কিছু দিন আগেই ডানলপ বন্ধ হয়েছে। তবে, এত বড় কারখানা, মন তো ঠিক মানতে চায় না। কড়া সত্যের সামনেও প্রাণপণে একটা মায়া আয়না ধরে রেখে দিতে চায় তারা, যাদের গেল। তাই সকলেই বলে চলে, এটা টেম্পোরারি। কয়েক দিনের মধ্যেই খুলে যাবে আবার। ডানলপের মতো কারখানা কি আর চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যেতে পারে কখনও?
এমন একটা সময়েই বালি স্টেশন থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের একটি বিশাল মাঠে পর্দা টাঙিয়ে এক বার শোলে দেখানো হল। আশেপাশের বহু অঞ্চল থেকে দল বেঁধে এল মানুষ। একেবারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। চাকরিহারা, নানা ভয়ে জীবনের কোনও ধরনের সৌন্দর্যেরই তল খুঁজতে না-চাওয়া অতিকায় বিষণ্ণতা নিয়েও যেমন মানুষ এল, তেমনই সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া কন্যার হাত ধরে এসে পিতা বললেন, “পড়াশোনার জন্য বাড়িতে টিভি নেই। পরীক্ষা হয়ে গেছে। মেয়েটা এক বার শোলে দেখুক।”
জেনারেটর চালিয়ে সিনেমা শুরু হল। প্রোজেক্টর বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝেই। অন্ধকারের মধ্যে কয়েকশো মানুষ তখন এমন ভাবে চুপ করে আছে, যেন একটা শব্দ হলেও কানে আঙুল দিয়ে ভুলে যেতে চাইবে ভাষা। কয়েক বার বন্ধ হয়ে, বেশ কয়েকটি দৃশ্য তিন-চার বার করে দেখিয়ে তিন ঘণ্টা আঠারো মিনিটের সিনেমা শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা। সিনেমার শেষের ঠিক আগের দৃশ্যে একটা ঘটনা ঘটল। ‘জয়’-এর চিতার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় নিজের ঘরের জানলা ধীরে বন্ধ করে দিল ‘রাধা’। গোটা ছবি জুড়েই প্রায়-নীরব জয়া বচ্চন অভিনীত চরিত্রটি। দৃশ্যটি ফের চালানোর অনুরোধ করল আমার এক দাদা। এত ক্ষণ ধরে মাঠে বসে এমন একটা সিনেমা দেখছে কয়েকশো মানুষ, যা প্রায় কেউই প্রথম বার দেখছে না! এত হাসি, গান, প্রমত্ত মুদ্রার উজাড় করা দৃশ্য ছেড়ে একটা জানলা বন্ধ করার দৃশ্যের কাছে ফিরে যাওয়ার মতো ধৈর্য কারও আর নেই। সম্মিলিত আপত্তিতে ওই দৃশ্য নতুন করে চালানোর অনুরোধ ধোপে টিকল না। শোলে শেষ হয়ে গেল।
কী এমন ছিল দৃশ্যটায়? বাড়ি ফেরার পথে এই প্রশ্নের উত্তরে সদ্য চাকরি হারিয়ে ফেলা ডানলপের ইঞ্জিনিয়ার, কবীর সুমন-ভক্ত দাদা বলেছিল, “শোন, যে মানুষ স্তব্ধ হয়ে আছে, তার কাছে যেতে হয়।” ওই বয়সে বুঝিনি। তবে, অনেক পরে মনে হয়েছিল, জয়া বচ্চনের চরিত্রটিকে ফের দেখতে চেয়ে আসলে এক বার নিজের একক অস্তিত্বেরই মুখোমুখি হতে চেয়েছিল দাদা। যা আসলে নিজের কাছেই নিজের ফেরা। ভিড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে। দ্বাদশ ব্যক্তির মতো!
১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসে পশ্চিমবঙ্গে রিলিজ় করেছিল শোলে। মহারাষ্ট্রে রিলিজ় করার প্রায় দু’মাস বাদে। “জ্যোতি সিনেমায় যে শোলে দেখেনি, সে কিছুই দেখেনি,” এটুকু বলে চা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এক সময়ের টিকিট ব্ল্যাকার সঞ্জয় পাল। সিঙ্গল স্ক্রিনের সেই সোনার দিন গিয়েছে। ব্ল্যাকাররাও যে যাঁর মতো কাজ খুঁজে নিয়েছেন পেটের তাগিদে। বেহালা চৌরাস্তার কাছে ছোট গুমটিতে ক্রেতাদের চা-বিস্কুট দেওয়া শেষ করে সঞ্জয় পাল বললেন, “জ্যোতি-তে শোলে-র টিকিট ব্ল্যাক করে আমার দুই দিদির বিয়ে দিয়েছিলাম। এক দিদিকে দেখতে এসে এক বার পাত্রপক্ষ যৌতুকে শোলে-র বাইক চেয়েছিল। সেটা দিতে পারব না বলায় তারা একটা অদ্ভুত শর্ত দিয়ে বসে। পাত্র ধর্মেন্দ্র-র ভক্ত। তাকে জ্যোতি-তে শোলে দেখানোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যত বার সে চাইবে। সিনেমা হলের বাইরের দুনিয়া নিয়েই আমাদের কাজ। ভিতরের বসানোটা তো আমাদের হাতে নেই। আর সেটা করতে গেলে, রোজ যে হাজার-হাজার মানুষ জ্যোতি-র সামনে শোলে দেখার জন্য ভিড় করছে, তাদের সঙ্গেও নিমকহারামি করতে হয়। ওই পাত্রপক্ষ তাই ক্যানসেল হল। ও-রকম ভিড় ভাবা যায় না! আট মাসের বাচ্চাকে নিয়ে শোলে দেখতে এসেছে বাবা-মা। অত ভিড়ের মধ্যে বাচ্চাকে কে তুলে নিয়েছে। বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মা হাউহাউ করে কাঁদছে। বাবা বলছে, আগে বইটা দেখে নিই, তার পর থানায় যাব। এ সব সামনে থেকে দেখেছি। অনেকে কুম্ভমেলার কথা বলে। জ্যোতি-র শোলে ছিল কলকাতার কুম্ভমেলা।”
শোলে-র শুটিংও কুম্ভমেলার চেয়ে কম কিছু ছিল না! ১৯৭৩ সালে ছবির শুটিং শুরু হয় তৎকালীন ব্যাঙ্গালোর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের রামনগরে। তার আগে ওই এলাকায় কোনও হিন্দি সিনেমার শুটিং হয়নি। জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন শোলে-র আর্ট ডিরেক্টর রাম ইয়েদেকর। সিনেমার বাজেট প্রথমে ধরা হয়েছিল এক কোটি টাকা। প্রায় আড়াই বছর ধরে শুটের পর অঙ্কটা হয়ে দাঁড়াল তিন কোটি টাকা! শোলে তৈরিতে এতটা সময় লাগা নিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে বহু মশকরাও চলত। শোনা যায়, জিতেন্দ্র এক বার বলেছিলেন, শোলে-র একটা শেডিউল শেষ হতে যত সময় লাগে, তার মধ্যে তিনি তিনটে ছবির শুট শেষ করে দেন!
ওই সময় হিন্দি সিনেমার ডাকু মানেই কপালে বড় তিলক। কথায় কথায় মুখে ‘জয় ভবানী’ গোত্রের হুঙ্কার। শোলে-তে গব্বর সিংকে পরানো হল গেরিলা যোদ্ধাদের পোশাক। সিনেমায় কোনও ‘মা’-এর চরিত্র নেই। দেশাত্মবোধক গান নেই। কোনও মন্দিরে গিয়ে মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মুখ্য চরিত্রদের আবেগে থরথর ডায়লগ নেই। জয় আর বীরু কোথা থেকে এল, কেনই বা চোর হয়ে গেল, কী তাদের পুরো পদবি— কিছুই জানা যায় না! গব্বর সিং-এর চরিত্রের জন্য আমজাদ খানের নাম রমেশ সিপ্পিকে বলেছিলেন সেলিম-জাভেদ। আবার আমজাদ খানের কণ্ঠস্বর ‘একেবারেই ভিলেন-সুলভ নয়’, এই যুক্তিতে শুটিং-এর মাঝপথেই তাঁকে বাদ দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন জাভেদ আখতারই! এমনকি, ডাবিং-এর সময় গব্বরের কণ্ঠস্বর যাতে অন্য কাউকে দিয়ে ডাব করানো হয়, তার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি! প্রতিটি তুঙ্গ সাফল্যের গল্পের নেপথ্যেই তো কিছু হিম-কালো বিষাদ থেকে যায়। আগে থেকে ঠিক করে রাখার পরেও যাচ্ছেতাই ভাবে এলোমেলো হয়ে যায় সব কিছু। এক পিঠ দৃশ্যমান মনে হলে পর ক্ষণেই খেয়াল পড়ে অপর পিঠ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে! সফলতার নানা বিন্দুকেই নিয়তির মতো পাহারা দিয়ে যায় এমন সব বাস্তুচ্যুতি!
দশ সেকেন্ডের দৃশ্যের শুটে সময় লেগে যাচ্ছে আঠারো দিন! লোকেশনে দীর্ঘ দিন থাকতে থাকতেই বর্ষীয়ান সিনেম্যাটোগ্রাফার দ্বারকা দ্বিভেচা প্রেমে পড়লেন এক সতেরো বছরের তরুণীর। শোলে রিলিজ়ের আড়াই বছরের মধ্যে প্রয়াত হন দ্বারকা। যে হারমোনিকার সাদা দুঃখময় সুর ছবিটির বিভিন্ন ফ্রেমে মিশে গিয়ে কালজয়ী হয়ে উঠেছে, তা মিশেছিল তাঁর জীবনেও। শুটিং শেষ হওয়ার অনেক পরেও সেই অসমবয়সি প্রেমিকার খোঁজে রামনগরের পাথুরে উপত্যকায় ফিরে যেতেন তিনি।
এই ফিরে যাওয়া শোলে-র রন্ধ্রে। ছবির গল্পে যেমন, ছবি তৈরির নেপথ্যকাহিনিতেও তেমন। আরও যা কখনওই না ভোলার— প্রতিটি ফ্রেমের সংযম। যার মূল কৃতিত্ব অনেকটাই সম্পাদক এম এস শিন্দের। তখনকার ভারতীয় কমার্শিয়াল ছবির নিরিখে সবচেয়ে সহজ ছিল যে দৃশ্য দেখানো, সবচেয়ে সহজ ছিল যে কথা বলা, তা না-দেখিয়ে, না-বলেই শোলে মিশে গিয়েছে ভারতের হৃদয়ে। এমন এক ভারত, যেখানে ‘জরুরি অবস্থা’-র কারণে শেষ মুহূর্তে নতুন ভাবে শুট করে বদলাতে হয় দেশের প্রথম ৭০ মিলিমিটার পর্দা ও স্টিরিয়োফোনিক সাউন্ডের হিন্দি ছবির ক্লাইম্যাক্স। যেখানে সম্পূর্ণ উর্দুতে লেখা একটি ছবির স্ক্রিপ্ট ও ডায়ালগ বছরের পর বছর ধরে ঘরে ঘরে বাজতে থাকে জাতীয় সঙ্গীতের মতো। যে ভারতে এ কে হাঙ্গল অভিনীত ইমামসাহেবের চরিত্রটিই যেন নতুন করে এসে দাঁড়ায় শোলে মুক্তির বহু বছর বাদে— ২০১৮ সালের আসানসোলে। ধর্মীয় মিছিলকে কেন্দ্র করে তৈরি হিংসায় চলে গিয়েছে পুত্রের তরতাজা প্রাণ। তা সত্ত্বেও, হাতজোড় করে সকলকে শান্ত থাকার অনুরোধ করে চলেছেন ইমাম ইমদাদুল্লা রশিদি...
শোলে ছবিটা আসলে কার? জয়-বীরু-ঠাকুর, না কি গব্বরের? এই তর্কে যে কথাটি প্রায় কখনওই উঠে আসে না তেমন: প্রতিশোধের এত শাণিত সরব কাহিনিতে সন্তান হারানোর তীব্র ক্ষত বুকে নিয়েও ঘৃণার ভিতরের দীনতাকে পূর্ণ মাত্রায় অনুভব করে চিনিয়ে দিতে ভুল করেন না যিনি, এই ছবি সেই বৃদ্ধ অন্ধ ইমামেরও। পঞ্চাশ বছর আগের বিবর্ণ সূর্যের আলোর মধ্য দিয়ে পুত্রশোকের ভারকে অতিক্রম করে— ভিড়ের থেকে আলাদা উচ্চারণ যাঁর— সেই দ্বাদশ ব্যক্তির মসজিদের দিকে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যই ছবিটিকে আমাদের দেশ করে তুলল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)