Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ভ্রম সংশোধন

একটি দিঘি, নিতান্ত মামুলি। তাহাকে কেন্দ্র করিয়া একফালি রাস্তা। বাহিরে, প্রাচীরের ধার ঘেঁষিয়া একের পর এক দোকান, ফুটপাথ বহু পূর্বেই যাহার দখলে গিয়াছে।

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

একটি দিঘি, নিতান্ত মামুলি। তাহাকে কেন্দ্র করিয়া একফালি রাস্তা। বাহিরে, প্রাচীরের ধার ঘেঁষিয়া একের পর এক দোকান, ফুটপাথ বহু পূর্বেই যাহার দখলে গিয়াছে। সম্মুখের রাস্তাটির এক প্রান্তে হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ, তাহার পর দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়, দুইটি স্কুল। আশেপাশের এলাকায় আরও কলেজ আছে, স্কুলও আছে। একমুখী রাস্তাটিতে যানজট প্রাত্যহিক ঘটনা।— ভিন্‌গ্রহ হইতে কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী যদি পৃথিবী পর্যবেক্ষণে আসে, তবে কলেজ স্কোয়ার সম্পর্কে তাহার খাতায় সম্ভবত এই কয়টি কথাই লেখা থাকিবে। কারণ, কলেজ স্কোয়ার বলিতে শুধু এইটুকুই বোঝায়। শ্যামল চক্রবর্তী আদি বামপন্থী নেতারা আর যাহা লইয়া হা-হুতাশ করিতেছেন, সবই আরোপিত। নাগরিক বোধের অভাব যদি ঐতিহ্য হয়, তবে সেই ঐতিহ্যকে কলেজ স্কোয়ারের ঘোলা জলে বিসর্জন দেওয়াই বিধেয়। ঐতিহ্য বলিতে যে ইতিহাসের কথা কেহ সরাসরি, কেহ ঘুরপথে মনে করাইয়া দিতে চাহেন, তাহা বহুলাংশে লজ্জার। হিংসাত্মক আন্দোলনের, ধ্বংসের। সেই ইতিহাসের কি সত্যই আর পুনরাবৃত্তি প্রত্যাশিত? বরং, বিজেপি-র সাম্প্রতিক মিছিলটির কথা ভাবিলে ভাল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন যে আকৃতি লইয়াছে, তাহাতে কোন মিছিল ঠিক কী পরিণতিতে পৌঁছাইবে, অনুমান করা দুষ্কর। যে অঞ্চলে এতগুলি স্কুল-কলেজ আছে, সেখানে এই ঝুঁকি লওয়া প্রশাসনিক ভাবে অনুচিত। বরং, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাবটি ভাবিয়া দেখা যাইতে পারে— ওই সংকীর্ণ পরিসরে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দেওয়া যায় কি না, তাহা বিবেচনা করা কর্তব্য।

প্রশ্নটি মাপে কলেজ স্কোয়ারের চাইতে বড়। শহরের পরিসরটিকে কী ভাবে দেখা হইবে, বৃহত্তর প্রশ্ন তাহাই। রাজধানী শহরে রাজনৈতিক কার্যক্রমও থাকিবে, তাহা প্রত্যাশিত। কিন্তু, সেই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য যদি হয় রাজপথের দখল লইয়া শহর অচল করিয়া দেওয়া, তবে ভাবিয়া দেখা ভাল। যাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর বর্তমান সিদ্ধান্তে চটিতেছেন, তাঁহাদের মতে কলেজ স্কোয়ার হইতে ধর্মতলা অবধি মিছিলের প্রকৃত গুরুত্ব কী? রাস্তাটি দৈর্ঘ্যে খুব বেশি নহে, কিন্তু শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। ফলে, ওই পথে মিছিল করিলে অল্প পরিশ্রমেই শহর স্তব্ধ করিয়া দেওয়া যায়। ইহার অধিক আর কি কোনও গুরুত্ব আছে? কলেজ স্ট্রিটের আন্দোলনের দুর্ভাগ্যজনক স্মৃতিবিলাসকে তাঁহারাই রাজনীতির মোড়কে বেচিতে চাহেন, যাঁহাদের নিকট বর্তমান বা ভবিষ্যতের কোনও অস্ত্র নাই। ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা করিলে তাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানাইয়া নূতন পরিসর খুঁজিতেন— শহরকে বিপর্যস্ত না করিয়া যে পরিসরে রাজনৈতিক প্রদর্শনী সম্ভব।

কলেজ স্কোয়ারে মিটিং-মিছিল বন্ধ করিবার সিদ্ধান্তটি প্রকৃত প্রস্তাবে একটি ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের চেষ্টা। শুধু বামপন্থীদের ভুল নহে, শুধু ইতিহাসের ভুল নহে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজেরও ভুল। যে নন্দীগ্রাম আন্দোলন তাঁহাকে শেষ অবধি নবান্নের শীর্ষতলের অধিকার দিয়াছে, ভুলিলে চলিবে না, একটি স্থানীয় গোলমাল হইতে তাহার রাজ্যব্যাপী বিস্তারের পিছনে ২০০৭ সালের নাগরিক সমাজের মিছিলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং সেই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন না বটে, কিন্তু তাহার ‘সুফল’ হইতে তিনি বঞ্চিত হন নাই। সেই মিছিলটিও কিন্তু কলেজ স্ট্রিট হইতেই শুরু হইয়াছিল। তিনি যে নিজের ভুল বুঝিয়াছেন, তাহা রাজ্যের নিকট সুসংবাদ। শহরকে নিজের ছন্দে চলিতে দেওয়া যে প্রশাসনিকতার একটি প্রাথমিক দায়িত্ব, মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়াছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বাধিনায়িকাও বুঝিয়াছেন কি? রাজ্যবাসী তেমনটিই বিশ্বাস করিতে চাহিবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE