Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Vidyasagar

গভীর ঋণী ওপার বাংলাও

পূর্ববাংলার বিদ্বৎসমাজ শুধু বিস্ময়বোধ নয়, মুক্ত বিচারবোধেও তাকিয়েছেন বিদ্যাসাগরের দিকে।

পিয়াস মজিদ
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:১৯
Share: Save:

বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপনে দুই বাংলাতেই যখন নানা রকমের আয়োজন এবং স্মরণ ও প্রকাশন চোখে পড়ছে, তখন এক বার ফিরে তাকানো যেতে পারে তাঁর জন্মসার্ধশতবর্ষের পানে; বিগত শতকের সত্তরের দশকে।

১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দুই অধ্যাপক মহম্মদ আবদুল হাই ও আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিদ্যাসাগর-রচনাসংগ্রহ (স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা ১৯৬৮)। প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠার গ্রন্থের বিশদ ভূমিকায় সম্পাদকরা বলেন, “উনিশ শতকের বাঙলা দেশে বহু কীর্তিমান পুরুষের জন্ম হয়েছিল। এঁদের মধ্যেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাতন্ত্র্য সহজেই ধরা পড়ে। যে বিস্ময়বোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন, সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন’, যুগান্তরেও আমাদের বিস্ময়বোধের অবসান হয় না।”

তবে পূর্ববাংলার বিদ্বৎসমাজ শুধু বিস্ময়বোধ নয়, মুক্ত বিচারবোধেও তাকিয়েছেন বিদ্যাসাগরের দিকে। এরই সাক্ষ্য আছে ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে ‘সাহিত্য সংসদ, রাজশাহী’ থেকে অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত সার্ধশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ বিদ্যাসাগর-এ। আহমদ শরীফ, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, মুখলেসুর রহমান, সনৎকুমার সাহা, মযহারুল ইসলাম, বদরুদ্দীন উমর, গোলাম মুরশিদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, অজিতকুমার ঘোষ, আলি আনোয়ার পৃথক পৃথক প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের জীবন ও কৃতির নানা বিচিত্র অঞ্চলে আলো ফেলেছেন।

এই সঙ্কলন প্রকাশের পর পর পূর্ববাংলায় বিদ্যাসাগরের স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষ ভূগোল প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছিল। গোলাম মুরশিদ তাঁর গ্রন্থটির নতুন সংস্করণ (শোভাপ্রকাশ, ২০১১)-এর ভূমিকায় জানান ১৯৭১ এবং বিদ্যাসাগর বইয়ের অজানা অধ্যায়: “আমরা পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর বিশেষ নজরে পড়ি মার্চ মাসের ২১ তারিখে।

সেদিন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনার জন্যে জুলফিকার আলি ভুট্টো আসেন ঢাকায়। কাজেই রাত সাড়ে দশটায় আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের ‘সংবাদ সমীক্ষা’ শোনার জন্যে সবাই কান খাড়া করে রেখেছিলেন। সেই পরিবেশে প্রণবেশ সেনের লেখা এই গ্রন্থের একটি আবেগমূলক সমীক্ষা ততোধিক আবেগের সঙ্গে পড়ে শোনান দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে বিশেষ করে এর মাধ্যমে পূর্ববাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলন যে যথেষ্ট জোরালো, সেটার ওপর বিশেষ ঝোঁক দেওয়া হয়। গোয়েন্দা বিভাগের স্মৃতি যদি-বা দুর্বল হয়ে থাকে, সেটাকে আবার শানিয়ে দেয় এই ‘সংবাদ সমীক্ষা’। সুতরাং আসামিদের সম্পর্কে গোয়েন্দা বিভাগ আরো এক দফা সচেতন হয়ে ওঠে।”

স্বাধীন বাংলাদেশে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিদ্যাসাগর-চর্চা করেন প্রাবন্ধিক-গবেষক বদরুদ্দীন উমর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ-এ (সুবর্ণ প্রকাশন, ঢাকা, ১৯৭৪) তিনি লেখেন, “নব উত্থিত বাঙালী মধ্যবিত্তের প্রয়োজনের তাগিদে বিদ্যাসাগর যে গদ্যরীতির প্রচলন করেছিলেন পরবর্তীকালে বাঙালী সমাজের, বিশেষত বাঙালী মধ্যশ্রেণীর অন্তর্নিহিত দুর্বলতার জন্যে সে ভাষা বিজ্ঞান ও মননশীল রচনার বাহনরূপে যথেষ্ট বলিষ্ঠভাবে গঠিত হতে পারেনি। সে ত্রুটি বিদ্যাসাগরের নয়। তার মূল কারণ সমাজের ভিত্তি ও তার কাঠামোর দুর্বলতা এবং বাঙালী মধ্যশ্রেণীর মধ্যে শিল্প-বিকাশ, নানা বিষয়ে মৌলিক গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার একান্ত অভাব।”

ওপার বাংলার বিদ্যাসাগর-চর্চায় পর্যায়ক্রমে যুক্ত করা যায় আরও বেশ কয়েকটি নাম— সফিউদ্দিন আহমদের মানুষ ও শিল্পী বিদ্যাসাগর (নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৮২), খন্দকার রেজাউল করিমের বিদ্যাসাগর (মুক্তধারা, ১৯৯৩), হায়াৎ মামুদের নষ্টবঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রব্রজ্যা (সাহিত্যপ্রকাশ, ১৯৯৪), নারায়ণ চৌধুরীর বিদ্যাসাগর-চর্চা (বাংলাদেশ সংস্করণ, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৯৫), মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা-র বিদ্যাসাগর সংখ্যা (১৯৯৭), মহম্মদ আবদুল হাইয়ের ছোটদের বিদ্যাসাগর, আনিসুজ্জামানের সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা (অন্যপ্রকাশ, ২০১৮)।

বিদ্যাসাগরের জন্ম-দ্বিশতবর্ষে শীর্ষক এক বিপুলাকায় স্মারকগ্রন্থ (আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০২০) প্রকাশ পেয়েছে আলি মোহাম্মদ আবু নাঈম ও ফাহিমা কানিজ লাভা-র সঙ্কলন ও সম্পাদনায়। এতে সঙ্কলিত রবীন্দ্রনাথ থেকে নবনীতা দেব সেন পর্যন্ত নানা সময়ের লেখকদের বিদ্যাসাগর-অর্ঘ্য।

বিদ্যাসাগর এবং তাঁর বহুধা-বিপুলা কৃতির প্রতি বাংলাদেশের ঋণ স্বীকারের এক স্পষ্ট উচ্চারণ কবি রফিক আজাদের কবিতাসমগ্র (২০০৭)-এর উৎসর্গ-বাক্যে: “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— আধুনিক বাঙালির মস্তিষ্ক ও হৃদয় যাঁর কাছে গভীরভাবে ঋণী।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vidyasagar Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE