Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Berhampur

শাহিন বাগ ছড়িয়ে আছে বহরমপুরের রাস্তায়

মা-মেয়ে-দাদি এক সঙ্গে আজাদির দাবি তুলছেন। সংসার সামলে আন্দোলন করছেন রাতভর। লিখছেন জিনাত রেহেনা ইসলামপথচলতি মানুষের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। ওঁরা কারা? নেই চকচকে পোস্টার। ছেঁড়া-ফাটা তাঁবু জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ক্ষয়ে যাওয়া কয়েক জোড়া চটি।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৯
Share: Save:

সূর্যোদয়ের জন্য ভোর নয়, আকাশ চাই। প্রতিবাদ গড়ার জন্য জনমত নয়, মানুষের সততা চাই। দল বাঁধার জন্য চাই একখণ্ড জমি। মাথার উপরে এক টুকরো কাপড়ের ছাউনি। পালের হাওয়া বদলে দেখাল নবাব-দেশের মেয়েরা। বহরমপুরে শাহিন বাগ তুলে এনে বসিয়ে দিল রাতারাতি। দিল্লি আর দূর নয় চান্নু বেগম ও নাসিমার কাছে।

কাকভোরে দেখা গেল দিনের প্রতিবাদ রাত কাটিয়ে সকাল এনে দিয়েছে। মেয়েরা স্লোগান দিচ্ছেন, “মেরে মরনে কে বাদ মেরে খুন সে ইনকিলাব লিখ দে না, উসি খুন সে মেরে সরপে ভারত লিখ দে না।’’

পথচলতি মানুষের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। ওঁরা কারা? নেই চকচকে পোস্টার। ছেঁড়া-ফাটা তাঁবু জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ক্ষয়ে যাওয়া কয়েক জোড়া চটি। মলিন পোশাকে শুকনো মুখ। কপালে অনিশ্চয়তার ভাঁজ। টুম্পা ও রজনীদের হাত ধরেছে মিলি মুখোপাধ্যায় ও রূপালি ঘোষেরা। মাইকে বাজছে ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা।’ মঞ্চের দুই পাশে সারি দেওয়া কিছু চেয়ার। হাতে ধরা মুঠোফোনে ছবি ও ভিডিয়োতে ব্যস্ত এক দল মানুষ। প্রতিবাদ মেলায় মিশে মগ্ন ও মুগ্ধ যেন সকলেই!

নাসিমার ন’বছরের ছেলে ফয়জল মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে। মায়ের সঙ্গে আজাদির স্লোগানে গলা মেলাচ্ছে। আশি বছরের রোশন দাদি ভাল দেখতে পান না। ডান দিকের চশমার কাচ ফেটেছে। বসে বসে স্লোগান দিচ্ছেন, “আজাদ দেশ মে কেয়া চাহিয়ে?’’ উত্তর আসছে, ‘‘আজাদি’’। দাদি কী চান? জিজ্ঞাসা করতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। স্বামীর কবর ছেড়ে কোথাও যাবেন না দাদি কিছুতেই। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, “কাগজপত্র কিচ্ছু নেই। ঝাঁটা মেরে তাড়াব যদি আমাকে স্বামীর কবর থেকে কেউ দূরে যেতে বলে!’’ রৌশন বেগম নাতনি নিয়ে হাজির। সঙ্গে বৌমা ও বালিশ। হাঁটুর ব্যথা। তবুও মন মানেনি। ঘরের বৌ নয়না দিন-রাত বাইরে থাকবে? রৌশন কিসের ভয়ে প্রতিবাদে শামিল? প্রশ্ন করতেই এক মুখ আতঙ্ক নিয়ে বলেন, ‘‘কাগজ আছে গো। কিন্তু ভুল ভ্রান্তি দেখিয়ে যদি বাতিল করে দেয়? তখন কোথায় যাব?” সুফিয়া খাতুনেরও এক গোঁ, “মরে যাব এ ভাবেই প্রতিবাদ করতে করতে, কিন্তু সিএএ মানব না।’’

নাসিমার এক দিন ঘরের বাইরে পা রাখা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এক দিন রান্না না করা ছিল বড় সমস্যা। লাগাতার চার দিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁবু-জীবন। সকালে রান্না করে দিয়ে চলে আসছেন। বাকি দায়িত্ব সামাল দিচ্ছেন স্বামী। চুন্নুদের সমর্থনে সাড়া দিয়েছেন অনেকে। এসেছেন এক ডব্লিউবিসিএস মহিলা অফিসার। মেয়েও মা-আব্বুকে নিয়ে মঞ্চে বসেছেন। মেয়ের হাতে কাগজে লেখা ‘নো সিএএ, নো এনআরপি, নো এনআরসি।’ তিনি বলছেন, “অসমের মেয়েদের দুর্দশা শোনার পরে মেয়েদের নড়েচড়ে বসার সময় এসেছে। মেয়েরা এখন দেশ-রাজনীতি বুঝছে। এর চেয়ে পজিটিভ কিছুই হতে পারে না।’’

প্রতিবাদ মঞ্চে ঢোকার মুখেই রাখা হয়েছে বাক্স। “আমি সিসিএ, এনপিআরপি, এনআরসি প্রত্যাখ্যান করছি” লেখায় মুড়ে ফেলা হয়েছে বাক্স। মাঝ বরাবর লেখা ‘আর্থিক সাহায্য।’ এই বাক্স কেন? উত্তরে সুফিয়া বলছেন, “কিছু মানুষ এগিয়ে আসছেন। পাশে দাঁড়াতে চান। গোস্বামীবাবু ও ওঁর এক বন্ধু এসেছিলেন সাইকেলে করে। পকেট থেকে ২০০ টাকা বের করেছিলেন। আমরা কিছুতেই নেব না। কিন্তু তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করা গেল না। বার বার বলছিলেন, ‘ঘর ছেড়ে মেয়েরা কেন বাইরে আসে আমরা বুঝি।’ তাই এই বাক্সের জন্ম।’’

রজনী কম কথা বলেন। গলার জোর সামান্য। তবুও মাইক ধরেছেন। শাসককে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। স্বাধীনতা খুঁজছেন স্বাধীন দেশে! এমন দিনের কথা কি আগে কোনওদিন ভেবেছেন? পাশে বাচ্চা শুইয়ে রেখে বাইশ বছরের রজনীর একটিই কথা—“আমরা এই দেশেরই লোক। আমাদের সকলের কবর যেখানে সেটাই আমার দেশ। আমরা এখান থেকে কিছুতেই যাচ্ছি না।’’ যে মেয়েটি বিশ্বাস করত, মেয়েরা আর কী বা পারে, সে-ও আজ রাস্তায়। শাসকের প্রতি গভীর অবিশ্বাস তাঁর নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। এত দিন স্বামীর সঙ্গে তালাকের কথা জানতেন। দেশের সঙ্গে বিচ্ছেদের প্রশ্ন এই প্রথম! দেশ ও জীবনের সম্পর্কের মাঝে কাঁটাতার বিছিয়ে দেওয়াও প্রথম। শাহিন বাগ, পার্ক সার্কাস, মুর্শিদাবাদ—এ এক ঐতিহাসিক মানব বন্ধন। মুর্শিদাবাদেই তুমুল জোরদার হয় নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। কিন্তু অভিমুখ বদলে যায় বিক্ষিপ্ত ঘটনার আকস্মিকতায়। আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। তার পরে আবার নতুন করে পথ দেখালেন মেয়েরা। ঘরের চৌকাঠ-ছাদ-বারান্দা পেরিয়ে সটান রাজপথে। অগণিত মানুষের পথ চলার মধ্যে নিজেদের প্রতিবাদ জারি রাখছেন তারা। সঙ্গে শামিল করেছেন নিজের সন্তানদের। নিজের দেশ না থাকলে আর জীবন নিয়ে কী হবে!

একতার সুরে বাঁধা পড়েছে দিল্লি থেকে মুর্শিদাবাদ। দিল্লির শাহিন বাগে যেতে পারেননি সুফিয়া-মিলিরা। কিন্তু তাঁদের কথা তো একই। আইন যতই সীমানা টেনে দিক, বিভেদের প্রাচীর তুলে দিক, ঐক্য অটুট রাখতে হাত হাত মেলাতে এ ভাবেই ছুটে আসবেন তাঁরা। এক দিন গুলিয়ে যাওয়া আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়ে নাসিমারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এ ভাবেও শুরু করা যায়। জনজীবন ব্যাহত না করে, মানুষের বিপদ না বাড়িয়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়া যায়। শহরের এক কোণে বসে ঘর সংসারের মতোই গুছিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া যায়। অত্যন্ত নিপাট ভাবে। নিপুণ হাতে। স্বাধীনতা আদায়ের ভাষা অনেক। উপায়ও অনেক। তাই মেয়েদের হাঁটা জারি রয়েছে।

সৎ প্রশ্নের খোঁজে ঘরছাড়া এই নিরপেক্ষ মুখগুলোর হাত ধরার জন্য কোনও দল বা প্রতিষ্ঠান নেই। তবুও ঘরের মেয়েদের এমন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ইতিহাসের পাতা জুড়ে জায়গা করে নেবে নিশ্চিত। একদল মা, একদল মেয়ে, একদল দাদি শীতের রাতে সেই প্রশ্নই খুঁজতে যাপন করছেন পথ-জীবন। এই জীবনটুকুও এই আন্দোলনের মতোই দামি।

শিক্ষক, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Berhampur NRC CAA Shaheen Bagh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE