E-Paper

‘না’ বলতে পারার শক্তি

কথাটা আবার মনে পড়ল কিছু দিন আগে একটি বিজ্ঞান শিবির ও আলোচনাচক্রে গিয়ে। কথা হচ্ছিল পরিবেশ নিয়ে এবং অবধারিত ভাবে প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪ ০৯:০৭

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসের নাম না। এই রচনাটির কথা মনে পড়লে, বাংলা শব্দভান্ডারের এই ক্ষুদ্রতম শব্দটির শক্তিকে অনুভব করতে পারি। আর বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে প্রায়ই মনে হয় এই শব্দটির যথার্থ ব্যবহারই আমাদের সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ‘না’ বলতে পারা ও না-পারার উপরেই আমাদের বিবিধ ভাল ও মন্দ নির্ভর করে থাকে।

কথাটা আবার মনে পড়ল কিছু দিন আগে একটি বিজ্ঞান শিবির ও আলোচনাচক্রে গিয়ে। কথা হচ্ছিল পরিবেশ নিয়ে এবং অবধারিত ভাবে প্লাস্টিক ব্যাগ নিয়ে। পাতলা পলিথিন ব্যাগ বহু দিন হল নিষিদ্ধ, কিন্তু এখনও দোকানে সেগুলোর ব্যাপক ব্যবহার হয়; না চাইলেও বিক্রেতারা নিজে থেকেই তেলেভাজা, বাদামভাজা, ডাল, চিনি-ভরা কাগজের ঠোঙাটি যত্ন করে পলিথিনের ব্যাগে বসিয়ে দেন। তাঁরা মনে করেন, এই ‘পরিষেবা’টুকু না দিলে তাঁদের দোকানের খদ্দের কমে যাবে। এই প্রসঙ্গে এক বক্তা বললেন, বিক্রেতা দিতে চাইলেও আমাদের স্পষ্ট ভাবে জোরের সঙ্গে না বলতে হবে; প্রতি দিন অনেক ক্রেতা বার বার প্রত্যাখ্যান করলে আস্তে আস্তে বন্ধ হবে এই ব্যাগের আমদানি এবং উৎপাদন। আমার মনে হল কথাটা খুবই সত্যি এবং অনেকেই যে এই বস্তুটিকে ‘না’ বলতে শুরু করেছেন, তা-ও সত্যি। কিন্তু এটা একটা উদাহরণমাত্র; আসলে আমাদের না বলতে হবে আরও অনেক বিষয়ে।

পঁচিশ বছর আগে বিয়েবাড়ি থেকে আলোচনাচক্র সর্বত্র মাথাপিছু জলের বোতল দেওয়া হত না, বড় জলের পাত্র থেকে পান করতে হত। সে ব্যবস্থা এখনও চালু আছে, কিন্তু প্রতিটি খাবারের প্যাকেটের সঙ্গে ছোট্ট একটি জলের বোতল দেওয়াও ক্রমে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠছে। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ফ্রায়েড রাইস, বিরিয়ানি এখন কাগজের প্যাকেটের বদলে প্লাস্টিকের কৌটোয় আসে, সঙ্গে প্লাস্টিকের কাঁটা-চামচ। মিষ্টির দোকান থেকে দই-মিষ্টিও আসে প্লাস্টিকের কৌটোয়। এই সব কৌটো-বোতল ইত্যাদি দীর্ঘব্যবহার্য তো নয়ই, অপরিহার্যও নয়। তবে এগুলোর জন্য আমাদের কিছুটা সুবিধা হয় মাত্র। এই সুবিধাটুকু ছেড়ে দিয়ে ‘না’ বলার তালিকায় এদেরও ঢুকিয়ে নেওয়া উচিত। কেননা এই বিপুল পরিমাণে ‘ইউজ় অ্যান্ড থ্রো’ সামগ্রীর উৎপাদন ও ব্যবহার যেমন বিপুল পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি করছে, তেমনই তার নবীকরণে (রিসাইক্লিং) প্রচুর পরিমাণে শক্তিও খরচ হচ্ছে। এ ভাবে সস্তায় পাওয়া নিত্যনতুন পোশাক, নষ্টকরা খাবার ও জল, সর্বদা ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাফেরা করা, অহেতুক আলো-পাখা ইত্যাদি চালিয়ে রাখা, ক্ষতিকর অনেক কিছুকেই ‘না’ বলা অভ্যাস করতে হবে।

অর্থাৎ, বিষয়টা শুধু দু’-একটা বস্তু নিয়ে নয়, ‘না’ বলতে পারা একটা সংস্কৃতি, যেটা নিজেকেই গড়ে তুলতে হয়। তার জন্য অনেক সময়ই কিছু ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরে বেরোতে হয়। যেমন, সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার কয়েক দিন পরেই ছিল কালীপুজো ও দীপাবলির রাত। সবিস্ময়ে ও সভয়ে লক্ষ করলাম, বাজি সংক্রান্ত পরিবেশ দূষণের যাবতীয় হিসাব ও নিষেধাজ্ঞাকে গোল্লায় পাঠিয়ে সহনাগরিকেরা উদ্দাম বাজি ফাটালেন। এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুনতে হল, সারা বছর পরিবেশ নষ্ট করে বাচ্চাদের এক দিনের আনন্দ বন্ধ করে কী হবে! যাঁরা সচেতন হয়ে বাজি থেকে দূরে থাকলেন, মাঝরাতে তাঁদেরও হয়তো মনে হল, বাচ্চাদের বঞ্চিত করে শেষ পর্যন্ত কী লাভ হল!

‘না’ বলতে পারার সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব ও সংশয় এখানেই: ‘না’ বলে লাভ কী হল, এই হতাশা। কারণ, ‘না’ বলার মূলে যে স্বার্থ, সব সময় সেটা পলিথিন ব্যাগের মতো ততটা ক্ষুদ্রও থাকে না। আর একক মানুষের স্বার্থত্যাগ খুব চোখে পড়ার মতো অভিঘাতও তৈরি করতে পারে না। অথচ, এই ছোট-বড় ‘না’ বলতে না-পারাই পরিবেশ থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধ, যাবতীয় ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ‘না’ বলার ক্ষেত্রটি শুধু কিছু পাওয়ার বিষয়ে নয়, দেওয়ার বিষয়েও প্রসারিত।

পাওয়ার বিষয়টি বোঝা সহজ। ধরা যাক, প্রোমোটারের লোক আপনার বাড়ির সামনের পুকুর বোজাতে এল, আপনি যাতে প্রতিবাদ বা থানা-পুলিশ না করেন তাই আপনাকে একটা ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রস্তাবও দিল। আপনি ‘না’ বলতে পারলেন না, পুকুর বুজে বহুতল উঠে গেল। তেমনই যে কাজ আপনি করেননি, তেমন কোনও গবেষণাপত্রে বা বইয়ের লেখক-তালিকায় আপনার নাম দিতে চাওয়া হল, আপনিও ‘না’ বলতে পারলেন না। যারা আপনাকে ফ্ল্যাট দিল বা নাম দিল, এর পর তাদের বিরুদ্ধে বা একই ধরনের অন্য কাজের বিরুদ্ধে আপনি আর মুখ খুলতে পারবেন না, সেই উদ্দেশ্যেই এই অযাচিত দান করা হয়েছে। এই ভাবেই প্রতিটি অন্যায় এক-একটা প্রলোভনের রূপ ধরে আসে, যার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, মনে মনে যুক্তি সাজায়— কেন এই প্রস্তাব আসলে ততটা ‘অন্যায়’ নয়। নিজেকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে, একা প্রতিবাদ বা আত্মত্যাগ করে তো কিছু বদলানো যায় না। এ ভাবেই আমরাও ক্রমে জেনে যাই জায়গামতো বন্ধ খাম, কিংবা ‘পেপারে নাম’ দেওয়ার কৌশল। আর এ ভাবেই পাকাপাকি ভাবে কিছু পরিমিতিবোধ ও মূল্যবোধের পতন হয়। মাঝখান থেকে অনুচিত কাজগুলো ঘটতেই থাকে, যার প্রতিফলন দেখা যায় সমাজে। প্রকৃতিতেও। এ ভাবেই ক্রমশ সাফ হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে উত্তরাখণ্ড আর লাদাখের পরিবেশ, যার ফল হল গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে তাপপ্রবাহ, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ি অঞ্চলে হড়পা বান ও বন্যায় ধারাবাহিক ধ্বংসের ছবি।

বহু বছর আগে কোনও একটা পরীক্ষা চলাকালীন একটি বাচ্চা মেয়ে আর একটি মেয়েকে নকল করতে দেখে বলে ফেলেছিল, “তুমি টুকছ কেন?” উত্তরে দ্বিতীয় মেয়েটি বলেছিল, “তুমিও টুকে লেখো না!” যে কোনও অসততার প্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান এই দু’টি বাচ্চার আচরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়— আমাদের হওয়া উচিত প্রথম বাচ্চাটির মতো: আমিও করব না, কাউকে করতেও দেব না। বাস্তবে আমাদের আচরণ হয় দ্বিতীয় শিশুটির মতো: তুমিও করো, আমাকেও করতে দাও। তাই ‘না’ বলতে হলে কারও প্রসারিত হাতের তালুতে ‘স্পিড মানি’ রেখে দেওয়া কিংবা টেবিলের তলা দিয়ে এগিয়ে আসা টাকার বান্ডিল, দুটোকেই ‘না’ বলতে হবে। এবং অবশ্যই ক্ষেত্রবিশেষে উল্টো দিকের মানুষটির মুখে ‘না’ শোনাও অভ্যাস করতে হবে। কাজটা কঠিন। পরীক্ষায় উঁচু নম্বর, প্রতিযোগিতায় পাশ না করেই চাকরি (নিজের কিংবা সন্তানের), অন্যায্য প্রোমোশন, নামডাক ইত্যাদির হাতছানি ছেড়ে দিয়ে আপনি পিছিয়ে পড়লেন আর পাশ দিয়ে বেরিয়ে ঝকঝকে বাড়ি-গাড়ি-কেরিয়ার গড়ে ফেলল ‘হ্যাঁ’ বলা জনগণ, এই পরিস্থিতি মেনে নেওয়া অতটা সহজ নয়।

তা হলে এই স্বার্থত্যাগ বা আত্মত্যাগের জন্য দরকারি মনের জোর আমরা পাব কোথা থেকে? যাঁরা ধর্মভীরু তাঁরা হয়তো পাপকে ভয় পান; যাঁরা ততটা ধর্মভীরু নন, তাঁদের আরও যুক্তিযুক্ত কিছুকে ভয় পাওয়ার আছে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে এটা আত্মত্যাগ নয়, আত্মরক্ষা; এই অন্যায়ের ক্ষতি কোথাও আমাকে এবং আমার সন্তানকেও স্পর্শ করছে এবং করবে। ধারাবাহিক তাপপ্রবাহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাছ লাগানোর কথা ভেবে তাৎক্ষণিক কোনও লাভ নেই; সে জন্য যে অনেক আগে থেকে গাছ কাটা পুকুর বোজানো-সহ অনেক কিছুতে ‘না’ বলতে হত, সে কথা বিশ্বাস করতে হবে (যদিও উষ্ণায়নের কারণ শুধু এইগুলোই নয়)। তাই যে মনের জোরে অচেনা ট্যাক্সিচালক ঠিকানা খুঁজে ফিরিয়ে দিয়ে যান টাকা-গয়না ভর্তি ব্যাগ, সেই সামগ্রিক মূল্যবোধের জোর থেকেই আমাদেরও বলতে হবে, ‘না’

লেখিকা: রসায়ন বিভাগ, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Plastic use

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy