Advertisement
E-Paper

চাই অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞান

সরকার অবশ্য সে যুক্তি মানতে রাজি নয়। গত কাল সরকারি উদ্যোগে দেশ জুড়ে ‘কালো টাকা বিরোধী দিবস’ পালিত হল।

পিনাকী চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
অহেতুক: নোট বাতিলের পর এটিএম-এর সামনে দীর্ঘ লাইনে গোটা দেশে প্রাণ হারিয়েছিলেন একশোরও বেশি মানুষ। ছবি: প্রেম সিংহ

অহেতুক: নোট বাতিলের পর এটিএম-এর সামনে দীর্ঘ লাইনে গোটা দেশে প্রাণ হারিয়েছিলেন একশোরও বেশি মানুষ। ছবি: প্রেম সিংহ

নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর এক বছর কেটে গেল। লাভ-ক্ষতির হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সময়। কেন নোট বাতিল করা হচ্ছে, সরকারের তরফে তার চারটে কারণ শোনা গিয়েছিল— এক, কালো টাকা ধ্বংস করা; দুই, আরও বেশি ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে নগদহীন অর্থনীতির পথে বেশ কয়েক কদম হাঁটা; তিন, নকল নোট ঠেকানো; এবং চার, সন্ত্রাসবাদীদের হাতে টাকার জোগান বন্ধ করা। নোট বাতিলের সাফল্য বিষয়ে সরকারি বক্তব্য আর সাধারণ মানুষের ধারণায় যে ফারাক থাকবে, সেটা বোঝা কঠিন নয়। ব্যাংকের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার বাধ্যতা কি ভোলার? না কি, নগদের অভাবে অর্থনীতি কতখানি ধাক্কা খেয়েছিল, সে কথা? নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণার ঠিক পরেই যে তিন মাসের হিসেব পাওয়া গিয়েছিল, তাতে জিডিপি-র বৃদ্ধির হারের গায়ে বিশেষ আঁচ লাগেনি। কিন্তু, গত ত্রৈমাসিকে এই হার সটান ৫.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, এটা নোট বাতিলের প্রত্যক্ষ প্রভাব।

সরকার অবশ্য সে যুক্তি মানতে রাজি নয়। গত কাল সরকারি উদ্যোগে দেশ জুড়ে ‘কালো টাকা বিরোধী দিবস’ পালিত হল। আর বিরোধীরা পালন করলেন ‘কালো দিন’। একই ঘটনা নিয়ে যখন মতামতের মধ্যে এমন আকাশপাতাল ফারাক, তখন তার সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব কষার কাজটা নেহাত সহজ নয়। একটা চেষ্টা করে দেখা যাক।

নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর অনেকেই অনুমান করেছিলেন, বাতিল ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের একটা বড় অংশ রিজার্ভ ব্যাংকে ফিরে আসবে না। সেই টাকা না ফেরা মানেই হিসেবের বাইরে থাকা (অর্থাৎ কালো) টাকা অর্থনীতির বাইরে চলে যাওয়া। দীর্ঘ নীরবতার পর রিজার্ভ ব্যাংক জানাল, বাতিল হওয়া নোটের কত জমা পড়েছে। দেখা গেল, টাকা না ফেরার অনুমানটি সম্পূর্ণ ভুল। যত টাকা বাতিল হয়েছিল, কার্যত তার সবটাই ব্যাংকে জমা পড়ে গিয়েছে। এই ঘটনার দুটো ব্যাখ্যা সম্ভব। এক, গোটা দেশে নগদে যত কালো টাকা ছিল, তার গোটাটাই যাতে ব্যাংকে জমা পড়ে যেতে পারে, এমন একটি পথের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে; অথবা দুই, যতটুকু কালো টাকা বাজারে ছিল, মোট নগদের তুলনায় তার পরিমাণ নগণ্য।

তবে, ব্যাখ্যা যা-ই হোক না কেন, পরিণতি হল, যেহেতু বাতিল হওয়া নোটের প্রায় পুরোটাই ব্যাংকে জমা পড়ে গিয়েছে, ফলে আগে যে টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে ছিল, এখন তার ওপরেও ব্যাংককে সুদ দিতে হচ্ছে। স্বভাবতই ব্যাংকগুলোর খরচও বেড়েছে। যত নগদ জমা পড়ল, তার একটা অংশ যে গোলমেলে, তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু, সেই টাকার উৎস সন্ধান করা খুব কঠিন। কিন্তু, সেই কঠিন কাজটাই করতে হবে— অবিলম্বে, এবং নির্দিষ্ট সময়ের মেয়াদ বেঁধে দিয়ে। জমা পড়া টাকার কতখানি সাদা, আর কতটা কালো, গোটা দেশকে সেই হিসেব জানাতেই হবে। না হলে, ডিমনিটাইজেশনের গোটা প্রক্রিয়াটাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। অহেতুক মানুষকে বিপুল দুর্ভোগের মুখে ফেলা। আজ যদি সরকার সাদা টাকাকে কালো টাকা থেকে আলাদা না করতে পারে, তাতে কালোবাজারিরা আরও সাহস পেয়ে যাবে।

নোটবাতিলের ধাক্কায় যখন নগদ অমিল, কাঁচা টাকায় লেনদেন কার্যত স্তব্ধ, তখন মনে হয়েছিল, মানুষ এ বার বাধ্য হয়েই ডিজিটাল লেনদেনের পথে হাঁটবেন, এবং সেটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়াবে। প্রত্যাশাটা যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল, তা নয়। সত্যিই ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। ডিমনিটাইজেশনের আগে যত পয়েন্ট অব সেল মেশিন ছিল, তার সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু, প্রত্যাশা শুধু সেটুকুই ছিল না। ভাবা হয়েছিল, নগদহীন অর্থনীতির পথে হাঁটা মানে আসলে ভারতীয় অর্থনীতির যে ঢিলেঢালা, কাঠামোহীন ভাব, সেটা থেকে এক লাফে একটা আঁটসাট ব্যবস্থায় পৌঁছনোরও ব্যবস্থা করে ফেলা। এখানেই বোঝার ভুল। অর্থনীতির মধ্যে আঁটসাট কাঠামো তৈরি করার কাজটা এক লাফে হওয়ার নয়। ওটা একটা প্রক্রিয়া। দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্র সম্পূর্ণতই নগদ টাকার ওপর নির্ভরশীল। নগদের জোগান এক ধাক্কায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রও শুয়ে পড়েছিল। এই ক্ষেত্রের ওপর নোটবাতিলের সম্পূর্ণ প্রভাবের মাপ এখনও আমরা জানি না। জিডিপি পরিসংখ্যানের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, কারণ জিডিপি-তে অসংগঠিত ক্ষেত্রের হিসেব কষা হয় সংগঠিত ক্ষেত্রের পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে। ভারতের অসংগঠিত ক্ষেত্র সত্যিই কতখানি ধাক্কা খেল, সেটা বোঝা যাবে দীর্ঘমেয়াদে— চাকরি চলে যাওয়া এবং জীবনজীবিকায় প্রভাবের মধ্য দিয়ে।

রিজার্ভ ব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো থেকে স্পষ্ট, নোটবাতিলের আগে ভারতের বাজারে মোট যত নগদ টাকা ছিল, তার ৯০ শতাংশ ইতিমধ্যেই বাজারে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, নোটবাতিলের ফলে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ খানিক বাড়লেও ভারতের নগদ-নির্ভরতা কমেনি। কিন্তু, নগদের অভাব তৈরি হওয়ায় অর্থনীতির গায়ে, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে, প্রবল ধাক্কা লেগেছে। ভারতের মোট কর্মসংস্থানের ৯০ শতাংশই হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ফলে, সেই ক্ষেত্রটিতে রক্ত ফিরিয়ে আনার জন্য যে নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন, এখনই তা করতে হবে। সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি-র অনুমান, ‘২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ভারতে প্রায় পনেরো লক্ষ চাকরি গিয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে মোট ৪০ কোটি ৬৫ লক্ষ চাকরি ছিল। পরের তিন মাসে সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৫০ লক্ষে।’ এই হিসেব নিতান্তই প্রাথমিক। হিসেবটি নিয়ে অনেক রকম প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে, পাশাপাশি যদি মনে রাখা যায় যে সাম্প্রতিক কালে এনআরইজিএ-র কাজের চাহিদা বেড়েছে, তা হলে বোঝা যাবে, সত্যিই অসংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরির ওপর নোটবাতিলের প্রভাব পড়েছে।

তবে, জিডিপি-র ওপর নোটবাতিলের কী প্রভাব পড়ল, তা নিয়ে যে আলোচনা চলছে, আমি বলব, তাতে তথ্যের চেয়ে অনুমানের ভাগ বেশি। এবং, সরকারের প্রতি অকারণেই একটু বেশি কঠোর। অর্থনীতিতে হরেক ঘটনা ঘটেই চলেছে, এবং জাতীয় আয়ের ওপর তার প্রভাবও পড়ছে কম-বেশি। ফলে, নোটবাতিলের প্রভাব কতখানি, সেটা আলাদা করে বলা সহজ কাজ নয়। বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে অনীহা বেশ কিছু দিন ধরে তৈরি হয়েছে, তার ফলে আয়বৃদ্ধির হার যে কমবে, সেটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। অনাদায়ী ঋণের চাপে ব্যাংকগুলোর যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সেটাও এক বিরাট সমস্যা। এগুলোর সঙ্গে তো নোটবাতিলের যোগ নেই। বলতে পারেন, নোটবাতিল এই ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে। আর্থিক বৃদ্ধির নিম্নগামী হারকে আরও দ্রুত তলানিতে নিয়ে গিয়েছে। আশার কথা হল, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এমন কিছু সিদ্ধান্তও হচ্ছে। যেমন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিতে দুই লক্ষ কোটি টাকারও বেশি নতুন মূলধনের জোগান দেওয়া হয়েছে, জিএসটির করের হার এবং কাঠামোকে পুনর্বিবেচনা করার কথাও বলা হচ্ছে। আশা করি, অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞান রাজনীতিকে পথ দেখাবে এবং ভারত যত দ্রুত সম্ভব ফের আর্থিক বৃদ্ধির চড়া হারের কক্ষপথে ফেরত আসবে।

দিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি-তে অর্থনীতির শিক্ষক

Economy Indian Economy Demonetisation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy