উ: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি? সকলেই তো দেখেছেন কী ভাবে হয়েছে এ বছরের সমাবর্তন!
প্রশ্ন: ঠিক কী ধরনের সমাবর্তন উৎসবের কথা আপনি বলতে চাইছেন?
উ: পুরনো সমাবর্তনের একটি বিবরণ পাই, ১৯৩৮ সালের— যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে আচার্যের ভাষণ দিয়েছিলেন। ’৫১ সালে পুরনো পদ্ধতির শেষ সমাবর্তন। সেখানে আচার্যের ভাষণ পড়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। যাঁরা স্নাতক তাঁরা সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের হাত থেকে সপ্তপর্ণীপত্র নেন।
’৫২ সালে নতুন পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন হয়। দেশিকোত্তম সম্মানও শুরু হয় সে বছর থেকে। সে বার জওহরলাল নেহরু আসতে পারেননি। এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্বভারতীর পরিদর্শক রাজেন্দ্রপ্রসাদ। স্নাতকেরা রাষ্ট্রপতির হাত থেকেই সপ্তপর্ণীপত্র নেন। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী বা আচার্য না আসার জন্য সমাবর্তনের নির্দিষ্ট দিনের পরিবর্তন হয়নি। আচার্য একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে স্বাধীন ভারতের প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হওয়ার গৌরবের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
প্রতি বছরই ৮ পৌষ, বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠা দিবসে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হত। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের পর জওহরলাল মেয়েকে নিয়ে পৌষমেলায় নাগরদোলা চড়ছেন, এই ছবি দুর্লভ নয়। শুধু তা-ই নয়, আচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আতিথ্য গ্রহণ করে এক বা একাধিক দিন থাকতেন। সন্ধেবেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতেন, ছোটদের সঙ্গে খেলতেন। আনন্দ পাঠশালার শিশুদের নিয়ে বেলুন ওড়ানোর ছবি এখনও আছে। লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গাঁধী, রাজীব গাঁধীও সেই পথেই হেঁটেছেন।
ক্রমশ প্রধানমন্ত্রী-আচার্যের সঙ্গে বিশ্বভারতীর এই যোগ শিথিল হয়েছে। তাঁরা এসেছেন, সমাবর্তন শেষে সে দিনই চলে গিয়েছেন। পরবর্তী কালে সমাবর্তনের দিনও আর নির্দিষ্ট থাকেনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর নিজেদের শর্তে দিন বদলেছে।
প্রশ্ন: নেহরু তো রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন, ফলে তিনি যে আর পাঁচ জন প্রধানমন্ত্রীর মতো শান্তিনিকেতনে আসবেন না, সেই তো স্বাভাবিক!
উ: আমার বক্তব্যও তো তাই! নেহরু নিজেই বলেছেন, শান্তিনিকেতনে এলে তিনি ‘বেটার ম্যান’ হয়ে যান। আচার্যকে অবশ্যই শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর বিষয়ে জানতে হবে। জানতে হবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ বা শিক্ষাদর্শন। নইলে তিনি আচার্য হবেন কী করে? ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, গাঁধীজি শেষ যে বার শান্তিনিকেতনে আসেন, বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি বিদায় নেওয়ার আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ তাঁর হাতে একটি চিঠি তুলে দেন, সেই চিঠিতে তাঁর অবর্তমানে বিশ্বভারতীর প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য গাঁধীজিকে অনুরোধ করেন। গাঁধীজিও তাঁর যথাসাধ্য করার আশ্বাস দেন চিঠিতে। গাঁধীজি চিঠিটি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে দেখান এবং স্বাধীন ভারতে মৌলানা আজাদ যখন শিক্ষামন্ত্রী, গাঁধীজি আবার তাঁকে এটি স্মরণ করিয়ে দেন। সেই সূত্রেই ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেল এবং জওহরলাল আচার্য হলেন। জওহরলাল বরাবরই রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন। ফলে সকলে সানন্দে তাঁকে আচার্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এর ফলে অন্য আর একটি সুবিধাও হয়েছিল। বিশ্বভারতীতে এক সময় অর্থদৈন্যের কারণে রবীন্দ্রনাথকে দ্বারে দ্বারে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আচার্য হওয়ায় সেই সমস্যারও কিছুটা সুরাহা হয়। কিন্তু জওহরলাল কখনও ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে শান্তিনিকেতনে আসেননি। পরবর্তী কালে লালবাহাদুর, ইন্দিরা কিংবা রাজীবও কিন্তু সেই ঐতিহ্য মেনেই এসেছেন। ইন্দিরার সময়েও নিরাপত্তার যে খুব কড়াকড়ি কিছু ছিল, এমন নয়। তবে রাজীব-হত্যার পর এখন আর বলতে পারি না যে, নিরাপত্তা ব্যবস্থার দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী এলে সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সমাবর্তনের সূচি ছোট করে ফেলতে হলে অনুষ্ঠানটির আর অর্থ থাকে না।
প্রশ্ন: তা হলে কি আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে আর আচার্য হিসেবে চাইছেন না?
উ: এটা আমাদের চাওয়া না-চাওয়ার উপর নির্ভর করে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিন বছরের জন্য আচার্য হয়েই গিয়েছেন! ফলে সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁকেই ভাবতে হবে, তাঁর আচার্য থাকা সঙ্গত কি না। মনে করিয়ে দেব মোরারজি দেশাইয়ের কথা। ১৯৭৮ থেকে ’৭৯ পর্যন্ত তিনি আচার্য ছিলেন। তার পর নিজেই বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নন, বিশ্বভারতীর আচার্য হওয়া উচিত কোনও শিক্ষাবিদের। ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে উমাশঙ্কর যোশী আচার্য হয়েছিলেন। এই উপলব্ধিটিই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন, তাঁর বদলে অন্য কেউ আচার্য হলে বিশ্বভারতীর কল্যাণ হবে, তা হলে তাঁকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রশ্ন: দাবিগুলি যদি আর একটু স্পষ্ট করে বলা যায়?
উ: দাবি নয়, প্রস্তাব। প্রথম কথা, সমাবর্তন প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে হোক। তারিখটি আশ্রমের কোনও গুরুত্বপূর্ণ দিন হলে ভাল। প্রধানমন্ত্রীর সময় সুযোগ বুঝে, সমাবর্তনের দিন পরিবর্তন বা নির্দিষ্ট করা সঙ্গত নয়। এ বিষয়ে ১৯৫২ সালে তৎকালীন উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি মন্তব্য মনে করিয়ে দিতে চাই— সমাবর্তনের দিনটি একটি ‘রেড লেটার ডে’। সেই কথাটা যেন আমরা ভুলে না যাই। কিন্তু মুশকিল হল, প্রধানমন্ত্রী আচার্য হলে কোনও দিন বা তারিখ নির্দিষ্ট করা বোধ হয় সম্ভব নয়।
আসলে সমাবর্তন হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্তে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আচার্য হলে তাঁর সুবিধাজনক শর্তে অনুষ্ঠান করতে হয়। সমাবর্তন অনুষ্ঠান তারিখ বা সূচিরও পরিবর্তন করতে হয়, যা বাঞ্ছনীয় নয়।
দ্বিতীয় প্রস্তাব, সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সূচি বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য মেনে সাজানো হবে। সেখানে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর সময় নেই বলে সূচি সংক্ষিপ্ত হবে, এমনটা মেনে নেওয়া যায় না। অনুষ্ঠানের অঙ্গ ছোট হওয়ার জন্য সমাবর্তনের আসল তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ বছর ছাত্রদের কেন ডাকা হল বলুন তো? তাদের তো শূন্য হাতে এবং শূন্য মনে ফিরিয়ে দেওয়া হল। সময় ও নিরাপত্তার কারণে তাঁরা না পেলেন আচার্যের হাত থেকে সপ্তপর্ণীপত্র, না পেলেন উপাচার্যের হাতে চন্দনের ফোঁটা। প্রধানমন্ত্রীর সময় এবং নিরাপত্তার জন্য এমন আপস মেনে নেওয়া যায় না।
সমাবর্তন বিশ্বভারতীর সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। অন্য সমস্ত অনুষ্ঠানের সঙ্গে এর একটি চারিত্রিক তফাত আছে। এই অনুষ্ঠানটি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। এর একটি ভিন্ন রুচি ও পবিত্রতা আছে। যে কারণে, উপাচার্য তাঁর আশীর্বাণীতে বলেন, ‘মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব, আচার্যদেবো ভব’। এই আচার্য হলেন শিক্ষাগুরু। নির্দিষ্ট অধ্যয়ন
শেষে শিক্ষাব্রতী ও শিক্ষাগুরুর সংযোগ ও পরম্পরা প্রতিষ্ঠিত হয় সমাবর্তন মঞ্চে। এখানেই এর সার্থকতা।
প্রধানমন্ত্রী যখন এই পবিত্র অনুষ্ঠানে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে ভিড় জমান কৌতূহলী জনতা এবং রাজনৈতিক মানুষ। সমাবর্তন নয়, প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের লক্ষ্যের বিযয়। ফলে অনুষ্ঠানে প্রত্যাশিত শৃঙ্খলা ও পবিত্রতা বজায় থাকে না। সেই প্রধানমন্ত্রীই বিশ্বভারতীর আচার্য হতে পারেন, যিনি শিক্ষাবিদ বা শিক্ষামনস্ক এবং অবশ্যই রবীন্দ্রমনস্ক। তাঁর সঙ্গে সমাবর্তনে আসবেন তাঁরাই, যাঁরা অনুষ্ঠানের গৌরব বোঝেন।
সবশেষে বলব, এই সমস্ত প্রস্তাব যদি প্রধানমন্ত্রীকে আচার্য রেখেও সুশৃঙ্খল ভাবে পালন করা যেত, তা হলে হয়তো আপত্তির কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অসম্ভব।
সাক্ষাৎকার: স্যমন্তক ঘোষ
আলপনা রায় বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী ও প্রাক্তন অধ্যাপক