Advertisement
E-Paper

মানুষ মরলে লজ্জার কী

মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ভয়াবহ। আরও ভয়ানক এই উপলব্ধি যে, তা ব্যতিক্রম নয়। সমানে ঘটে চলেছে। এক-এক দিন শোরগোল হলে সামনে আসে দু’একটা দৃষ্টান্ত।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০

এক একটা মুহূর্ত আসে, যখন লজ্জায় মাথা আপনিই ঝুঁকে যায়। চিকিৎসক পিতা যে মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন, তারই ইমার্জেন্সি যখন তাঁর গুরুতর আহত পুত্রকে বিনা চিকিৎসায় ফিরিয়ে দিল, সে তেমনই মুহূর্ত ছিল। কোন যন্ত্রণায় সুজিত বিশ্বাস বলেছেন তিনি পেশাটাই ছেড়ে দিতে চান, টের পাওয়া যায়।

আরও কত জন এমন বেদন বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন? বছর চারেক আগে একটি মেডিক্যাল কলেজের অস্থিবিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসক হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাঁরই ইচ্ছায় আনা হয় তাঁর মেডিক্যাল কলেজে। ইমার্জেন্সিতে তিন ঘণ্টা ছিলেন, প্রাণদায়ী চিকিৎসা কিছুই পাননি। বেসরকারি হাসপাতালে যেতে যেতেই শেষ।

মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ভয়াবহ। আরও ভয়ানক এই উপলব্ধি যে, তা ব্যতিক্রম নয়। সমানে ঘটে চলেছে। এক-এক দিন শোরগোল হলে সামনে আসে দু’একটা দৃষ্টান্ত।

কেন এই দুর্দশা? মরা মাছের মতো কারণগুলো ভাসছে উপরে।

ইমার্জেন্সিতে কে প্রথম দেখেন রোগীকে? নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষানবিশ ডাক্তার, বা ইনটার্ন। খাতায়-কলমে তাঁরা অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শাগরেদ। বাস্তবে তাঁরাই সব। প্রয়োজনে ইনটার্ন ডাকতে পারেন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্র, কিংবা রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসারকে। কিন্তু পাবেন কোথায়? গোটা সকালটা ‘পিজিটি’ বা ‘আরএমও’ থাকেন আউটডোরে। কলবুক পাঠিয়ে ডেকে আনতে হয়। নইলে রোগীকে পাঠাতে হয় আউটডোরে।

সেখানে লম্বা লাইন। ইমার্জেন্সি থেকে রেফার-করা রোগীকে আগে দেখার কোনও নিয়ম নেই। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজের চেস্ট বিভাগের আউটডোরে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল শ্বাসকষ্টে-ভোগা আদিত্য সিংহকে। অবনতি হওয়াতে ফের পাঠানো হয় ইমার্জেন্সিতে। তিনশো মিটার দূরে ইমার্জেন্সি, রোগী পথেই শেষ। তার পর ডাক্তারদের মারধর।

ওই রোগীকে আউটডোরে পাঠানোই উচিত হয়নি, একান্তে বলছেন বড় ডাক্তারেরা। তা বলে ইনটার্নদের দোষ দিচ্ছেন না। দোষ সিস্টেমের।

‘সিস্টেম’ অতি বিচিত্র বস্তু। তার উৎস খানিক সরকারি বিধি-নির্দেশে, খানিকটা দীর্ঘদিনের প্রথায়, কিছুটা সিনিয়র-জুনিয়র বোঝাপড়ায়, বাকিটা রাজনীতির অঙ্কে। সিস্টেম মেডিক্যাল অফিসারদের নিয়োগ করে ইমার্জেন্সিতে, একই সঙ্গে ঠিক করে দেয় যে তাঁরা করবেন কেরানিগিরি। রোগীর গায়ে আঙুলটি না ঠেকিয়ে, কেবল নথিপত্র লিখে, সই করে ডিউটি শেষ হয়। যেখানে ডাক্তারের আকাল, সেখানে ডাক্তার কেন ডাক্তারি করে না? সিস্টেম।

অথচ ইমার্জেন্সি চিকিৎসা মানেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। ‘কোন রোগীর শ্বাস সচল রাখতে তখনই টিউব পরাতে হবে, বুঝতে হবে। কী করে টিউব পরাতে হয়, জানা থাকতে হবে। নইলে রোগী সেখানেই মারা যাবে,’ বললেন এক শিক্ষক। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেবে কে? যদি বা কেউ বোঝে টিউব পরানো চাই, হয়তো দেখা গেল টিউব রয়েছে আলমারিতে, চাবি মেট্রনের কাছে। সিস্টেম।

এই ভাবেই ঠিক হয়ে যায়, দু’জন নার্স থাকবেন, কিন্তু চেয়ার-টেবিলে। রোগীর পাশে নয়। চুক্তিতে নিয়োগ হবে গ্রুপ ডি, কিন্তু আকছার ট্রলি ঠেলবেন রোগীর আত্মীয়। খাতায় কলমে যথেষ্ট ট্রলি থাকবে, কিন্তু খাবি-খাওয়া রোগীকে বলা হবে, ‘ট্রলি সব বেরিয়ে গিয়েছে। ফিরলে পাবেন।’ ইমার্জেন্সি থেকে আইসিইউ, সিসিইউ এতই দূর, নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা এমনই, যা দেখলে তাজ্জব হতে হয়।

সিস্টেমের সুবাদে টাকা দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা ডিজিট্যাল এক্স-রে মিলে যায়, কিন্তু বিনাপয়সার সাধারণ (অ্যানালগ) এক্স-রে মেলে বিকাল পর্যন্ত। সন্ধ্যা চারটের পর এলে প্রবল পেট-যন্ত্রণার রোগীও আলট্রাসাউন্ডের জন্য অপেক্ষা করে সারা রাত, যদি তার ছ’শো টাকা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকে। যে-সব পরীক্ষা না হলে ইমার্জেন্সি চিকিৎসা হয় না, অথচ ইমার্জেন্সিতে যে সব পরীক্ষা মেলে না চব্বিশ ঘণ্টা, তার তালিকা এক হাত লম্বা।

এই ছবি শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, প্রায় সব রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজে। কারণ সিস্টেমের গলদটা সর্বত্র এক। হাতে-গোনা দু’চারটি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়া কোথাও ‘ইমার্জেন্সি মেডিসিন’ বিষয় হিসাবে পড়ানো হয় না। পশ্চিমবঙ্গে ক’টা কলেজে পড়ানো হয়? শূন্য।

তাই ইমার্জেন্সি বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট শিক্ষক, রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার, পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্র, কিছুই নেই। ইমার্জেন্সি হল ‘ভাগের মা।’ মেডিসিন এবং সার্জারি বিভাগে যাদের যে-দিন রোগী ভর্তি, তারা সে-দিন ইমার্জেন্সি সামলান। ইনটার্নদের পালা দু’মাসের। ইমার্জেন্সিতে ডিউটি শুরুর আগে তাঁদের সে-বিষয়ে ট্রেনিংও দেওয়া হয় না। দেখতে দেখতে শিখে যাবে। কী শিখছে, দেখার দায়িত্ব কার? কারও নয়। ভুল করলে যদি রোগীর ক্ষতি হয়? হবে। হচ্ছেই তো।

সিস্টেম বটে। যে বিভাগ সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন রোগীকে নিয়ে কাজ করে, তার জন্য সর্বদা-নিয়োজিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ‘টিম’ নেই। নবজাতকদের ইউনিটে এখন নিজস্ব ডাক্তার-নার্স সর্বক্ষণ আছে। ইমার্জেন্সিতে নেই। শিশুমৃত্যু বাড়লে রাজ্যের রিপোর্ট কার্ডে লাল দাগ পড়ে। ইমার্জেন্সিতে মৃত্যুর হিসাব তলব করে না কেউ। যেহেতু ‘ইমার্জেন্সি মেডিসিন’ পড়ানো হয় না, মেডিক্যাল কাউন্সিলও পরিদর্শনে আসে না। কী ব্যবস্থা থাকার কথা, কী আছে, কেউ খতিয়ে দেখে না।

বিলেত-আমেরিকায় এটা অকল্পনীয়। সেখানে ‘অ্যাডভান্সড ট্রমা লাইফ সাপোর্ট’ রপ্ত করে তবে ইমার্জেন্সিতে কাজ করেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা। নার্সরাও এত অভিজ্ঞ, যে ভুল ধরিয়ে দেন ডাক্তারদের। আপৎকালীন চিকিৎসায় যা কিছু প্রয়োজন, সব মেলে ইমার্জেন্সি বিভাগেই। ডাক্তাররা নিয়মিত পর্যালোচনা করেন, কী চিকিৎসা হওয়া উচিত ছিল, কী হয়েছে। এ দেশে মূল্যায়ন করবে কে? মেডিক্যাল কলেজে ইমার্জেন্সির দায়িত্বে আছেন সুপার। তাঁর সময় কই?

প্রবীণ চিকিৎসকদের আক্ষেপ, তাঁদের ছাত্রাবস্থার থেকে কমেছে আজকের ইমার্জেন্সির মান। রোগীর চাপ বেড়েছে, কমেছে অভিজ্ঞ, দক্ষ মেডিক্যাল অফিসার। উচ্চতর ডিগ্রি না থাকলে ডাক্তারদের পাঠানো হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজের বাইরে। যাঁরা থাকছেন, তাঁরা যোগ্যতার বিচারে থাকছেন না অপর কোনও বিচারে, কেউ জানে না। হাউসস্টাফ থাকা আবশ্যক নয়, তাই জুনিয়র ডাক্তার কমেছে।

ডাক্তার কম, তা একশো বার সত্যি। তা সত্ত্বেও পরিষেবা আরও দ্রুত ও দক্ষ করা যেত, যদি প্যারামেডিক ও নার্সদের আরও ট্রেনিং দিয়ে উপযুক্ত করা যেত, যদি তাঁরা দায়িত্বের ভাগ নিতেন। তা হয় না, তার একটা কারণ সরকারের ঔদাসীন্য। অন্য কারণ ডাক্তারদের সংগঠনের নেতাদের সংকীর্ণতা। ‘আরও ডাক্তার নিয়োগ করা চাই,’ এই স্লোগানের বাইরে তাঁরা বেরোতে পারেন না।

ডাক্তার মার খেলে এই নেতারাই চেঁচান, সব দোষ কি ডাক্তারের? না, দোষটা সিস্টেম-এর। কিন্তু চিকিৎসকেরা সেই সিস্টেম-এর প্রধান এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার সুবিধা তাঁরাও ভোগ করেন। ইমার্জেন্সি চিকিৎসা কেমন হওয়া উচিত, হাজার খামতি সত্ত্বেও কতটা উন্নত কাজ করা যায়, তা তাঁরা খুবই জানেন। কিন্তু তবু কিছু পরিবর্তন করার ঝুঁকি নেন না।

এ রাজ্যে কোনও কলেজ-ইউনিভার্সিটির স্বাতন্ত্র্য নেই, মেডিক্যাল কলেজের তো আরওই নেই। গোটা কতক চিকিৎসক-নেতার অঙ্গুলিহেলনে গোটা ব্যবস্থা চলছে। যেমন বাম জমানায়, তেমনই তৃণমূল জমানায়, এই নেতারাই কার্যত সিস্টেম। তাদের কলমের আঁচড় কলকাতা থেকে নর্থ বেঙ্গলে বদলি করে ডাক্তারদের। সেই শাসানির সামনে চিকিৎসকের শিক্ষা-অভিজ্ঞতা-হাতযশ সব এলেবেলে। একটা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে ধমকানোর সাহস নেই বিভাগীয় প্রধানের। টেকনিশিয়ানের কাজে ফাঁকি ধরতে পারেন না সুপার। ‘যেমন চলছে চলুক’ বলে ঝুঁকি এড়ান তাঁরা। বাড়ে রোগীর প্রাণের ঝুঁকি।

ইমার্জেন্সিতে রোগী কেন মরে? কারণ শীর্ষ হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায়, বিলম্বিত চিকিৎসায় রোগী মরলে তৃণমূল নেতারা লজ্জিত হন না। ঠিকই। মানুষ মরছে, তাতে লজ্জার কী আছে?

medical colleges Emergency Treatment Death Patients
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy