Advertisement
E-Paper

পরিবর্তন

বছর কুড়ি পূর্বেও অবস্থা এমন আতঙ্কের ছিল না। তখন আশ্বিন মাস পড়িলেই নীলাকাশে পেঁজা তুলার মতো মেঘেরা জানান দিত, মা আসিতেছেন।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০

নবমী নিশি ফুরাইয়াছে। সপ্তাহব্যাপী উৎসবেরও সমাপ্তি ঘণ্টা বাজিয়া গিয়াছে। দেবী দুর্গার বিদায়কাল আসন্ন। দিনকয়েক মর্তধামে কাটাইবার পর তাঁহার কৈলাশে ফিরিবার পালা। ঘরে ফিরিয়া আসিবে উৎসব-বিমুখ শহরবাসীরাও, যাঁহারা শান্তির খোঁজে, কিছু দিনের জন্য পাড়ি জমাইয়াছিলেন অন্য রাজ্যে, অন্য দেশে। তাঁহাদের সবাই যে ঘোর নাস্তিক এবং দেবদেবীর আরাধনা লইয়া এহেন বাড়াবাড়িতে বীতশ্রদ্ধ হইয়া শহর ছাড়িয়াছিলেন, তাহা নহে। আবার সকলেই যে প্রবল ছুটি-প্রত্যাশী, এবং দিনকয়েক একটানা ছুটি হাতে পাইয়া, তাহার সদ্ব্যবহারের সাধু উদ্দেশ্যে বেড়াইতে চলিয়াছেন, তাহাও নহে। অনেকেই আছেন, যাঁহারা শহর হইতে এই কয়েক দিন পলায়ন করিতে চাহেন, উৎসবের তাড়না এড়াইবার অভিপ্রায়ে। তাড়না, কারণ বঙ্গে এখন উৎসব একাকী আসে না। তাহার দোসর হয় মধ্যরাত্রে বাইকবাহিনীর তাণ্ডব, পক্ষকালেরও অধিক সময় ধরিয়া চলা তীব্র যানজট, মহালয়া হইতে পথেঘাটে উপচাইয়া পড়া ভিড় এবং অত্যাবশ্যক পরিষেবার তীব্র আকাল। ইহা কোনও এক বৎসরের খণ্ডচিত্র নহে। বরং সময় যত গড়াইতেছে, উৎসবের দাপট তত বাড়িতেছে। সুতরাং তিক্তবিরক্ত মানুষের শহর ছাড়িবার পাল্লাও যে ক্রমশ ভারী হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী!

অথচ বছর কুড়ি পূর্বেও অবস্থা এমন আতঙ্কের ছিল না। তখন আশ্বিন মাস পড়িলেই নীলাকাশে পেঁজা তুলার মতো মেঘেরা জানান দিত, মা আসিতেছেন। অমাবস্যায় দেবীপক্ষের তর্পণ-শেষে বাঙালি মানসিক প্রস্তুতি লইত উৎসবের, বোধনে ঢাকের কাঠি পড়িলে ধীরে ধীরে প্যান্ডেলমুখী হইতে শুরু করিত এবং অষ্টমী-নবমী রাতে দর্শনার্থীর বান ডাকিত। তাহার পর শহর অনেক রাজনৈতিক, আর্থিক পরিবর্তনের সাক্ষী হইয়াছে। সামাজিক ক্ষেত্রেও সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমশ মানব-মন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর ইহাদের মাঝে পড়িয়া দুর্গোৎসবের সেই মধুর সুরটি উধাও। পূজার যানজট এখন শুধুই পূজার মাসটিতে হয় না। তাহার শুরু মাঝ-শ্রাবণ হইতেই। কারণ, তখন ছাড়ের মরশুম। অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত বাঙালির পূজার কেনাকাটার শুরু। যানজটেরও শুরু। থিম পূজার দৌলতে বহু পূর্বেই রাস্তা আটকাইয়া পড়ে বাঁশের বেড়াজালে। এবং চার দিন নহে, বাঙালি এখন ঠাকুর দেখিতে শুরু করে মহালয়া শেষ হইলেই। নবমীর রাত্রি নহে, বিখ্যাত পূজায় তৃতীয়ার সন্ধ্যায় দর্শনার্থীর লাইন পড়ে, চতুর্থীর বিকালে পদপিষ্ট হইবার উপক্রম হয়। এক কথায়, এই পূজায় হুজুগ আছে, আনন্দও আছে, কিন্তু সঙ্গে তীব্র বিরক্তিও আছে। বিরক্তি, পূজার মহিমা লোপ পাইবার। বিরক্তি, উৎসব-শরীর হইতে মার্জিত রূপটি সম্পূর্ণ খসিয়া পড়িবার। এবং বিরক্তি, উৎসবের আনন্দ প্রায় সম্পূর্ণত হুজুগপ্রিয় মানুষের কুক্ষিগত হইয়া পড়িবার।

অথচ, উৎসবের প্রকৃত অর্থ তো কোনও বিশেষ এক শ্রেণির মানুষের কুক্ষিগত হইয়া পড়া নহে। সে তো এক মহামিলনের মঞ্চ, সকলকে সঙ্গে লইয়া চলিবার অঙ্গীকার করে। তাহাতে আমোদপ্রিয় মানুষও যেমন শামিল হইয়া থাকে, শান্তিপ্রিয় মানুষও তেমনই। তাহাতে উগ্রতা থাকিতে পারে, কিন্তু কমনীয়তাও পাশাপাশিই থাকিবে। অন্যথায় তাহা আর উৎসব থাকে না। বিশৃঙ্খল হুজুগে পরিণত হয়। আশঙ্কার কথা হল, দুর্গাপূজার চরিত্রটিও ক্রমশ সেই দিকেই অগ্রসর হইতেছে। তাহা সহ্য করা মুশকিল। শান্তিপ্রিয় মানুষের শহর-ত্যাগের অন্যতম কারণও ইহাই। তাঁহারা এই পরিবর্তনটির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াইতে পারেন না। পরিবর্তন ভাল। কিন্তু পরিবর্তন-সর্বস্বতার আড়ালে মূল চরিত্রটি চাপা পড়িয়া গেলে, সে বড় বেদনার। শারদোৎসব সেই দিকে দ্রুত না গেলেই মঙ্গল।

Durgapuja Tradition
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy