১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে রোমের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার আদলে তৈরি হয়েছিল কোচবিহার রাজবাড়ি। প্রধানত ইট-বালি-সুড়কি দিয়ে তৈরি প্রাসাদটি। রোমান গথিক শৈলী ফুটিয়ে তোলা হয় সেই বিশাল প্রাসাদে। চার হাজার মিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে অবস্থিত প্রাসাদটির উচ্চতা ১২৪ ফুট। প্রাসাদের ভিতর রয়েছে শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার ইত্যাদি। তা ছাড়াও, সেখানে দেখতে পাওয়া যায় পুরনো দিনের আসবাব এবং নানা সামগ্রী। কোচবিহারের রাজবাড়ির ইতিহাস জানতে আজও বহু মানুষ ভিড় করেন।
মহারানি গায়ত্রী দেবীর জন্মস্থানও কোচবিহার। রাজাদের সেই যুগ আর নেই। রাজবাড়ি এখন কোচবিহারের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। কোচবিহারের অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশও মুগ্ধ করার মতো। কোচবিহাকে ঘিরে রয়েছে বিস্তর ইতিহাস। কোচবিহারের ‘কোচ’ শব্দটি এসেছে কোচ রাজবংশ থেকে। ‘বিহার’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে। ব্রিটিশ রাজত্ব থেকে শুরু করে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকাল— পুরনো বহু স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে এই জেলা।
কোচবিহার রাজবাড়ি লাগোয়া বিশাল এলাকা জুড়ে দু’দশকের বেশি সময় আগে তৈরি হয়েছিল একটি সুদৃশ্য উদ্যান। আমরা প্রায় প্রতিদিন বিকেলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে একান্তে সময় কাটাতে সেখানে যেতাম। উদ্যানটিতে ঢোকার মুখেই শিশুদের পার্ক। পার্কে খেলাধুলোর সামগ্রীর বেশির ভাগই শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় সব রাইড দিয়ে সাজানো। আনন্দে মেতে উঠত শিশুরা এখানে এসে। হুটোপুটি করে দৌড়ে বেড়াত তারা, পার্কের ধুলোমাখা সবুজ ঘাসের গালিচায় সে কী গড়াগড়ি! কী খুশি হত শিশুরা! চাদর বিছিয়ে বসে সারাদিন হইচই, আড্ডা আর বিকেলে প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া। সেখানে ছিল রং-বেরঙের পাতাবাহার, বিশাল মনোমুগ্ধকর ফুল। লাল, সাদা, হলুদ, গোলাপি বিভিন্ন রঙের ফুল। কালো গোলাপ ফুলও আমরা দেখেছি। প্রচুর গাছপালা, ঝুলন্ত সেতু, ঝিলে নৌকাবিহার। লাল শাপলা, মিউজিক্যাল ফোয়ারা, পাখিঘর, সাপঘর। ঝুমকোলতার নীচে অ্যাকুইয়ারিয়ামে সব ধরনের মাছ রাখা গেলেও সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল গোল্ডফিশ।
এবং থ্রি-ডি সিনেমা। পার্কের একটি বেঞ্চে বসে কত ঝালমুড়ি খেয়েছি সবাই। বাইরে ছিল আখের রস, ঘটিগরম ,ফুচকা, চটপটি, বাদাম, চানাচুর, পাপড়ি চাট, চা-বিস্কুট আরও কত কী!
ওই উদ্যানের আকর্ষণের কারণ ছিল একাধিক। প্রধান আকর্ষণ ছিল মিউজিক্যাল ফোয়ারা। কেউ কেউ বলত— সঙ্গীতজলফোয়ারা। চোখ ধাঁধানো দৃশ্য! ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখতাম! অসাধারণ সব ছবি! স্থানীয়েরা তো বটেই, বাইরে থেকে আসা বহু পর্যটকও টিকিট কেটে এখানে সময় কাটাতেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
সেই উদ্যান প্রায়-বেহাল দশায়! পর্যাপ্ত সংস্কার আর সৌন্দর্যায়নের অভাবে উদ্যানটি ক্রমশ বেহাল হয়ে পড়ায় সেখানে আগের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা কমেছে। এখন আর শিশুদের নিয়ে যাওয়া যায় না। জেলার পর্যটনের মূল আকর্ষণ কোচবিহার রাজবাড়ি ও রাজবাড়ি উদ্যান এবং মদনমোহন মন্দির। কিন্তু সংস্কারের অভাবে উদ্যানের বেহাল দশা।
রাজার শহরেও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে এখন প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলাভূমি, উন্মুক্ত স্থান, খেলাধুলার মাঠ, পার্ক হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ফ্ল্যাটবন্দি জীবনযাপন আর মাঠবিহীন বিদ্যালয়ে শিশুরা হাঁপিয়ে উঠছে। চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে পড়ছে শিশু-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষজন। আমরা খোলা আকাশ দেখতেই পাই না আর এখন। ফ্ল্যাটে ভরে যাচ্ছে রাজার শহর। এই সব ফ্ল্যাট দেখলেই মনে হয়, যেন একেকটা কফিন! ইট-পাথরের শহরে আমাদের প্রতিটি শিশু বেড়ে ওঠে চার দেয়ালের বন্দিশালায়। সভ্যতার ঘেরাটোপে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তারা। মনের ক্যানভাস আজ মার্বেল পাথরের মেঝে, চার দেয়াল আর বিচিত্র সব কার্টুন। শৈশব এখন ব্যস্ত মোবাইল গেমে ব্যস্ত।
কোচবিহার রাজবাড়ি সংলগ্ন উদ্যানটি রাজবাড়ির মতোই ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছে। পর্যটক ও সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ সপরিবার আসতেন ঐতিহ্যবাহী এই পার্কে। কিন্তু উদ্যানটি আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। ক্রমশ সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। আগাছা ঘিরে ধরছে, আলো নেই, সংস্কারে অবহেলা, বড় বড় ঘাসে ঢেকে গিয়েছে গোটা পার্ক। ফলে, ইচ্ছে থাকলেও সেখানে খেলাধুলো করতে পারছে না শিশুরা। ঝিলের ধারে একটু উপরে ঘাসজমিতে মৃত পাতার স্তূপ। এখন আর এখানে শিশুদের নিয়ে যাওয়া আসন দখল করে বসে থাকে প্রেমিক-প্রেমিকারা। কিন্তু এরা সবাই সত্যিই কি প্রেমিক-প্রেমিকা? অভিজ্ঞতা থেকে এ প্রশ্ন করাই যায়। দখল হয়ে গিয়েছে গাছের তলা, ঝোপের আড়াল, ঝিলের পাশ, মাটির টিলার সুড়ঙ্গ, গাছের আড়াল। চলছে অবৈধ কাজ। শহরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এ পার্কটি পরিণত হয়েছে অশ্লীলতা, নোংরামি আর মাদকসেবীদের আখড়ায়। এখন আর কোনও ভদ্র, রুচিশীল মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে আসার সাহস করেন না। পার্কটিতে প্রবেশ করলে চোখে পড়বেই বিব্রতকর পরিস্থিতি। অন্য দিকে, টিকেটের দামও দ্বিগুণের বেশি হয়েছে এখন।
শিশুদের বিনোদনের জন্য পার্ক নির্মাণ করা হয়েছিল এক সময়। এখন সেখানে আর শিশুরা যেতে পারে না। কার্যত দর্শকের ভূমিকায় প্রশাসন। নিশ্চুপ রয়েছে বন দফতর। পার্কে তরুণ-তরুণীদের প্রবেশের ব্যাপারে নির্দিষ্ট নিয়ম করা দরকার। নাগরিকেরা চান, কোচবিহার রাজবাড়ির উদ্যান আবারও হয়ে উঠুক জন-আকর্ষণের অমোঘ চুম্বক।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy