E-Paper

‘অন্যান্য’-র অন্তর্দ্বন্দ্ব

ঝাড়খণ্ডী জনজাতির একটি বড় অংশ যে ভাবে হিন্দু-ইসলাম-খ্রিস্টান-শিখ-বৌদ্ধ-জৈনদের পাশাপাশি নিজেদের একটি পরিচিতির দাবি তুলে ধরেছেন, তা নিশ্চিত ভাবেই ধর্মীয় পরিচিতির দাবি।

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৫ ০৫:৩২
দাবি: আত্মপরিচয়ের খোঁজে ঝাড়খণ্ডে সারনা অনুসারীদের মিছিল। ২৬ মে, রাঁচী।

দাবি: আত্মপরিচয়ের খোঁজে ঝাড়খণ্ডে সারনা অনুসারীদের মিছিল। ২৬ মে, রাঁচী। ছবি: পিটিআই।

ক’দিন আগে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জেলা সদরে জমায়েত আয়োজিত হল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (ঝামুমো)-র ডাকে। শাসক জোটের প্রধান ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার দাবি, লোকগণনায় ধর্মীয় পরিচিতি নথিভুক্ত করার ব্যাপারে সারনা-কে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসাবে রাখতে হবে। সারনা হল সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা, হো, প্রভৃতি প্রায় দুই ডজন ঝাড়খণ্ডী জনজাতি গোষ্ঠীর একাংশের আচরিত ধর্মীয় বিশ্বাস। তাঁদের বিশ্বাস— পাথর, পাহাড়, জল থেকে প্রাণী, উদ্ভিদ, সব কিছুই এই গ্রহের সমান অংশীদার। যা-ই হোক, ঝাড়খণ্ডী জনজাতির একটি বড় অংশ যে ভাবে হিন্দু-ইসলাম-খ্রিস্টান-শিখ-বৌদ্ধ-জৈনদের পাশাপাশি নিজেদের একটি পরিচিতির দাবি তুলে ধরেছেন, তা নিশ্চিত ভাবেই ধর্মীয় পরিচিতির দাবি। প্রসঙ্গত, ১৯৪৭-পূর্ব লোকগণনায় জনজাতির ধর্মীয় পরিচিতির একটি বিভাগ ছিল, স্বাধীন ভারতে তা তুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে লোকগণনায় জনজাতির ধর্মীয় পরিচিতিকে স্থান ‘অন্যান্য ধর্মীয় আচরণকারী’র মধ্যে। সারনা এই ‘অন্যান্য’-র একটি উপবিভাগ। ঝামুমো-র দাবি, সারনাকে ‘অন্যান্য’ বিভাগ থেকে মুক্ত করে একটি পূর্ণত ধর্মীয় মর্যাদা দিতে হবে।

আলাদা রাজ্য গঠিত হয়েছে। ঝামুমো রাজ্যের শাসনক্ষমতাও প্রতিষ্ঠিত। রাজ্য শাসনের পাশাপাশি, দলটির কাছে নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কাজ পড়ে আছে। সেখানে একটি ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে এই আন্দোলনের কারণ কী? কারণটা স্পষ্টত রাজনৈতিক; পাঠক অবগত, রাজনীতি যে-কোনও বিষয়কেই ‘আপন’ করে নেয়। আবার, যেখানে পরিচিতিকে কেন্দ্র করে সাত দশক ধরে আন্দোলন চলেছে, সেই ঝাড়খণ্ডে ধর্মের মতো বিষয় রাজনীতি থেকে বাদ থাকে কী করে? অন্যত্র যেমন ঘটেছে, ঝাড়খণ্ডের রাজনীতিতেও বিজেপির শক্তিসঞ্চয়ে ধর্মই থেকেছে প্রধান সহায়। সুতরাং, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় যদি ধর্মীয় উপাদান সুলভ হয়ে ওঠে, তা হলে ঝামুমো যে সেটা ব্যবহার করবে, সেটা খুব দুর্বোধ্য নয়।

বস্তুত, ঝাড়খণ্ডী পরিচিতির প্রক্রিয়ায় জনজাতি আন্দোলনের সূত্রপাত, পরে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ডী পরিচিতির নির্মাণ, হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ইসাই সব-ঝাড়খণ্ডী-ভাই-ভাই স্লোগানের প্রতিধ্বনি, ইত্যাদির মধ্যেই গড়ে উঠেছে একটি ঝাড়খণ্ডী উপ-পরিচিতি, যা হল সারনা। এটি এক দিকে যেমন জনজাতির মধ্যেকার বিভিন্ন ভাষাগত ও নৃগোষ্ঠীগত ভিন্নতাকে একটি ধর্মীয় সূত্রে একত্র করে ঝাড়খণ্ডী পরিচিতি তুলে ধরা, তেমনই এর মধ্যে দিয়ে এক পক্ষে বিজেপির হিন্দুত্ব ও অন্য পক্ষে জনজাতির খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন রোধেরও একটি উপায় বলে ধরে নেওয়া হল। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার উত্থানের পিছনে আছে জমির লড়াই, মহাজনির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো শ্রেণিগত বিষয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এর নেতারা যেমন শিখেছেন কী ভাবে শ্রেণি ও পরিচিতির লড়াইকে মিলিয়েমিশিয়ে নিয়ে এগোতে হয়। রাজ্যশাসনে তাঁদের ঘোষিত অগ্রাধিকার হল গরিব মেয়েদের আর্থিক ভাবে সক্ষম করে তোলা। আবার জেনেছেন, ঝাড়খণ্ডী পরিচিতিটির মধ্যে জনজাতি পরিচয়টিকে বড় করে তুলে ধরতে, যার নমুনা হল, জনজাতি নেতাদের নামকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রকল্প, ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে স্মরণীয় করে রাখা, বিভিন্ন প্রকল্পে ও সরকারি ঘোষণায় মুন্ডারি-সাঁওতালি-কুরুখ ইত্যাদি ভাষার ব্যবহার। রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং রাজ্যশাসনের অভিজ্ঞতা থেকে, অন্য শাসক দলগুলোর মতো ঝামুমো-ও জেনেছে, শাসনক্ষমতা দখলে রাখতে গেলে কিসের সঙ্গে কিসের, কী পরিমাণ মিশ্রণে রাজনীতির অনুপান তৈরি করতে হয়। তাই, তাদের রাজনীতিতে আপাত দারিদ্র দূরীকরণ বা নারী ক্ষমতায়ন, এবং জনজাতি পরিচিতি যে ভাবে প্রাধান্য পায়, মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার কর্মসূচি তার অণুমাত্রও গুরুত্ব পায় না। সারনা নিয়ে সাম্প্রতিক আন্দোলন এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ।

সারনা নিয়ে রাজনৈতিক দাবি গড়ে উঠেছে অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে। ঝাড়খণ্ডে আলাদা রাজ্যের আন্দোলনের দাবির পাশাপাশি জনজাতিদের নিজস্ব ধর্মীয় পরিচিতি গড়ে তোলার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় ১৯৯০-এর দশকে। লোকগণনার তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯১ সালে যেখানে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের মধ্যে ‘অন্যান্য ধর্মীয় আচরণকারী’র ভাগ ছিল ২৫ শতাংশ, ২০০১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশে। ২০১১-তে সামান্য বেড়ে হয়েছে ৪৬ শতাংশ (সারা ভারতের গড় ৭ শতাংশ)। হয়তো ২০০০ সালে নতুন রাজ্যগঠন এবং তা থেকে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে ঝাড়খণ্ডী পরিচিতি নির্মাণে ধর্মীয় দিকটি ততখানি গুরুত্ব পায়নি। তা সত্ত্বেও, নতুন সহস্রাব্দে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে যে জনজাতির মধ্যে ‘অন্যান্য’রা সংখ্যাগুরু হয়ে উঠলেন, তার মধ্যে সারনা আন্দোলন বিরাট ভূমিকা পালন করেছে: মোট ‘অন্যান্য’-র মধ্যে সারনা-র অংশ প্রায় ৯৫ ভাগ। সারা দেশের হিসাবে ‘অন্যান্য’-র মধ্যে সারনার শতাংশ হচ্ছে ৬২।

তবে বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সারনার গ্রহণযোগ্যতা সমান ভাবে গড়ে ওঠেনি। যেমন, ঝাড়খণ্ডে লোকসংখ্যার দিকে দিয়ে বৃহৎ তিনটি জনজাতি গোষ্ঠী, সাঁওতাল (২৮ লক্ষ), ওরাওঁ (১৭ লক্ষ), এবং মুন্ডা (১২ লক্ষ) জনজাতির মধ্যে সারনা অনুসারীর ভাগ হচ্ছে যথাক্রমে ৩৬, ৬১, ও ৪৯ শতাংশ। বস্তুত, ঝাড়খণ্ডের জনজাতির মধ্যে হিন্দুদের ভাগ যে এখনও ৩৮ শতাংশ, তার একটা বড় অবদান সাঁওতালদের মধ্যে হিন্দু পরিচিতির আধিক্য। এর সঙ্গে শিক্ষাগত অর্জনের একটা সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে: যে গোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার যত বেশি, সেই গোষ্ঠীতে সারনার অনুসরণের হার তত বেশি (ওরাওঁদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৬৭%, যা রাজ্য গড়ের চেয়েও বেশি; মুন্ডাদের ৬৩%, এবং সাঁওতালদের ৫১%)। তবে, এ-বিষয়ে অন্যান্য উপাদানের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। কোনও কোনও লেখক জনজাতি, বিশেষত সাঁওতালদের মধ্যে সারনা অনুসরণে কুণ্ঠার কারণ হিসাবে দেখাচ্ছেন খ্রিস্টধর্মের প্রসার আটকানোর একটা প্রচেষ্টা হিসাবে। তাঁদের মতে, জনজাতিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে সারনা, এই আশঙ্কায় তাঁরা নিজেদের হিন্দু পরিচিতির মধ্যে দিয়ে খ্রিস্ট ধর্মান্তরণ রোধ করতে চান।

মোট কথা, সারনাকে সাংবিধানিক ভাবে একটা ধর্মীয় বিভাগ হিসাবে তুলে ধরার যে চেষ্টা, তা ঝাড়খণ্ডের রাজনীতিতে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে, এবং দেশে যে ধর্মকেন্দ্রিক যে পরিচিতির রাজনীতি চলছে তার বিপরীতে এক বৃহত্তর পরিচিতির নির্মাণে এর গুরুত্ব বিরাট। এই আন্দোলনের এক সফল রাজনৈতিক ব্যবহারের কৃতিত্ব ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার প্রাপ্য। প্রবল প্রতাপশালী বিজেপিকে আটকে হেমন্ত সোরেনের দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসাটা কেবল ‘মাইয়া সম্মান যোজনা’য় মহিলাদের মাসে ২৫০০ টাকা হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে হয়নি, এর সঙ্গে পরিচিতির রাজনীতির ভিন্নতর রূপ নির্মাণেরও ভূমিকা আছে।

তুলনা করা কঠিন, কিন্তু অনুমান করাই যায়, ছত্তীসগঢ়ে জনজাতির ভাগ ঝাড়খণ্ডের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। তাঁরা রাষ্ট্রশক্তি ও বৃহৎ পুঁজির আক্রমণে জেরবার, সেখানে তাঁদের প্রতিরোধের রাজনীতিতে পরিচিতির উদ্ভাবিত রূপ হয়তো বা তাঁদের সহায় হত। জনজাতি ও বৃহত্তর পরিচিতির রাজনীতিতে জনজাতি ধর্মবিশ্বাসের একটি সাধারণ ধারা তুলে ধরতে পারলে, তাঁদের লড়াই হয়তো অন্য মাত্রায় যেত। সেটা হয়নি। ছত্তীসগঢ়ের জনজাতিদের মধ্যে ‘অন্যান্য’-র ভাগ মাত্র ৬ শতাংশ।

রাজ্যে জনজাতিদের মধ্যে বিজেপি যতটা সমর্থন জুটিয়ে নিতে পেরেছে, জনজাতি ধর্ম-পরিচিতির বিকাশ ঘটলে ফল আলাদা হতে পারত। এ রাজ্যে জনজাতির মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশই ‘অন্যান্য’ হিসাবে চিহ্নিত। তাঁদের মধ্যেও দক্ষিণবঙ্গের সাঁওতালদের সংখ্যাধিক্য, উত্তরবঙ্গের ওরাওঁ বা মুন্ডাদের মধ্যে এর প্রভাব তেমন নেই। আবার, সাঁওতালদের মধ্যে যাঁরা অন্যান্য, তাঁদের বড় ভাগটা ‘সারি ধরম’-এর অনুসারী, ছোট ভাগটা সারনার। ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে পরিচিতির ধর্মের যে রাজনীতি ঝাড়খণ্ডে অনুশীলন করা হচ্ছে, তা থেকে যে ‘অন্যান্য’রা কিছু শেখার চেষ্টা করছেন না, তাতে ক্ষতিটা সমগ্র মানব প্রজাতির। বিপন্ন এই গ্রহকে রক্ষা করার ব্যাপারে বিশ্বের জনজাতিরা যে ভাবে পথ দেখাচ্ছেন, সারনা তার একটি অংশ। একে কেবল রাজনৈতিক আয়ুধ ভাবাটা ভুল হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Caste Caste Census Jharkhand

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy