Advertisement
E-Paper

প্রবীণ নাগরিকদের অস্তিত্ব আজ প্রশ্নের মুখে...

এই কঠিন পরিস্থিতিতে, শুধু সরকারি ব্যবস্থার মুখাপেক্ষী না থেকে আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ফোন মারফৎ নিয়মিত খবর রাখতে হবে পরিচিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। এতে তাঁরা মানসিক ভাবে কিছুটা চাঙ্গা থাকবেন।অসুখ এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, দুইই কিন্তু রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়। ফলে, খুব সহজেই প্রবীণেরা সংক্রমণের কবলে পড়েন।

কুহেলী চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২০ ০২:৩০
প্রতিরোধের চেষ্টা। তবু পথে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

প্রতিরোধের চেষ্টা। তবু পথে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

এই মুহূর্তে, পৃথিবী জুড়ে প্রবীণ নাগরিকদের প্রকৃত অবস্থাটা কেমন, ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’ (কোভিড-১৯) এর মারণ থাবা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। খোদ কলকাতাতে, অসুস্থ বৃদ্ধকে ‘করোনা’ আক্রান্ত সন্দেহে মাঝরাস্তায় ফেলে পালালো অ্যাম্বুল্যান্স চালক! আমেরিকা, ইউরোপ, ইংল্যান্ডের মত উন্নত দেশেও এই রোগে আক্রান্ত বয়স্কদের চিকিৎসা আজ ‘লেস প্রায়োরিটি’। মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই নাকি এই ব্যবস্থা! যদিও, ‘ইউনাইটেড নেশনস্’-এর একটি রিপোর্ট বলছে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে প্রতি এগারোজনের মধ্যে একজনের বয়স ছিল ৬৫’র ওপরে, যা মোট জনসংখ্যার ৯%। ২০৫০ এর মধ্যে সেটা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার ১৬% এ। অবশ্য, এরমধ্যে যদি ‘করোনা’র বিজয়রথকে থামাতে পারি আমরা! কেন এই আশঙ্কা, সেটা ‘কোভিড ১৯’ সংক্রমণ নিয়ে প্রকাশিত একটি সংখ্যাতত্ত্ব থেকেই পরিষ্কার। সেখানে দেখছি, ৬০-৬৯ এর মধ্যে যাঁদের বয়স, তাঁদের ক্ষেত্রে এই অসুখে মৃত্যুর হার ৩.৬%। ৭০-৭৯ এই বয়সসীমায় ৮%। অন্যদিকে, ৮০ বছর বা তার উপরে এই হার অনেকটাই বেশি, প্রায় ১৫%। ইতালিতে ‘কোভিড ১৯’এ মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছুঁতে চলেছে! মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স ৭৫ বছরের বেশি। এই ভয়াবহ চিত্রই বলে দিচ্ছে যে, বরিষ্ঠ নাগরিকদের স্বাস্থ্য নিয়ে আলাদা করে ভাববার এবং নীতি নির্ধারণ করার সময় এসে গিয়েছে।

সারা বিশ্বে এই রোগে এখনও পর্যন্ত প্রাণ গিয়েছে ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের। আক্রান্ত তেরো লক্ষাধিক, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রামিতের সংখ্যাও! চিকিৎসা একটাই, লাইফ সাপোর্টে রাখা। উন্নত দেশগুলিতেও অপ্রতুল টেষ্ট কিট, ভেন্টিলেটার সহ নানা অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জাম! সব থেকে ভয়াবহ অবস্থা ইতালির। এই ভাইরাসের সংক্রমণ এবং তজ্জনিত মৃত্যুর নিরিখে ইতালির ঠিক পিছনেই রয়েছে স্পেন এবং আমেরিকা। সম্প্রতি, ত্রিয়েস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপিকা ড. প্যাট্রিসিয়া নিট্টির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজেও একজন ‘মেডিসিনাল কেমিস্ট’। এখন গৃহবন্দি। আশায় রয়েছেন, গরম পড়লে এই মারণ ভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা কমবে! ওঁর কাছেই শুনলাম, ইতালিতে বয়স্ক আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা যথেষ্ট নয়। চিকিৎসার সরঞ্জামও অপ্রতুল। তাই, অল্প বয়সী রোগীদের চিকিৎসায় প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। প্যাট্রিসিয়া ৬০ পেরিয়েছেন, তাঁর মনেও ভয়ের ছায়াপাত! প্রতিষেধক কবে পাওয়া যাবে তার দিশা নেই। এরই মধ্যে, ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)’ ‘প্রিভেন্টিভ মেডিসিন’ হিসেবে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করবার অনুমতি দিয়েছে ‘কোভিড ১৯’এর চিকিৎসায়। আমেরিকাতেও, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এবং অ্যাজিথ্রোমাইসিন ওষুধ দু’টি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই চিকিৎসা কতটা কার্যকর, সময় তার উত্তর দেবে। যদিও, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আগেই প্রমাণিত।

তবে, ‘কোভিড ১৯’এ আক্রান্ত বয়স্কদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা যে বেশ কম, সে ব্যাপারে গবেষক এবং চিকিৎসকেরা সহমত। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে মূলত যে দু’টি বিষয় উঠে আসে, তার একটি হল শারীরিক এবং অন্যটি সামাজিক। জীবানুর স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী ‘করোনা ভাইরাস’ও তাদেরই সহজে কাবু করে, যাদের ‘ইম্যুনিটি’ বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কমতে থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। এছাড়াও, একটা বয়েসের পরে প্রায় প্রত্যেকেই হার্টের সমস্যা, ফুসফুসের অসুখ, ডায়াবেটিস বা কিডনির সংক্রমণে ভোগেন। এসব নিয়ন্ত্রণে রাখতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ‘মেডিকেশনে’ থাকতে হয় তাঁদের। অসুখ এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, দুইই কিন্তু রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়। ফলে, খুব সহজেই প্রবীণেরা সংক্রমণের কবলে পড়েন।

‘করোনা ভাইরাসে’র দ্বারা সংক্রামিত হলে চিকিৎসা করার কোনও ওষুধ এখনও পর্যন্ত নেই। সংক্রমণের পরে প্রথম দু’সপ্তাহ জ্বর বা সর্দি-কাশি ছাড়া তেমন কোনও রোগ লক্ষণও থাকে না। ফলে, রোগ নির্ণয়েও বেশ কিছুটা দেরি হয়ে যায়। অন্যদিকে, রোগ লক্ষণ বিহীন আক্রান্ত মানুষেরা ‘অ্যাসিমটোম্যাটিক ক্যারিয়ার’ হিসেবে আরও অনেকের শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে পারেন নিজেদের অজান্তেই। শেষ মুহূর্তে, নিউমোনিয়ার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এলে ‘ভেন্টিলেশনে’ দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। বয়স্করা সহজেই ‘সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন’-এর কবলে পড়ে মারা যান। আরেকটি ভয়ের বিষয় হল, এই ভাইরাস হার্টেরও ক্ষতি করে। সুতরাং, হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চিনের ‘উহান’ শহরে, যেখান থেকে এই অসুখটি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেখানে একটি ডায়ালিসিস সেন্টারে বেশ কিছু ‘কোভিড ১৯’ আক্রান্ত রোগী হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন। তাঁদের শরীরে নিউমোনিয়ার কোনও লক্ষণ ছিল না।

এই ছোঁয়াচে অসুখে আক্রান্ত মানুষের কাছাকাছি এলেই সংক্রমণের ঘটনা ঘটে। সেটি ঠেকানোর একমাত্র উপায় হল, নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখা। এই উদ্দেশ্যেই, ভারত সহ প্রায় সারা পৃথিবী জুড়েই ‘লক ডাউন’ চলছে। ‘হু’-এর নির্দেশ ‘সামাজিক দূরত্ব’র বদলে ‘পারস্পরিক দূরত্ব’ কথাটি ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু, আমাদের দেশের বয়স্ক মানুষেরা, যাঁদের বড় অংশই ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ নামক বস্তুটি ব্যবহারে অনভ্যস্ত, তাঁদের কাছে এই দু’টি কথাই কি একই ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে না?

বার্ধক্যজনিত কারণে বয়স্কদের শরীর কমজোরি হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কও আর আগের মত সচল থাকে না। এর ফলে, তাঁরা বাড়িতেই থাকুন বা বৃদ্ধাবাসে পরিপার্শ্ব থেকে এমনিতেই কিছুটা বিছিন্ন হয়ে যান। বেঁচে থাকবার জন্য অন্য কারও সাহায্য ছাড়া এঁদের এক মুহূর্তও চলে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে এখন বার্ধক্যও অনেক প্রলম্বিত। স্বাভাবিক ভাবেই, অসুখবিসুখের সম্ভাবনাও বেশি। নিয়মমাফিক ডাক্তার দেখানো, ওষুধপত্রের জোগাড় রাখা জরুরি। আজকাল, প্রায় সব বাড়িতেই অথর্ব মানুষটিকে দেখভালের জন্য ভরসা ‘সেন্টার’ থেকে নিয়োজিত সহায়িকারা। যাঁদের সন্তানসন্ততি প্রবাসী, সেই সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের তো বাইরের লোকের ওপর ভরসা করেই দিনাতিপাত করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে, নাটকীয় ভাবে ‘ঘর বন্দি’র ঘোষণা মানুষকে ন্যূনতম প্রস্তুতিরও সময় দেয়নি! জনবিচ্ছিন্ন হয়ে কি ভাবে দিন কাটবে, এই আতঙ্কেই কতজন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! আগে হয়তো ওষুধের দোকানে ফোন করলে ইমার্জেন্সি ওষুধপত্র বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা হত। এখন, লোকের অভাবে সে রাস্তা বন্ধ। সেই সঙ্গে রয়েছে পেট ভরানোর চিন্তা! প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ‘অনলাইনে’ কেনবার উপায় থাকলে কিছুটা সুরাহা মিলত। আপাতত, সেই পরিষেবাও স্তব্ধ। কারণ, ‘ডেলিভারি বয়’ অমিল। শারীরিক অসুস্থতা আর মানসিক চাপের জোড়া ধাক্কা সামলাতে না পেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বয়স্কদের হাসপাতালে কে নিয়ে যাবে, সেটাও তো বড় প্রশ্ন! সুতরাং, সুস্থ থাকবার জন্য যে জনবিচ্ছিন্নতা, তাই প্রবীণ নাগরিকদের কাছে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে!

আশার কথা, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে মানুষের কাছে খাদ্যদ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেবার চেষ্টা চলছে। দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য এ অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কোথাও কোথাও, স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে গ্রামের বা পাড়ার সুস্থ ও সক্ষম ছেলেদের নিয়ে দল তৈরি করা হয়েছে। তারা জরুরী প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাহায্য করবে! তবে চিন্তার বিষয় হল, এর ধাক্কায় বেশকিছু জরুরি পরিষেবা প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে! যেমন পুরসভা বা গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির মশা নিধনের কাজ, পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এই সুযোগে, যদি ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, টাইফয়েডের মত পরিচিত অসুখেরা জাঁকিয়ে বসে, তাতেও কিন্তু বয়স্ক মানুষদের জীবনহানির সম্ভাবনা বাড়বে। সুতরাং, বহুমুখী সাবধানতা অবলম্বন করবার সময় এসেছে।

এই অভূতপূর্ব সঙ্কটে, শুধু সরকারি ব্যবস্থার মুখাপেক্ষি না থেকে আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ফোন মারফৎ নিয়মিত খবর রাখতে হবে পরিচিত বৃদ্ধবৃদ্ধাদের। এতে তাঁরা মানসিক ভাবে কিছুটা চাঙ্গা থাকবেন। ‘কোভিড ১৯’ প্রতিরোধের সরকারি নির্দেশাবলি তাঁদের নিয়মিত ভাবে জানানো এবং বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। ছোটখাটো অসুখবিসুখে পরিচিত ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে আমরাই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারি ওঁদের। মোদ্দাকথা, এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কালেও ‘দ্য কি ইজ কমিউনিকেশন...’ এই আপ্তবাক্যটি ভুললে কিন্তু চলবে না!

লেখক গবেষক, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, মতামত নিজস্ব

Coronavirus West Bengal Senior Citizen Health
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy