Advertisement
E-Paper

অসন্তোষ বাড়ছে বলেই কি সঙ্ঘের ভাবমূর্তি বদলের প্রচেষ্টা

২০০০ সালের অগস্ট মাসে কর্ণ থাপারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক কে সুদর্শন বলেছিলেন যে, তিনি ভারতীয় সংবিধানের বর্তমান অবস্থাকে মানেন না। জাতির সত্যিকারের ভাবনা ভারতের সংবিধানে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এই সংবিধান ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০৫
চিন্তান্বিত? সাম্প্রতিক এক পুস্তক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত, দিল্লি, ২০ সেপ্টেম্বর। পিটিআই

চিন্তান্বিত? সাম্প্রতিক এক পুস্তক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত, দিল্লি, ২০ সেপ্টেম্বর। পিটিআই

আরএসএস-এ নাকি গ্লাসনস্তের সুপবন বহিতেছে? উনিশশো আশির দশকে গর্বাচভ সোভিয়েত দেশে যেমন কমিউনিজ়মের সংস্কার সাধন করতে চেয়েছিলেন, মোহন ভাগবতও না কি তেমনই বদলে দিতে চাইছেন আরএসএস তথা সঙ্ঘ-দর্শনের সাবেকি গোলপোস্ট? সম্প্রতি রাজধানীর বিজ্ঞানভবনে আয়োজিত ভবিষ্যতের ভারত নিয়ে তিন দিনের আলোচনা সভায় মোহন ভাগবত সমস্ত বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গত, পুরো আলোচনাটি জনসমক্ষে তুলে ধরা হল। প্রতিপক্ষ বিরোধী দলগুলিকেও এ সভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যদিও কার্যত কোনও বিরোধী নেতাই আলোচনা-সভায় যোগ দেননি।

আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজ়ার’-এর প্রচ্ছদ নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘‘দ্য সঙ্ঘ অ্যাজ় ইট ইজ়।’’ সম্পাদক প্রফুল্ল কেতকারকে চিনি। মরাঠি এই যুবক খাস নাগপুর থেকে এসেছেন। উৎসাহে টগবগ করেন। সেই কেতকারের বক্তব্য কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি লিখেছেন ভাগবত আজ যা বলছেন, সেটাই আসলে আরএসএস-এর চিরকালীন বক্তব্য। গুরু গোলওয়ালকর হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, এটা নিছক ধর্মীয় কোনও ধারণা নয়। প্রাচীন সভ্যতার প্রতি এক বিপুল জনসমাজের শ্রদ্ধা এবং ভারতীয় দেশাত্মবোধ। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ কোনও ব্যক্তির পুজো-পদ্ধতির উপর নির্ভর করে না।

‘অর্গানাইজ়ার’-এর সম্পাদক যা-ই বলুন, ২০০০ সালের অগস্ট মাসে কর্ণ থাপারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক কে সুদর্শন বলেছিলেন যে, তিনি ভারতীয় সংবিধানের বর্তমান অবস্থাকে মানেন না। জাতির সত্যিকারের ভাবনা ভারতের সংবিধানে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এই সংবিধান ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া। গোলওয়ালকর তার ‘বাঞ্চ অব থট্‌স’-এ বলেছিলেন যে সংবিধানে এমন কিছু নেই যা আমাদের নিজস্ব। ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনই ভারতের সংবিধানের ভিত্তি। মোহন ভাগবত কিন্তু আজ এত বছর পর এই পুরনো বক্তব্য খারিজ করলেন। ‘বাঞ্চ অব থট্‌স’-এর প্রাসঙ্গিকতা নাকচ করলেন। প্রস্তাবনা পড়ে শোনালেন, এমনকি বললেন, সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতার মতো শব্দ নিয়েও কোনও আপত্তি নেই। মুসলমান সমাজ সম্বন্ধেও পুরনো বহু বক্তব্য খারিজ করে বললেন ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ সফল হবে না, যদি সে রাষ্ট্রে মুসলমানরা না থাকেন।

আজ থেকে বহু বছর আগে লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে আমি নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে গিয়েছিলাম। কে সুদর্শন তখন সরসঙ্ঘচালক। আশ্রমিক পরিবেশ। বিশাল এলাকা। প্রচারকদের ঘরগুলি খুবই সাধারণ। হেডগেওয়ার ছাড়া যাঁর ছবি দেখেছিলাম প্রায় প্রতিটি তলায়, তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। সকলেরই খুবই অমায়িক ব্যবহার। এক প্রবীণ প্রচারক ধুতি পরে আদুর-গায়ে তক্তপোশে বসে জানালার ধারে সূর্যের আলোয় মরাঠি ভাষায় লেখা শিবাজির জীবনী পড়ছিলেন। পরবর্তী সময়ে দিল্লির ঝান্ডেওয়ালাতে নানাজি দেশমুখের সঙ্গেও আমি একাধিক বার কথা বলেছি। কথা বলতে খুব ভাল লাগত। মধ্যপ্রদেশে তাঁর তৈরি সংগঠন আজও নানা সামাজিক কাজকর্ম করে। তাঁর মৃত্যুর পরও সেখানে কর্মযজ্ঞ চলছে, যেমন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে বনবাসী সমিতি ও আরও বহু সংগঠন আছে। কমিউনিস্টরা এ দেশে আজও এ ধরনের সমাজসেবামূলক কাজকর্ম ও সুশৃঙ্খল সংগঠন গড়ে তুলতে পারেননি। মোহন ভাগবতের সঙ্গে দিল্লিতে দু’বার মধ্যাহ্নভোজনের সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, সব বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত তিনি।

১৯২৫ সালে আরএসএস-এর জন্ম। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিরও জন্ম সেই বছরই। তা হলে আজ আরএসএস গোটা দেশে এমন প্রবল পরাক্রান্ত শক্তি, কমিউনিস্টরা কেন নয়? আগে তো আরএসএস সংবাদমাধ্যমকে কার্যত এড়িয়ে চলত। তার পর দেখলাম, রাম মাধব আরএসএস-এর মুখপাত্র হয়ে উঠলেন, শাখাগুলিতে কম্পিউটার নিয়ে আসার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিলেন। সেই বাজপেয়ী-আডবাণীর সময় থেকেই আরএসএস-এর হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট চালুর কথা হয়। আরএসএস-এ মহিলাদের ভূমিকাকেও স্বীকৃতি দেওয়া শুরু হয় ধীরে ধীরে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজ্ঞানভবনে এই গ্লাসনস্ত তাই কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়, এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি।

এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। আরএসএস যদি সংবিধানে আস্থা রেখে বলে যে তারা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, তবে তাকেও স্বাগত জানাব। সঙ্কীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতে আসার চেষ্টার নিন্দা করব কেন?

তবে অভিনন্দনের পাশাপাশি প্রশ্নও আছে। গোটা দেশ জুড়ে গত পাঁচ বছরে এত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ঘটনা, কিংবা বাবরি মসজিদের ধ্বংস থেকে গোধরা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কথা তুলতেই হয়। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দাদরি থেকে মুজফ্ফরনগর, জাঠ বনাম মুসলমান, উচ্চবর্ণ হিন্দু বনাম দলিত, সর্বোপরি হিন্দু বনাম মুসলমান সংঘাতে যে প্রাত্যহিক সাম্প্রদায়িকতার আবহ তৈরি হয়েছে, তাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজেও অসন্তোষ এসেছে বলেই কি সঙ্ঘ পরিবারের ভাবমূর্তি বদলের প্রয়োজনীয়তা? আসলে, এ দেশে নেহরুর ভারততত্ত্বের পাল্টা হিসেবে হিন্দু রাষ্ট্রের ব্যাখ্যায় আজও দেশের নাগরিক সমাজের যথেষ্ট অনীহা আছে। দেশের ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’দের ভেতরে বামপন্থী উদারবাদের প্রভাব এখনও বেশি বলেই কি শহুরে ভারতে আরএসএস-এর সম্পর্কে ধারণা বদলানোর প্রয়োজন বেড়েছে? সেই কারণেই কি নানা প্রকাশন সংস্থা থেকে আরএসএস নিয়ে এত বই, এত আলোচনার ধুম? ২০১৯ সালে মোদীকে ফিরিয়ে আনার জন্যই কি এই সব সংস্কার?

অতীত বড় নির্মম। যে দল উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে এক জনও মুসলিম প্রার্থী দেয় না, যে দলের বহু শীর্ষ ও মাঝারি নেতা আজও কথায় কথায় মুসলিমবিরোধী বিবৃতি দেন, মুসলিমদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলেন, এমনকি এই মোহন ভাগবতই গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে বেদের বিধান অনুসারে গোমাংস ভক্ষণকারী পাপীর শাস্তি মৃত্যু, তাতে কি মনে হওয়া অন্যায় যে এই সব সংস্কারের কথা আসলে নেহাতই কাগজে কলমে? গ্রামে-গঞ্জে বাস্তবের জমিতে এখনও ধর্মনিরপেক্ষতা ও উন্নয়নের বদলে প্রকৃত স্লোগান সেই ‘জয় শ্রীরাম’ই? সত্যিই তো, এই উগ্র হিন্দুত্ব বিসর্জন দিলে বিজেপি দর্শনের সঙ্গে কংগ্রেসের দর্শনে ফারাক কী-ই বা থাকে।

ইতিহাসের পরিণতি এমনই করুণ। রাম মাধব মোহন ভাগবতের সঙ্গে গর্বাচভের তুলনা করছেন, তাই তাঁকেই একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। গ্লাসনস্তের পিছনেও ঐতিহাসিক বাধ্যতা ছিল। কমিউনিজ়ম ব্যর্থ হতে বসেছিল বলেই সংস্কারের পথে যেতে বাধ্য হন গর্বাচভ। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তাসের দেশের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। আরএসএস-এর এই শ্রীবৃদ্ধি রক্তাল্পতার পৃথুলতা কি না, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। ক্ষমতার সিংহাসনে উপবিষ্ট মানুষরা তো প্রায়শই বৃদ্ধির নীচে চোরাবালির সমস্যা টের পান না।

RSS Mohan Bhagbat Hinduism Religion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy