টুকরো হয়ে ভাবাচ্ছেন
ভোট বিদ্যাসাগরকেও ভাঙে! বিদ্যাসাগর রূপক মাত্র, আক্রান্ত বাঙালির ধৈর্য, মেধা এবং বিশ্বাস। তলিয়ে যাচ্ছে সমস্ত ভরসা, এক দিকে ভাল যে আজ তা চরমে পৌঁছেছে। এর পর কেবল উত্তরণই হতে পারে।
তবে বিদ্যাসাগর টুকরো হয়ে আরও ভাবাচ্ছেন। যদি বিদ্যাসাগর পরিকল্পিত ভাবে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তবে বাঙালিত্বের ওপর শুধু নয়, এটা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর আক্রমণ। বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের ভুলিয়ে দিতে পারলে নতুন মনীষীদের উত্থান ঘটানো যায়।
কিন্তু ভেঙে যাওয়া বিদ্যাসাগর অধিক শক্তিশালী। সর্বভারতীয় চ্যানেলগুলো আজ সজোরে ঘোষণা করছে, বিদ্যাসাগর কে ছিলেন। বলছে, তিনি শিক্ষা-নারীশিক্ষা-নবজাগরণ এবং নারীজাগরণের পথিকৃৎ। সর্বভারতীয় স্তরে অনেকটাই বিস্মৃত মনীষীকে নতুন করে তুলে আনার কাজটি করল তাঁর ভগ্ন মূর্তি। সারা ভারতে যাঁরা জানেন না, তাঁরাও আজ মিডিয়ার মাধ্যমে জানলেন এই মানুষটি তাঁর পুত্রের বিবাহ দিয়েছিলেন এক বিধবার সঙ্গে।
দেশের এই মহান সন্তানের আসন্ন দ্বিশতবর্ষে এর চেয়ে ভাল প্রচার আর কিছু হতে পারে না।
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
কলকাতা-৪০
সহ্য হবে কেন
ভোটপর্ব শেষ হয়নি, তারই মাঝে হঠাৎ এই মূর্তি ভাঙার কি কোনও মতলব ছিল? যুক্তিচেতনাসম্পন্ন বাঙালির কাছে বিদ্যাসাগর প্রাতঃস্মরণীয়, কাজেই মূর্তি ভেঙে রাজ্যের জনসমাজের কাছে এ বার্তা দেওয়াই যেন ফিকির— যুক্তি-নির্ভর কোনও ব্যক্তি বা বিষয়ে আস্থা রাখার প্রয়োজন নেই, দেশ ও সমাজভাবনায় আবেগসর্বস্ব হয়ে উঠতে হবে। দেশ জুড়ে রাজনীতির আবেগায়নের মহড়া চলছে। হয়তো এ ধরনের গুন্ডামি তারই অঙ্গ। বিশেষত বিদ্যাসাগরের ওপর হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের তো নানা কারণ আছে।
১) বিদ্যাসাগর কাশী গিয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্বনাথ-অন্নপূর্ণা দর্শনে যাননি। ব্রাহ্মণকুল রুষ্ট হয়ে পণ্ডিতকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি নাস্তিক? পিতামাতাকে দেখিয়ে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘‘এই আমার বিশ্বনাথ, এই আমার অন্নপূর্ণা।’’
২) বিদ্যাসাগর সন্ধ্যা-আহ্নিক, পূজা, আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন না। পরকাল মানতেন না। হাসিঠাট্টা করে বলতেন, ‘‘...আমারও পরকাল আছে না কি?’’
৩) উনি বলতেন, ‘‘ধর্ম যে কী, মানুষের বর্তমান অবস্থায় তা জানার উপায় নেই, জানারও কোনও দরকার নেই।’’ এও বলেছেন, ‘‘দেখ ধর্মকর্ম ওসব দল বাঁধা কাণ্ড।’’
৪) তিনি ছিলেন বেকনের আদর্শে প্রভাবিত। বেকনের দর্শন হল অভিজ্ঞতাবাদী বিজ্ঞানদর্শন। সাংখ্য ও বেদান্তকে বলেছিলেন, false systems of philosophy. তিনি সংস্কৃত কলেজে শূদ্রের শিক্ষাগ্রহণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর কখনও ধর্মবিশ্বাস বা শাস্ত্রের অনুজ্ঞার অনুবর্তী হননি। বলেছেন, ‘‘আমি দেশাচারের দাস নহি।’’ বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উক্তি: ‘‘তিনি রীতিমতো হিন্দু ছিলেন না।’’
বিদ্যাসাগর লৌকিক প্রথা মেনেছেন, আবার মানেননি। তিনি নাস্তিক ছিলেন না, ছিলেন সংশয়বাদী। বিদ্যাসাগরের ধর্মচেতনা সম্পর্কে অশোক সেন তাঁর বইতে লিখেছেন : ''Religion was rooted in the struggle of his rational mind.' বা, '...who refused to be distracted from the ethical and practical tasks of society.''
এমন আশিরনখ যুক্তিবাদী মনীষীকে হিন্দুত্ববাদীরা কোনও কালেই সহ্য করবেন না, বলা বাহুল্য।
শিবাশিস দত্ত
কলকাতা-৮৪
স্বখাত সলিলে
কাকে দোষ দেব? বাইরে থেকে ঘটানো হয়েছে বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাব? বরং নিজেদের দোষ দিই। অসমে গেরুয়া শাসনে ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী ছুটি বাতিল হল। আমরা প্রতিবাদ করিনি। ত্রিপুরায় গেরুয়া রাজত্বে সুকান্ত ভট্টাচার্যের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। প্রতিবাদ করিনি। বামপন্থীরা হেরে যাওয়ার পর কিছু জায়গায় লেনিনের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। প্রতিবাদ করিনি। আন্দামানে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখকে পিছনে রেখে সাভারকর বিখ্যাত হয়ে গেলেন। প্রতিবাদ করিনি। এখন এখানে গেরুয়া রাজনীতির দাপাদাপি বাড়তেই বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হল। কে ভাঙল তা নিয়ে তরজা চলতেই থাকবে, কারণ এই ভাঙনের আড়ালে মেরুকরণ কারা করাল,
তার দায় নেওয়ার সৎসাহস নেই কোনও পক্ষেরই।
শুভ্রাংশু কুমার রায়
ফটকগোড়া, হুগলি
কী এমন হল?
কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে রে একটা মূর্তি ভেঙে? প্রথম কথা, তোদের রাজ্যেরই এক জন সার্জিকাল স্ট্রাইকের প্রমাণ চেয়েছিলেন, তো উল্টে আমরাও যদি এখন ভিডিয়ো এভিডেন্স চাই, দিতে পারবি? কলেজের মেন গেট বন্ধ ছিল, ভেতরে কারা ছিল এবং কেন ছিল— এ সব ডিফেন্স তো আছেই। সে সব ছাড়, ১৮০ ফুট হাইটের মূর্তি হলে না-হয় এত আদিখ্যেতা মানা যেত। কারণ, ‘সাইজ় ডাজ় ম্যাটার’!
বর্ণপরিচয়ের চেয়ে তোদের বেঙ্গলে এখন চেতন ভগতের বিক্রি বেশি, তোদের কেসটা স্রেফ নস্টালজিয়া। সেই যে ছোটবেলায় ‘‘গোপাল বড় সুবোধ বালক’’ মুখস্থ করেছিলি, সে সব যে তোদের পরবর্তী প্রজন্মে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে, খেয়াল নেই আর। তোদের আইকনের ব্যক্তিজীবন দেখলে অবশ্য গোপালের চেয়ে ওই দামাল রাখালের সঙ্গেই সাদৃশ্য বেশি পাওয়া যায়, দম ছিল বটে, নিজের বড়ছেলেকে সম্বন্ধ করে বেধবার সঙ্গে বে দিয়েছিল, যেখানে তোদের তাবড় লিবারাল আজও শুভদৃষ্টির সময়ে সাদা শাড়ি দেখলে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মধ্যবিত্ত বাঙালির ভণ্ডামি নিয়ে মুখ আর খোলাস না রে!
সারা জীবন ওই গোপালের মতো সুবোধ বালক হয়েই থাক তোরা, আমাশায় ভোগা জাতি, ক্ষমতার সমীকরণ তোরা কী বুঝবি? শোন, বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি গুঁড়িয়ে তালিবানেরা ফুটেজও পেয়েছিল, আর সন্ত্রাসও জাগিয়েছিল, এগুলো এক ধরনের জরুরি স্টেটমেন্ট— তোরা ন্যাকা বাঙালি সে দিন কেঁদে মরেছিলি, আজও রুমাল ভেজাচ্ছিস, ওই অবধিই দৌড় তোদের।
তা ছাড়া, আজ আমরা কালিদাসের ‘মেঘদূত’ থেকে প্রাচীন ভারতবর্ষে ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’-এর রেফারেন্স টানছি, সেখানে একটা লোক ঊনবিংশ শতকে দেশে নারীশিক্ষা/বিধবাবিবাহের অধিকার নিয়ে লড়ছে, এগুলো ঠিক আমাদের হিন্দু সুপ্রিমেসির ন্যারেটিভের সঙ্গে খাপ খায় না। হিন্দু সমাজ আবার কোনও কালে খারাপ থাকতে পারে না কি, যে তার সংস্কার লাগবে? এ জাতীয় মানুষদের পাবলিক মেমরি থেকে ডিলিট করা তো অবশ্যকর্তব্য, সে তোরা চাস আর না-ই চাস।
আর পরিবর্তে নতুন সুপারম্যানও তো দিচ্ছি, বিষ্ণুর দশম অবতার, ‘মেঘে ঢাকা রেডার’ থিয়োরির প্রবক্তা, তাঁকে নিয়ে সেলিব্রেট কর না যত ইচ্ছে। তাতে লজ্জা করছে? আচ্ছা, এই রকম একটা স্টেটমেন্ট দিস না-হয়: ‘‘হ্যাঁ, মানছি মূর্তি ভাঙাটা বর্বরোচিত কাজ, কিন্তু দেশটাকে তো আর পাকিস্তান হতে দেওয়া যায় না, অতএব...।’’
শাশ্বত চক্রবর্তী
রাজারহাট