E-Paper

অনুপস্থিত নয়, অদৃশ্য

প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত নেই বলে সাধারণ ভাবে যে ধারণা রয়েছে, তা কতটা ঠিক? দ্বিতীয়ত, দলিতদের এই পদক্ষেপ কি রাজ্য জুড়ে দলিত রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষকেই প্রতিফলিত করছে?

বিরাগচিত্র: আম্বেডকরের মূর্তির সামনে জাত-বৈষম্যের বিরুদ্ধে রবিদাসিয়া মহাসঙ্ঘের সদস্যদের সমাবেশ, কলকাতা, ১১ মার্চ।

বিরাগচিত্র: আম্বেডকরের মূর্তির সামনে জাত-বৈষম্যের বিরুদ্ধে রবিদাসিয়া মহাসঙ্ঘের সদস্যদের সমাবেশ, কলকাতা, ১১ মার্চ।

অয়ন গুহ

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৫ ০৬:০১
Share
Save

বেশি দিন নয়, মাস দুই আগে, বর্ধমানের এক গ্রামে একটি নিম্নবর্ণের সম্প্রদায়ের দীর্ঘ দিনের সামাজিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্থানীয় শিবমন্দিরে প্রবেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও রাজনীতিতে জাতির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। ঘটনাবহুল সময়, নিত্যনতুন সংবাদের ভারে চাপা পড়ে গিয়েছে সেই আলোচনা। কিন্তু ভুলে থাকা যাবে না, বিষয়টি এতই জরুরি। তখন মূলত দু’টি প্রশ্ন উঠেছিল— প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত নেই বলে সাধারণ ভাবে যে ধারণা রয়েছে, তা কতটা ঠিক? দ্বিতীয়ত, দলিতদের এই পদক্ষেপ কি রাজ্য জুড়ে দলিত রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষকেই প্রতিফলিত করছে?

যদিও জাতিবৈষম্য পশ্চিমবঙ্গে মোটেই বহুচর্চিত বিষয় নয়, এত দিনে স্বীকার করতেই হয় যে জাতির অস্তিত্ব এই বাংলার দৈনন্দিন জীবনে একটি রূঢ় বাস্তব। ২০০১ সালে প্রতীচী ট্রাস্টের এক সমীক্ষা দেখিয়েছিল, কিছু স্কুলে তফসিলি শিক্ষার্থীদের আলাদা ভাবে বসতে বাধ্য করা হত। ২০০৪ সালে কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উচ্চবর্ণের অভিভাবকরা কী ভাবে তাঁদের সন্তানদের তফসিলি স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা প্রস্তুত খাবার খাওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। বলা জরুরি যে, বাঙালি সমাজকে যা পৃথক করে তা জাতিভেদের অনুপস্থিতি নয়, বরং জনপরিসরে জাতির ‘অদৃশ্যতা’। পশ্চিমবঙ্গের পটভূমিতে পর্যবেক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রেই জাতির অদৃশ্যতাকে এর ‘অনুপস্থিতি’র সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। এই অদৃশ্যতার অন্যতম কারণ, আধিপত্যবাদী ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের জাতির ভূমিকা অস্বীকার করার প্রবণতা।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের ফল হিসেবে বাংলায় ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। সম্পূর্ণ ভাবে না হলেও ভদ্রলোকরা মূলত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য এই তিন উচ্চজাতিভুক্ত ছিল। সুবিধাজনক জাতিগত অবস্থানের কারণে তারা পাশ্চাত্যশিক্ষা এবং আধুনিকতার সর্বপ্রথম সুবিধা লাভ করতে সক্ষম হয়, যা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের বৈধতার শর্ত নির্ধারণ করার আধিপত্যবাদী ক্ষমতা অর্জন করতে সাহায্য করেছিল। স্বাধীনতার পরে, তারা বামপন্থীদের শ্রেণি-রাজনীতির বৌদ্ধিক চালিকাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং ধর্মনিরপেক্ষকরণের স্বার্থে জনপরিসরে জাতিকে একটি অনুচ্চারণীয় বৈধতাহীন অভিধানে রূপান্তরিত করে। যার ফলে ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের আধিপত্যের জাতিগত ভিত্তি প্রকাশ্যে প্রতিফলিত হয় না। ফলস্বরূপ, যদিও ক্ষমতার সম্পর্কগুলি জাতিগত বিন্যাস দ্বারা পরিচালিত হয়, জনপরিসরে জাতির দৈনন্দিন ভূমিকা সংক্রান্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক সংলাপ অবলুপ্ত থাকে, যা এক কার্যকর এবং শক্তিশালী দলিত প্রতি-সংস্কৃতির উত্থানকে প্রতিহত করে।

বামপন্থী শ্রেণি-রাজনীতির অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতির অভিব্যক্তি আপাতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে জাতির প্রভাব এখনও সীমিত। সাম্প্রতিক কালে নিম্নবর্ণের মতুয়া-নমশূদ্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে অনেকে জাতিপরিচয়ের রাজনীতিকরণ হিসাবে গণ্য করছেন। গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন করলে অবশ্য সাম্প্রতিক নমশূদ্র রাজনীতিতে জাতিসত্তার সীমিত প্রভাব বোঝা যায়। বাম-পরবর্তী যুগে, তৃণমূল কংগ্রেস বড়মা বীণাপাণি দেবীকে বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার প্রদান, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং নমশূদ্র ও মতুয়া উন্নয়ন বোর্ড গঠনের মতো বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে মতুয়া পরিচয়কে সামনে আনার চেষ্টা হলেও, নমশূদ্রদের একটি বৃহৎ অংশ নাগরিকত্বের প্রশ্নে হিন্দুত্ব-রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন। জানিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন থেকে বাঁচতে বৈধ ভ্রমণ-নথি ছাড়াই তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। ফলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯ (সিএএ)-এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি নমশূদ্রদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সমর্থন-ভিত্তি গড়ে তুলেছে। মনে রাখা ভাল, সিএএ কেবল একটি আইনি পদক্ষেপ নয়। এটি হিন্দুত্বের আদর্শ-কাঠামোর সঙ্গে গভীর ভাবে যুক্ত একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ন্যারেটিভও বটে, যা নমশূদ্রদের ধর্মীয় নিপীড়নের স্মৃতির রাজনীতিকরণ ঘটিয়ে তাদের হিন্দু সত্তাকে জোরালো করেছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক সংহতিকরণের মূল চেতনা প্রভাবিত হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতি দ্বারা, জাতিচেতনার প্রভাব এখানে গৌণ।

অথচ, এই রাজনৈতিক পন্থা প্রথাসিদ্ধ ও গতানুগতিক জাতি-রাজনীতির অনুসারী নয়— যেখানে নিম্নবর্ণের গোষ্ঠীগুলি রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, কর্মসংস্থান ও শিক্ষায় সংরক্ষণ এবং জাতি-হিংসা থেকে সুরক্ষার মতো জাতি-পরিচয়কেন্দ্রিক দাবিগুলি তুলে ধরে। এই প্রসঙ্গে, ১৯৩৪-এর ৩ মার্চ নাশিকের কালারাম মন্দির প্রবেশ সত্যাগ্রহের অন্যতম সংগঠক ভাউরাও গায়কোয়াড়কে আম্বেডকর যা লিখেছিলেন, তা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক: “আমি মন্দির প্রবেশ আন্দোলন এই ভেবে শুরু করিনি যে তা নিম্নবর্ণদের মূর্তিপূজারীতে রূপান্তরিত করবে… আমার মনে হয়েছিল যে তাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করা এবং তাদের নিজ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করার এটাই সর্বোত্তম উপায়। যে হেতু আমি বিশ্বাস করি যে আমি সেই উদ্দেশ্য অর্জন করেছি, তাই মন্দির প্রবেশের আন্দোলনের আর কোনও প্রয়োজন নেই। আমি চাই যে তারা তাদের শক্তি এবং সম্পদ রাজনীতি এবং শিক্ষার উপর কেন্দ্রীভূত করুক।” অর্থাৎ, আম্বেডকরের নেতৃত্বে ১৯৩০ সালে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে মন্দির প্রবেশের আন্দোলন ছিল দলিতদের রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ঘটানোর একটি মাধ্যমমাত্র, যাতে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দাবিতে সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারেন। এখানেই নিহিত ছিল দলিত আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ, যা মোটামুটি ভাবে ভারতের দলিত আন্দোলন অনুসরণ করেছে।

শুধু নমশূদ্র নয়, পশ্চিমবঙ্গে অন্য জাতিগোষ্ঠীদের দাবিদাওয়া ও আন্দোলনের ক্ষেত্রেও দলিত রাজনীতির এই চেনা প্রকরণের অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যেমন উত্তরবঙ্গে বাংলার বৃহত্তম তফসিলি জাতিগোষ্ঠী রাজবংশীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরিচালিত হয়, যা প্রায়ই একটি পৃথক রাজ্যের দাবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দাবিটির ভিত্তি হল— রাজবংশীরা উত্তরবঙ্গের আদি বাসিন্দা এবং রাজবংশী নামে পরিচিত একটি ভিন্ন ভাষার বক্তা। স্পষ্টতই জাতিসত্তার বদলে ‘এথনিক’ বা ভাষাগত-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীচেতনার অনুভূতি এ ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি রূপে কাজ করছে।

অনেক পর্যবেক্ষক আজকের রাজনীতিতে জাতির ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক তাৎপর্য দেখেন— দৃষ্টান্ত: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্রাহ্মণ পরিচয়ের অকপট প্রকাশ। তবে জাতি-পরিচয় নয়, বরং এটি বিজেপির মুসলিম তোষণের অভিযোগের প্রত্যুত্তরের কৌশল হিসেবে বিশুদ্ধ হিন্দু পরিচয় তুলে ধরার প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়। আর একটি দৃষ্টান্ত: পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক দলিত সাহিত্য আকাদেমি প্রতিষ্ঠা। যদিও মহারাষ্ট্র এবং উত্তরপ্রদেশের মতো অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে দলিত সাহিত্যের প্রভাব সীমিত, তাও দলীয় রাজনীতি থেকে স্বতন্ত্র ও স্বকীয় দলিত কণ্ঠস্বর এখানে তুলে ধরা হয়েছে। সরকারি অর্থানুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা বাংলা দলিত সাহিত্যকে হয়তো অনেক বেশি প্রচার দেবে, কিন্তু বাংলা দলিত সাহিত্য হয়তো শেষ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলবে তার প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্র এবং স্বকীয় রাজনৈতিক চেতনা, যা দলিত সাহিত্যের মতো যে কোনও প্রতিবাদী সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য ও পরিচয়। সমাজজীবনের বিভিন্ন স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে এই ধরনের সরকারি অনুপ্রবেশ বা রাজনৈতিক সক্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গের একটি অনন্য রাজনৈতিক প্রবণতা— রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যাকে ‘পার্টি সোসাইটি’ নামে অভিহিত করেছেন।

এটাও ঠিক যে, অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গে জাতির আপাত-রাজনৈতিক অভিব্যক্তির প্রসার বিধানসভায় নিম্নবর্ণের প্রতিনিধিত্বের কোনও লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটাতে পারেনি। অতএব, পশ্চিমবঙ্গে জাতির আপাত-দৃশ্যমানতা বাড়লেও এখনও মূলধারার রাজনীতিতে জাতির রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণ একই রকম রয়ে গিয়েছে। জাতিসত্তার জাগরণের মাধ্যমে ক্ষমতার সুপ্রতিষ্ঠিত কাঠামোতে অর্থপূর্ণ রূপান্তর সাধনের প্রক্রিয়া এই রাজ্যে এখনও দেখা যাচ্ছে না।

স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজ়, ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Caste Discrimination West Bengal Politics Caste System Caste Politics

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।