Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2018

গণতন্ত্রের অবক্ষয় কোনও এক দিন দলতন্ত্রকেও আঘাত হানে

তৃণমূল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক অভিনব ব্র্যান্ড ইক্যুইটির মাধ্যমে এক নিজস্ব উপভোক্তা তৈরি করেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালতৃণমূল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক অভিনব ব্র্যান্ড ইক্যুইটির মাধ্যমে এক নিজস্ব উপভোক্তা তৈরি করেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

ভোট প্রচারে তৃণমূল কর্মীরা। ফাইল চিত্র।

ভোট প্রচারে তৃণমূল কর্মীরা। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৮ ০০:০৩
Share: Save:

জেএনইউ-তে রাজনৈতিক গবেষণায় ব্যস্ত শৌনক দাস। সে দিন আলাপ হল। শান্তিনিকেতনের ছাত্র। আপাতত এখানে গবেষণা করছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির এক অভিনব বিষয় নিয়ে। বিষয়টা হল: পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল কী ভাবে নির্বাচনে জয়লাভের এক অভিনব মেথডোলজি, যাকে বলে রণকৌশল রচনা করেছে। অতীতে সিপিএম আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মাধ্যমে আর আজ তৃণমূল কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক অভিনব ব্র্যান্ড ইক্যুইটির মাধ্যমে এক নিজস্ব উপভোক্তা তৈরি করেছে। এই উপভোক্তাই হল ভোটার। এরা অনুগত প্রজা। এরা ভক্ত। এরা বেনিফিশিয়ারি। পার্টিকেন্দ্রিক রাজনীতির এই আধিপত্য কম-বেশি সব রাজ্যেই হয়তো আছে, তবে অন্য রাজ্যে সেগুলি কোথাও জাতপাতভিত্তিক, কোথাও ধর্মভিত্তিক। পশ্চিমবঙ্গে অনেকটাই দলতন্ত্রকেন্দ্রিক।

শৌনকের গবেষণার বিষয়টিতে বেশ উৎসাহ পেলাম। ভাবছিলাম, এই প্রবণতা কি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে? বোধহয় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যে, গণতন্ত্র সঙ্কটের আবর্তে প্রকৃত উন্নয়ন স্তব্ধ হতে বসেছে। কিন্তু শাসক দলের নেতার পদ্ধতির উপর নতুন-নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। বিদেশে বলা হচ্ছে, এ হল ‘পোস্ট ট্রুথ পোস্ট ফ্যাক্ট’ যুগ। তাই রেটোরিক্স, অপটিকস— এ সব শব্দ এখন খুব জনপ্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন সদ্য হয়ে গেল। এই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথম প্রশ্ন হল, কেন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এত আলোচনা। প্রথমত, রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সেই ষাটের দশক থেকে গ্রামীণ এলাকায় হিংসা— এ এক অন্যতম উপাদান হয়ে গেছে। জাতপাত বা ধর্মীয় মেরুকরণ নয়, প্রথম থেকেই রাজ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ অনেক বেশি।

দলীয় বা পার্টিকেন্দ্রিক রাজনীতির সঙ্গে গণকেন্দ্রিক বা জনতার রাজনীতিরও একটা যোগাযোগ গড়ে উঠছে। সংগঠিত দলীয় রাজনীতির প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের সমাজে আক্ষরিক অর্থেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রকাশ করেছে। একে অনেক রাজনীতি বিজ্ঞানী প্রশাসনিকতার বিস্তার পর্ব বলেও অভিহিত করেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘The Politics of the Governed’ গ্রন্থে বলেছিলেন, নিম্নবর্গের শ্রেণিগুলির জীবনকে প্রভাবিত করতে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনেকটাই সফল হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের ত্রিস্তর ব্যবস্থাকে সফল ভাবে কার্যকর করা, তার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি সংস্কার করা, এটা ছিল তৎকালীন শাসক দল সিপিএমের দারুণ কৌশল। সিপিএমের দলতন্ত্র পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় করেছে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে সেলাই মেশিন কে পাবে আর কে পাবে না, তা-ও তো ঠিক হত পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। ’৮৪ সালের কথা। তখন সাংবাদিকতায় সবে প্রবেশ করে জেলায় জেলায় ঘুরতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখতাম। আইআরডিপি প্রকল্পের টাকা কেন্দ্র থেকে রাজ্য হয়ে জেলা পরিষদের সভাধিপতির মাধ্যমে পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে যেত। আমরা বলতাম, নিম্নবর্গের ক্ষমতায়ন। এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাই ছিল সিপিএমের লোকাল কমিটি-জোনাল কমিটি।

ভোট-সন্ত্রাসের চিত্র। ফাইল চিত্র।

মানুষ সিপিএমকে পরিত্যাগ করার পর মমতা ক্ষমতায় এলেন। কিন্তু মমতার কোনও আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নেই। কিন্তু গত সাত বছরে বোঝা যাচ্ছে, মমতাই এই তৃণমূল যুগে জ্যোতি বসু-অনিল বিশ্বাস, দুটোই। মমতারও দলীয়তন্ত্র আছে। মমতাই সেখানে রেজিমেন্টেশন।

মমতা মতুয়া সম্প্রদায়, মুসলমান-ওবিসি সম্প্রদায়, গ্রামীণ কৃষক, সরকারি শিক্ষক, কর্মচারী ও বেকার যুব সম্প্রদায়, গরিব মানুষ— নানা বর্গে, নানা স্তরে নিজের দলীয় পরিসর গঠন করেছেন। এমনকী দলীয় ক্লাবগুলি পর্যন্ত বহু গ্রামে লোকাল কমিটির মতো কাজ করে। এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়লাভ ও গ্রামাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ মমতার ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের জন্যই বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। মমতার রাজনীতি আর জনতার রাজনীতি চিরকালই মিশেছে। এই মিডিয়া যুগে মিশছে আরও নতুন ভাবে। পার্টি সংগঠনের হাল বিস্তার বা নেটওয়ার্ককে রক্ষা করা শাসক দলের বড় কাজ।

গণউদ্যোগ বিরোধী দলের শক্তি। শাসক দলতন্ত্রের হাল ছিন্ন করে দেয় মানুষের উদ্যোগ। কিন্তু শাসক দল থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও গণউদ্যোগ রাষ্টের আওতামুক্ত শেষ পর্যন্ত হতে পারে না। বিরোধী দলতন্ত্রেও গণউদ্যোগ অবরুদ্ধ হয়। এ হল প্রকৃতির নিয়ম। অতীতে সিপিএম যুগেও রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসা ছিল অন্য সব রাজ্যের চেয়ে বেশি। এ বার প়ঞ্চায়েত নির্বাচনেও বীভৎস হিংসা দেখলাম। আগের ভোটে কত জন মারা গেছেন, এ বার তার চেয়ে সংখ্যা বেশি না কম, এ সব তুলনামূলক আলোচনায় যেতে চাই না। শুধু বলতে পারি, রাজনৈতিক হিংসা দলতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখে। আবার নির্বাচনী জয়ের কৌশলে দলতন্ত্রর জাল গুরুত্বপূর্ণ। তবে গণতন্ত্রের অবক্ষয় কোনও এক দিন দলতন্ত্রকেও আঘাত হানে। তাই সাধু, সাবধান!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE