সময় এগোচ্ছে আর ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি উলটো দিকে হাঁটছে। উনিশ শতকের সমাজও আজকের মতো এতটা পিছিয়ে পড়া ছিল না। আজ এক দল এক্কেবারে পুরনো মনের মানুষ মনে করেন যে ওঁদের ‘নিম্নমুখী চিন্তাধারা’ই সমাজের অন্যান্য মানুষকে মাথায় করে চলতে হবে। অশান্তির মূল কারণ এটাই।
একটা সামান্য ব্যাপার, গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে কী যন্ত্রণা! এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মদ নিয়ে এমনি উত্তেজনা হয়েছিল। সলমন রুশদি ঠিকই ধরেছেন, এ রকম নিচু চিন্তার লোকেরা বেশির ভাগই অশিক্ষিত। গোঁড়ামি তাদের পেয়ে বসেছে আর জেগে উঠেছে ববর্র গুন্ডাবৃত্তি।
ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চরিত্রের অবনতিও দেখছি। এদের বর্বরতা ও অসভ্যতার আগুনে ধর্মের নামে ‘ঘি’ ঝরছে আর আগুন জ্বলছে। সমাজের কাঠামো জ্বলেপুড়ে ছারখার। ধর্ম আর বর্বরতার মিশেল যে অতি ভয়ঙ্করী।
কোনও সভ্য সমাজে কিছু কিছু ব্যাপার পছন্দ না হলেও হজম করে ফেলতে হয়। যেমন, আমি নিরামিষাশী, তাই যে পাত্রে আমিষ রান্না হয় সেই পাত্রে খাব না। কিন্তু কেউ গরুর মাংস খেলে তাকে খুন করতে হবে, এ আবার কী কথা! এই নিয়ে এ দেশে বিরাট উত্তেজনা দেখে দুনিয়া হাসছে।
কুকীর্তির প্রতিবাদে স্বনামধন্য লেখকরা দলে দলে সম্মান ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু এঁদের অনেকেই তো পুরস্কৃত হয়েছিলেন অন্য সরকারের আমলে। তা হলে? বরং, বিজ্ঞানীদের বিরোধিতার রাস্তাটা আমার ভাল লেগেছে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স এবং ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর সদস্যরা কারও নাম না নিয়ে, একজোট হয়ে প্রতিবাদপত্র পেশ করেছেন। সেখানে রয়েছে কবিগুরুর ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ কবিতাটি, ইংরেজিতে। কবি নিজেই কবিতাটি অনুবাদ করে ১৯১২ সালে ‘গীতাঞ্জলি’-তে সংকলিত করেন। তবে বাংলায় একটা তীব্রতা ছিল, তা তিনি নরম করেছিলেন ইংরাজিতে। শেষ পঙ্ক্তিতে কবি লিখেছিলেন, ‘নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।’ ‘নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত’-এরই এখন অসম্ভব প্রয়োজন। এই অধমরা ধর্মের নামে দেশের মুখে কলঙ্ক মাখাচ্ছে। তাদের চরম নির্মম আঘাতই দরকার।
লেখক, কবি, থিয়েটার, সিনেমার মানুষরা একা একা প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু বৈজ্ঞানিকেরা নিজের নাম সামনে না রেখে, একসঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন। ওই নিজেকে জাহির না করাতেই দ্বিতীয় পদ্ধতি হয়তো আরও শক্তিশালী হয়েছে।
এ বারে আসুন বাংলায়। এখানে তো নাকি অর্থনৈতিক উন্নতির কোনও আশা নেই, তার মলিন অবস্থা দেখলে বুক ফাটে। আবর্জনার স্তূপ জমে চারিদিকে। কিন্তু বাঙালি ওই হাফ কাপ চায়েই সন্তুষ্ট। যুগযুগান্তরেও সে তার কৃষ্টির সাধনা থেকে একটুও সরে যায়নি। হয়তো অর্থের অভাবে এখানে কৃষ্টির রূপে অতটা রোশনাই নেই। কিন্তু গ্ল্যামার তো সরাসরি কৃষ্টির অংশ নয়। কৃষ্টির প্রাণভোমরা হল সাধনা। এখানে সংস্কৃতির এমন রমরমা কারণ বাঙালি তাকে চিরকাল বুকে আঁকড়ে পড়ে থেকেছে। যেমন, এই যে দুর্গাপুজোর এত সব বাহারে প্যান্ডাল: এও বাঙালির সৃষ্টিশক্তিরই ফসল। এই বিপুল শক্তি যদি বাঙালি সমাজের অন্যান্য কাজে ছিটেফোঁটাও লাগাত, তা হলে হয়তো সোনা ফলত না, তবে সচ্ছলতা বাড়ত।
তবু, বাকি ভারতবর্ষের এই কর্কশ বর্বরতার প্রেক্ষাপটে, আজ অনেক দিন পরে আমি গর্বিত বাঙালি। গরুর মাংস হোক, শুয়োরের মাংস হোক বা পাঁঠার মাংসই হোক; কে কী খাবে বা খাবে না: তা নিয়ে কোনও দিনই বাঙালির কোনও মাথাব্যথাই নেই। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর মুখেও এক কথা। এই উদারতাই বাংলার জল-হাওয়ার শিক্ষা। সেই খোলামেলা পরিবেশেই বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি এমন সুজলা-সুফলা হয়ে বেড়ে উঠেছে। বাঙালির তো মাছ পেলেই হল। আর প্রতিবাদ বা মিছিল থাকুক রাস্তায় রাস্তায়, হেঁশেলে ও সব ঢুকবে কেন?
ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy