একটি পুথির পাতায় দেখা যায় শ্রীবৃন্দাবন বিহারী, তাঁর গুরু খণ্ডঘোষ গ্রামের পুরুষোত্তম বিদ্যালঙ্কারকে বর্গী আক্রমণ ও অন্য প্রসঙ্গে লিখেছেন। আধুনিক চলিত বাংলায় তা দাঁড়ায়, ‘‘জানতে পারলাম, আপনি সাবধানে নিরুপদ্রবে পার হয়েছেন। জেনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছি। তবে বর্গীদের খবর এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আপনি আমাকে ‘সাক্ষর দশম’-এর পুথি পাঠাবেন। না হলে লেখা বন্ধ থাকবে। আমি চৈত্রের পরে আবার পত্র লিখব।’’

বৃন্দাবন বিহারীর পুথিটি বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালায় রয়েছে। পুথির ‘পুষ্পিকা’ অংশ থেকে জানা যায়, তাঁর বাড়ি ছি‌ল বীরভূমে। সামান্য কয়েকটি পঙ্‌ক্তি থেকে বোঝা যায় যে বর্গী আক্রমণে বিপর্যস্ত বাংলায় সে দিন এঁরা কী ভাবে পুথিগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ছাপাখানার প্রচলনের পরেও বাংলার নানা গ্রামে হাতে লেখার কাজ চলত। বর্ধমান জেলার শাঁকারি গ্রামের কালীপ্রসাদ মজুমদার ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে গদাধর দাসের ‘জগন্নাথমঙ্গল’ হাতে অনুলিপি করেছিলেন। এই পুথিটি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রক্ষিত রয়েছে।

বাংলার ইতিহাসে লিপিকরদের সময় সাতশো থেকে আটশো বছর। অনেক সময় মধ্যযুগের পুথির পাঠ নির্ণয় করতে বসে আমাদের লিপিকরদের লেখার প্রমাদের জন্য সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু তাতে তাঁদের গুরুত্ব এতটুকুও কমে না। কারণ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অমূল্য নিদর্শনগুলি লিপিকরদের হাত ধরেই বাংলার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্রীখণ্ডের রাধামোহন ঠাকুর অনুলিপির মাধ্যমেই বৈষ্ণব সঙ্কলনগ্রন্থ প্রস্তুত করেছিলেন। তা না হলে বৈষ্ণবপদাবলীর বহু অমূল্য পদ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেত। তবে মধ্যযুগের কবি বা কাব্য নিয়ে বর্তমানে যতটা গবেষণা হয় তার সিকিভাগও হয় না এই লিপিকরদের নিয়ে। তা যদি সম্ভব হত তা হলে, হয়তো লিপিকররা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা পেতেন।

গ্রন্থঋণ: পুথি পরিচয় (৪র্থ খণ্ড), চিঠিপত্রে সমাজচিত্র (১ম ও দ্বিতীয় খণ্ড), পঞ্চানন মণ্ডল

বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

Amanuensis Manuscript
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy