Advertisement
২৫ মার্চ ২০২৩

একটি মোরগের ডাকস্বাধীনতা

মরিসের মালকিনের নাম করিন ফেঁসোঁ। তাঁর পাশের বাড়িতে থাকেন লিমোজেসের এক দম্পতি, জিন লুই বাইরন এবং জোই আঁদ্রিয়েউস্ক। গ্রীষ্মাবকাশ যাপনের জন্য তাঁরা এই সাড়ে ছ’হাজার বাসিন্দার ছোট্ট এলাকায় একটি বাড়ি কিনে রেখেছেন।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

ওলেরঁ পশ্চিম ফ্রান্সের অতলান্তিক মহাসাগরের উপকূলের কাছে এক দারুণ সুন্দর দ্বীপ, দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একটি সেতুর বন্ধনে আবদ্ধ। বনভূমি, বালিয়াড়ি, সমুদ্রতট সব মিলিয়ে এই মনোরম স্থানটি ফরাসিদের অবকাশ যাপনের প্রিয় জায়গা। সম্প্রতি এই দ্বীপের খুব নাম হয়েছে মরিসের জন্য। মরিসের ডাক-স্বাধীনতার দাবিতে সরব হয়েছিল ফ্রান্স। গত ৫ সেপ্টেম্বর আদালত রায় দিয়েছে, মরিস মরিসের মতোই থাকবে এবং ডাকবে। তাকে চুপ করাবার অধিকার কারও নেই। মরিস একটি মোরগ।

Advertisement

মরিসের মালকিনের নাম করিন ফেঁসোঁ। তাঁর পাশের বাড়িতে থাকেন লিমোজেসের এক দম্পতি, জিন লুই বাইরন এবং জোই আঁদ্রিয়েউস্ক। গ্রীষ্মাবকাশ যাপনের জন্য তাঁরা এই সাড়ে ছ’হাজার বাসিন্দার ছোট্ট এলাকায় একটি বাড়ি কিনে রেখেছেন। গত পনেরো বছর গরমের সময় এখানে এসে তাঁরা নিরিবিলিতে সময় কাটান। ২০১৭ সাল থেকে তাঁদের শান্তিতে কাঁটা হয়েছে করিনের মোরগের বাসা। মরিস নাকি সক্কালবেলা ঠিক ছ’টায় উঠে তার মাথার লাল ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে, গলা তুলে এবং ফুলিয়ে ‘ককর ক’ গান শুরু করে। ব্যস, ঘুমের দফা রফা। কুড়ি সেকেন্ড পর পর সে সরব হয়, ডাক চলে ছ’টা কুড়ি পর্যন্ত। বিরক্ত দম্পতি আদালতের

এক কর্মচারীকে এনে প্রথমে মরিসের ডাক শুনিয়ে তাঁকে দিয়ে মধ্যস্থতা করাতে চেয়েছিলেন। ব্যর্থ হয়ে শেষে মামলার দিকেই এগোলেন। মরিসকে প্রাণে মারতে হবে না। তাকে গ্রেফতার করে এলাকা ছাড়া করলেই চলবে।

শুনে তো করিনের মাথায় হাত। বললেন, “আমি উদ্বিগ্ন, মরিসও অবসাদগ্রস্ত।” সে নাকি হতাশ হয়ে ডানা ঝাপ্টায়, হাঁপায়। তার নাকি ‘ভীষণ চাপ’। মরিসকে কোলে নিয়ে করিন অনেক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বারংবার বলেছেন, “মোরগের অধিকার আছে মনের ভাব প্রকাশ করার।” তাঁর বক্তব্য, মোরগ-অলঙ্কৃত চার্চের ঘণ্টা যদি প্রত্যহ সকালে ঘণ্টা ধরে বাজতে পারে, জ্যান্ত মোরগ বেচারা মরিস নিয়ম মাফিক প্রভাতসঙ্গীত গাইতে পারবে না কেন? করিনের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়র ক্রিস্তোফার সুয়ের বলেছেন, “আমাদের, ফরাসিদের একটা ধ্রুপদী মূল্যবোধ আছে আর আমাদের উচিত তাকে রক্ষা করা।” সেই মূল্যবোধ বলে, খামারের পশুদের ভাল রাখতে হবে। ওলেরঁ’তে এলে তার প্রকৃতিকে গ্রহণ করতে হবে। বাইরে থেকে আসা “অল্পসংখ্যক মানুষ তাঁদের যাপন শৈলী আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।” এটা মানা যায় না।

Advertisement

ফ্রান্সে এর আগে গরুর ডাক, এমনকি গরুর গলার ঘণ্টাধ্বনি বন্ধ করতেও মামলা হয়েছে। কিন্তু একটি মোরগের ডাক দেওয়ার অধিকারের জন্য যে আইনি লড়াই এবং হইচই হল, তার দৃষ্টান্ত ছিল না। এক লক্ষ চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষ মরিসের সঙ্গীতের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন। প্রতি এক হাজার ফরাসি নাগরিকের মধ্যে অন্তত দশ জন মরিসের সমর্থক। বিদেশ থেকেও সমর্থন এসেছে ভূরিভূরি। ‘জাতীয় বিষয়’ মরিসের যখন খুশি, যেখানে খুশি, যেমন করে খুশি ডাকার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। এমনই সব দাবিতে সরব হল জনগণ, মিডিয়া। পার্লামেন্টের এক সদস্য মনে করালেন, মোরগ হল তাঁদের জাতীয় ঐতিহ্য, ফ্রান্সের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে পর্যন্ত মোরগের গুরুত্ব রয়েছে।

কেন একটি মোরগের দুঃখ সমগ্র ফ্রান্সকে এতখানি বিচলিত করল? এর মূলে রয়েছে শহর থেকে আগত মানুষজনের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ মানুষের বহু কালের বিরোধ। ফ্রান্সের গ্রামে গ্রামে কৃষির ঐতিহ্য। সরল, অন্য রকম এক গ্রামীণ জীবনে শান্তি খুঁজতে এসে নগরসভ্যতায় অভ্যস্ত মানুষজন গ্রামকেই বিপন্ন করে তোলেন বলে অভিযোগ। তাঁরা গ্রামে বাড়ি কেনেন, ছুটি কাটান কিন্তু গ্রামের বাস্তবতাকে মানতে পারেন না। গ্রামের একটা নিজস্ব রূপ আছে, রস ও গন্ধ আছে। তার পশুপাখি, পোকামাকড়, তাদের ডাকাডাকি, তাদের চলাফেরা সমস্তটাই সেই অন্য রকম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শুধু গ্রামের শান্তি, গাছপালা ঢাকা পথ,

ছায়ায় ঘেরা কুটিরই তার শেষ কথা নয়। মরিসের ডাকও সেখানকার যাপনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপচার। গ্রামের সেই নিজস্ব শব্দ, গন্ধ, সৌন্দর্যকে মেনে না নিয়ে তাকে বদলাতে যাওয়াটা গ্রামবাসীরা ভাল চোখে দেখেন না। তাই করিনের পাশে তাঁরাও দাঁড়িয়ে গিয়েছেন।

গত জুন মাসে মামলা হয়েছিল। সম্প্রতি আদালতের রায় বেরিয়েছে। সেই রায় বলছে, মরিসের ডাক থামানো চলবে না। এক হাজার ইউরো পুরস্কারও জুটেছে এই ভাগ্যবান মোরগের কপালে।

আমরা গরিব দেশের মানুষ। আমাদের হাজার সমস্যা। মোরগের ডাক নিয়ে মামলা করা এবং মোরগের অধিকার নিয়ে মামলা লড়া আমাদের হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু যদি একটু খতিয়ে দেখি, দেখব প্রকৃতির উপর ভোগবাদী মানুষের চিরন্তন সদম্ভ নিপীড়নের এ-ও এক উদাহরণ হতে পারে। এ দেশের গ্রামজীবন, পর্বত, বনভূমির সত্যতা এবং স্বচ্ছতার বুকেও যে প্রকাশ্য এবং অদৃশ্য আমাজন-জ্বালা থাবা বসাবার জন্য ওত পেতে আছে, অনেক পরিবেশকর্মীই কিন্তু সে বিষয়ে আমাদের সচেতন করে চলেছেন। সারা বিশ্বময় নিসর্গের পরিবারে নগরসভ্যতার দৈত্যের হানা আজ এক করুণ বাস্তবতা। তাই আমরা সকলেই অপেক্ষায় রইলাম সেই সকাল ছ’টার। মরিস লাল ঝুঁটি নাড়িয়ে, গলা ফুলিয়ে আমাদের কৃত্রিম সমস্ত শব্দকে ছাপিয়ে গেয়ে উঠুক “ককর ক...”।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.