Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
হিন্দুত্বের নীচে দলিত সংকট

বার বার দলিত-ব্যথাতেই এসে ঠেকছেন মোদীরা

বিক্ষিপ্ত সমাজবিরোধিতা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। লেনিনের উপর বুলডোজার চালাতে চালাতে আনন্দক্ষিপ্ত জনতার চিৎকার শোনা গিয়েছে, ‘ভারতমাতা কি জয়!’

অতঃপর: দলিত নেত্রী মায়াবতী কি নরেন্দ্র মোদীর দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে উঠলেন?

অতঃপর: দলিত নেত্রী মায়াবতী কি নরেন্দ্র মোদীর দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ হয়ে উঠলেন?

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০
Share: Save:

এ দেশের ঘটনাবহুল রাজনীতিতেও বেশ নতুন ব্যাপার বলতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যে এত জন ‘নেতা’র উপর বুলডোজার চালানো, হাতুড়ি পেটানো, কালি মাখানো... ত্রিপুরার বিলোনিয়ায় ভ্লাদিমির লেনিন, কেরলের কন্নুরে মহাত্মা গাঁধী, তামিলনাড়ুর তিরুভোত্তিয়ুরে বি আর অম্বেডকর ও ভেলোরে ই ভি রামস্বামী পেরিয়ার, কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, উত্তরপ্রদেশের মেরঠে আর আজমগড়ে অম্বেডকর...

বিক্ষিপ্ত সমাজবিরোধিতা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। লেনিনের উপর বুলডোজার চালাতে চালাতে আনন্দক্ষিপ্ত জনতার চিৎকার শোনা গিয়েছে, ‘ভারতমাতা কি জয়!’ মেরঠে অম্বেডকরের মূর্তির মাথাটা নিপুণ ভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে, ভারতমাতার সন্তানদের পরিচিত কার্যক্রম। বিজেপির নেতারা সমর্থনের সিলমোহর দিয়েছেন। জাতীয় সচিব এইচ রাজা ‘আজকের লেনিন ভাঙা’র খবর পেয়েই ‘কালকের এগিয়ে চলা’র বার্তায় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রবিরোধী র‌্যাডিকাল আদর্শবাদী তামিল নেতা পেরিয়ারের মূর্তিকে এক হাত নেওয়ার ডাক দিয়েছেন। ও-দিকে ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় জানিয়েছেন: এক গণতান্ত্রিক সরকার যা করতে পারে, আর এক গণতান্ত্রিক সরকার তা পালটাতে/ভাঙতেও পারে (হোয়াট ওয়ান ডেমোক্র্যাটিক্যালি ইলেকটেড গভর্নমেন্ট ক্যান ডু, অ্যানাদার ডেমোক্র্যাটিক্যালি ইলেকটেড গভর্নমেন্ট ক্যান আনডু)। কথাটা নিশ্চয়ই গভীর প্রজ্ঞা-উৎসারিত, তবে নিজের রাজ্যে নির্বাচন-পরবর্তী উত্তেজনায় মূর্তি ভাঙা প্রসঙ্গে খোদ রাজ্যপালের এই মন্তব্য অতীব চিত্তাকর্ষক বলতে হবে, বিশেষত ধ্বংসোন্মত্ত জনতার সঙ্গে ‘সরকার’-এর সমীকরণের বিষয়টি।

হুতোমকে স্মরণ করে যদি বলি ‘এই অ্যাক নতুন’, তবে ‘আর অ্যাক নতুন’-এর কথাও না বললে নয়। চার বছরে বিজেপি ভারত আগে এই ভাবে সরকারের উঁচুতম মহল থেকে এত দ্রুত সক্রিয়তা, সজোর ভর্ৎসনা দেখেছে কি? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, সকলে উৎকণ্ঠিত ব্যগ্রতায় শাসন-বার্তা পাঠালেন। দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিলেন, আত্মসংবরণ করতে। রাজ্য সরকারের কাছে নির্দেশ গেল, কড়া হাতে পরিস্থিতি সামলাতে।

হল কী! সংখ্যালঘু নির্যাতন-নিধন, গোরক্ষকদের পিটুনিতে একের পর এক প্রাণঘাত, দেশে ঐতিহাসিক দুর্নীতি-তছরুপ, কোনও কিছুতেই যিনি ভুল করেও রা কাড়েন না— আজ হঠাৎ সব ছেড়ে মূর্তি-দের জন্য তাঁর শাসক-সত্তা এমন উদ্বেল হল কেন?

কারণগুলো গভীর। এবং গুরুতর। কেন যে আজ মূর্তি ভাঙার নৈরাজ্য নিয়ে মোদী ভাবতে বাধ্য হলেন, দ্রুত শাসন করতে চাইলেন— সেই রহস্যের সঙ্গেই আবার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এ বারের সাম্প্রতিক উত্তরপ্রদেশ ভোটের চিত্তাকর্ষক ফলাফলটি। সব মিলিয়েই বোধহয় বিজেপির রাজনীতি আজ এক নতুন পর্বে প্রবেশ করছে।

এত দিন গোরক্ষা তাণ্ডব বা মুসলিমবিরোধী তাণ্ডবের সময় তাঁরা ভাবতেন, বিরোধীরা যতই চেঁচামেচি করুক, এর জন্য রাজনীতিতে তাঁদের তত দাম দিতে হবে না। মুসলমানদের প্রতি সমবেদনায় রাজনৈতিক হিসাবটা পালটাবে না। তাই নিশ্চিন্ত নীরবতায় অবগাহন করার স্ট্র্যাটেজিতে চলছিলেন। মূর্তি ভাঙার কার্যক্রমে কিন্তু তাঁদের নড়ে বসতে হল। সম্ভবত মনে হল যে, মূর্তিঘাতক জনতা যত রকম সেন্টিমেন্টকে আঘাত করছে, তাতে সব মিলিয়ে একটা ভয়ংকর উলটো প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ তো শুধু গোমাংসভক্ষণকারী ম্লেচ্ছদের ব্যাপার নয়, বড্ড বেশিসংখ্যক লোক খেপে যেতে পারে এর ফলে, অনেক রকমের বিরোধিতা ফণা তুলতে পারে।

যেমন, ভারতমাতার গোবলয়-প্রিয় ব্রাহ্মণ্যবাদী রূপটিকে এ ভাবে এক ও একমাত্র হিসাবে তুলে ধরার জন্য পেরিয়ারকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে দৌড়লে ফুঁসে উঠতেই পারেন আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত তামিলরা। দেখাদেখি অন্যান্য প্রদেশেও ছড়াতে পারে বিক্ষোভ। মোদীরা নিশ্চয় মনে রেখেছেন যে, উত্তর-পূর্ব ভারতে তথাকথিত ‘বিজেপি-ওয়েভ’-এর ঠিক আগেই গত কয়েক মাস গোমাংস নিয়ে মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডে বিজেপির বিরুদ্ধে কত ক্রোধ উদ্গারিত হয়েছে, কী ভাবে একাধিক স্থানীয় বিজেপি নেতা দল ছেড়েছেন। অর্থাৎ আঞ্চলিক আবেগকে মূর্তিভাঙার ব্রিগেড যদি আক্রমণ করে, আজকের ‘ওয়েভ’ কালকেই চুপসে যেতে পারে, এমন ভয় হয়তো মোদীর অতি-নির্ভীক অন্তরেও খেলে গিয়েছে। আর একটা কথা আছে। সব হিন্দুরাই নিশ্চয় গোমূত্রসেবক যবন-উৎপাটক হিন্দুত্ববাদীদের কাণ্ডকারখানায় পরিতৃপ্ত নন। আপাতত তাঁরা চুপচাপ থাকলেও গাঁধীর মূর্তির নাক-কান ভাঙা শুরু হলে তাঁরা কি ছেড়ে কথা কইবেন? গোটা ভারত বোধহয় এই মুহূর্তে গাঁধীকে ছেড়ে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মূর্তিতে মালা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়, মোদীও সেটা মানবেন।

সবচেয়ে বড় ভয়— অন্য জায়গায়। ঘটনা ইতিমধ্যেই যতটা এগিয়েছে, তাতে অাকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরছে, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতিতে ভয় উঁকি দিচ্ছে: ওই যেন বিপদ ঘনাচ্ছে ভারতের দলিত আকাশে, বিজেপির ভয়ালতম প্রতিপক্ষ ওই যেন জাগার মুখে। অম্বেডকরের মূর্তি ভাঙা এই প্রথম ঘটল না, একে বিক্ষিপ্ত ঘটনাও বলা যাবে না। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, ৩০ জানুয়ারি হরিয়ানার পালওয়ালে অম্বেডকরের মূর্তির হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, কেউ ধরা পড়েনি আজও। হরিয়ানায়, উত্তরপ্রদেশে, গুজরাতে, সম্প্রতি গোটা দেশ জুড়ে নিয়মিত ভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বাবাসাহেব। সবাই বুঝতে পারছে— না, অম্বেডকর নিজে নন, আক্রমণকারীদের প্রকৃত ও প্রধান লক্ষ্য: তাঁকে যাঁরা নিজেদের আইকন করে তুলেছেন, সেই মানুষগুলো, অর্থাৎ দলিত সমাজ। অম্বেডকরের মূর্তিতে একটা কোপ বসানো মানেই দলিতদের দিকে ছুড়ে দেওয়া উচ্চবর্ণ হিন্দু সমাজের একটা চিঠি। ‘অনেক হয়েছে, এ বার আবার মাথা নিচু করে চলো’— এই বার্তা সেই চিঠিতে। যুগ যুগ ধরে সুবিধা ভোগ করে এসে আজকের ভারতে সংরক্ষণ-নীতির কাঁটায় বা দলিত রাজনীতির বিস্তারের কোপে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ভিতরে ভিতরে কতখানি ক্ষোভে-ক্রোধে জ্বলছেন, নিম্নবর্ণকে কী ভাবে মেরে পিটিয়ে শায়েস্তা করতে চাইছেন— শুধু অম্বেডকর মূর্তির উপর আক্রমণ দিয়েই তার একটা ধারণা তৈরি করা সম্ভব। তাই অন্যদের মূর্তি ভাঙা এক বার, অম্বেডকর বার বার! লক্ষণীয়, এই মার্চেও, উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতে যদি হিন্দুত্ববাদী আক্রমণের কোনও ‘কমন পয়েন্ট’ থাকে, সেটা বাবাসাহেবের মূর্তিই।

এইখানেই বিজেপির সবচেয়ে বড় সংকট, সবচেয়ে কঠিন অন্তর্দ্বন্দ্ব। এক দিকে হিন্দুসমাজের একত্ব নিয়ে ঢাকঢোল পিটানো। আর অন্য দিকে হিন্দুসমাজের অদম্য উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ সংঘাত, যাকে নিজের রাজনীতিতে টেনে আনার উপায় বিজেপির আজও জানা নেই। তাই বিজেপির রাজনীতি যত জোরদার হয়, আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর হয়, সংঘাতও কঠিনতর হয়ে ওঠে, প্রতিঘাত তীক্ষ্ণতর রূপ নিতে থাকে। অম্বেডকরের মূর্তিতে আক্রমণ তারই প্রকাশ। দু’দিন আগের ফুলপুরের উপনির্বাচনের রায়েও সেই প্রতিঘাতের প্রমাণ। উপনির্বাচনের আগে মায়াবতী যে শেষ পর্যন্ত অকস্মাৎ সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে হাত মেলালেন, বিস্তর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা কাটিয়ে অখিলেশ যাদবের পাশে দাঁড়ালেন, তার কারণ বিজেপির বিরুদ্ধে এই ব্যাপক দলিত ক্ষোভ। নব্বই-এর দশক থেকে দীর্ঘ অশান্তি-অসন্তোষের ইতিহাসের পরও দলিতরা যাদবদের সঙ্গে এক মঞ্চে ভোটে লড়লেন, কেননা বিজেপিকে হারানোর শপথ তাঁদের। বিজেপি-দলিত সম্পর্ক এখন এই তলানিতেই।

অথচ বিজেপি নেতারা বলছেন, এই বাস্তব তাঁরা জানতেন না, উপনির্বাচনের ফল নাকি অপ্রত্যাশিত! উত্তরপ্রদেশের গ্রামে গঞ্জে মফস্সলে সবর্ণ বনাম দলিত সংঘাত যে ভাবে তীব্র হচ্ছে, নেতারা তা জানলেও সত্যিই বিষয়টায় এত দিন মন দেননি। কত বড় ভুল করেছেন, আস্তে আস্তে হয়তো তা হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে। মেরঠের যে গ্রামে অম্বেডকরের মূর্তির উপর হানাদারি হল, সেই গ্রামের পঞ্চাশ শতাংশ দলিত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে এ বার তাই একটু নড়ে বসতে দেখা গেল উঁচু মহলকে। মায়াবতী অবশ্য বাঁকা হেসে বললেন, ‘ড্রামা’। খুব ভুল নেই তাঁর কথায়, কেননা, আজও দলিত-আবেগের মেরামতি নিয়ে বিজেপি প্রশাসনের যতটা না দেখানেপনা, কাজের কাজ তার চেয়ে কমই। তাই মেরঠের বিধ্বস্ত মূর্তি মেরামত করতে গিয়ে মহান নেতার আঙুলগুলো লাগানোরও সময় পাওয়া যায় না!

বার বার এই দলিত-ব্যথাতেই এসে ঠেকছেন মোদীরা। মনে পড়ে, গোরক্ষা-তাণ্ডবের সময়েও গুজরাতে গোচর্মব্যবসায়ী দলিতদের দুর্দান্ত বিক্ষোভ যখন পাকিয়ে উঠল, শুরু হল ‘চলো উনা’ মিছিল, ঠিক তার পরই গোরক্ষকদের সাবধান করতে মুখ খুলেছিলেন মোদী, প্রথম বার।

এই গভীর দলিত-ব্যথা কিন্তু তাঁদের পক্ষে কাটানো আজ সহজ নয়। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁদের মারণকাঠি। দলিতরা যদি সত্যিই তাঁদের কল্পিত হিন্দু ভারতের কোলে আসতে রাজি না হন, ভারতমাতার মিথটা তবে ফেঁসে যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার তরী ডুবে যায়। আপাত-তুফানের নীচে দলিত-সংকটের ঘূর্ণিপাক তাই বিজেপিকে এখন অতল তলানিতে টানছে। মুখে দেশের সব মানুষকে এক ভারতমাতার কোলে আনার ঘোষণা, আর মনে উচ্চবর্ণের অসহিষ্ণু দমনপীড়নের উৎকট দাপট— হিসাবটা তো মিলবার কথাই নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE