উল্টোরথের সময়ে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রাকে যে ভাবে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়, সেটাই ছিল প্রথম যাত্রাপথ। নবকলেবরের পর দারুব্রহ্ম নির্মাণে কাঠগুলি প্রথমে গুন্ডিচা মন্দিরে নিয়ে আসা হয়, সেখান থেকে সেগুলি সদ্যনির্মিত বড় মন্দিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ শ্রীচৈতন্যের জন্মের প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্যচরিতামৃত-এ রথের আগে শ্রীচৈতন্যের গুন্ডিচা মন্দির সংস্কারের কথা লিখে গিয়েছেন। শ্রীচৈতন্য কি সেই গুন্ডিচা মন্দিরকে শুধু আমাদের মতো ‘মাসির বাড়ি’ ভেবেছিলেন, না আরও বেশি কিছু? সাহিত্য ও ইতিহাস সব প্রশ্নের উত্তর দেয় না, একটা সময়ের পর তারাও নীরব।
যে পথ ধরে আজ রথ যায়, সেই ‘বড়া দাণ্ডা’ সংস্কার করে প্রশস্ত করা হয় ব্রিটিশ আমলে। তার আগে নবম ও দশম শতাব্দী থেকে সমুদ্রতট ধরে, চিলিকা হ্রদের পাশ দিয়ে আসত কলিঙ্গমার্গ। কলিঙ্গরাজ নৃসিংহদেব এই রাস্তার ধারে নরসিংহপত্তন নগরী বসান। শঙ্করাচার্য ও রামানুজ, দুই দক্ষিণী ধর্মগুরুই সেই রাস্তা হয়ে পুরী পৌঁছন। শ্রীচৈতন্যের আমলেও পুরী যাওয়ার প্রশস্ত রাজপথ ছিল না, সুবর্ণরেখার তটে গোপীবল্লভপুর, ‘ঝারিখন্ড’, রেমুনার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির হয়ে তিনি পুরী পৌঁছন। বৈদান্তিক আদি শঙ্করাচার্য এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব শ্রীচৈতন্যের জগন্নাথ দর্শনের পথ আক্ষরিক অর্থেই আলাদা।
সমুদ্রতটের ওই পথ ধরেই ১৮০৩ সালে ব্রিটিশরা ওড়িশা দখল করে। রেল, গাড়ি ও জগন্নাথের রথ চলার প্রশস্ত রাজবর্ত্ম আরও পরের কথা। কোম্পানির আমলেও কলকাতা থেকে পুরী অনেকে জলপথে যেতেন। রেল যোগাযোগ আরও পরে। ১৮৭৯ সালে রাজধানী কলকাতার সঙ্গে মাদ্রাজের রেল যোগাযোগ। তারও দুই দশক পরে ১৮৯৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি খুরদা রোড-পুরী শাখা। কটকের বাড়িতে সুভাষচন্দ্র বসু তখন কাঁথায় জড়ানো, এক সপ্তাহের শিশু মাত্র।
আর খড়্গপুর থেকে রেললাইন গিয়েছিল তীর্থযাত্রীদের সড়ক ধরে। ওই পথ ধরেই তাঁরা যাতায়াত করতেন, পুরীর পান্ডারা বাংলার যজমানদের বাড়ি আসতেন। বিশ শতকের শুরুতেও রাস্তায় সাক্ষীগোপালের মন্দির দর্শন করে রথ দেখতে যাওয়া যাত্রীরা আবেগে চিৎকার করে উঠতেন। তার পর নদী ও সেতু পেরিয়ে জগন্নাথধাম। তার আগে আঠারনালা সেতুতে কলেরার ইনজেকশন। কালের নিয়মে সেই রাস্তা ও সাক্ষীগোপালও হৃতগুরুত্ব, এখন পুরী থেকে সবাই এক যাত্রায় কোণার্ক, ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির, নন্দনকাননের চিড়িয়াখানা ও সাক্ষীগোপাল দর্শন করে। তীর্থপথ এক থাকে না, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে পরিবর্তিত হতে থাকে।
বিশ শতকের শুরুতেও আলোকপ্রাপ্ত নব্য ধনীদের জনাকয়েক ছাড়া কে আর সমুদ্রতটে থাকতেন? সমুদ্রের কাছে শ্মশান থাকায় স্বর্গদ্বার নাম, কিন্তু সেখানে শ্রীচৈতন্যের মূর্তি, মেরিন ড্রাইভ, খাজার দোকান, কটকি শাড়ি, হোটেল অনেক পরে। রথদর্শনে যাওয়া তীর্থযাত্রীরা তখন মন্দিরের কাছাকাছি পান্ডাদের স্যাঁতসেঁতে বাড়িতেই ভাড়ায় থাকতেন। সব কিছুরই ইতিহাস আছে, রথ দেখারও! প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭৮ সালে হাইনরিখ ভন স্টিটেনক্রন নামে এক জার্মান ইতিহাসবিদ হিসাব দিয়েছিলেন, সারা ওড়িশা জুড়ে প্রায় ৯৩১টি জগন্নাথ মন্দির আছে, কোথাও তাঁর নাম দধিবামন, কোথাও বা পতিতপাবন। পুরীর আদলে সব মন্দিরেই পুজো হয় এবং স্নানযাত্রা, রথযাত্রা পালন করা হয়। গুজরাতের আমদাবাদে এ বারও খামাসা গেট, কালুপুর সার্কল, সরসাপুর, মানেক চক হয়ে ‘নিজ মন্দির’-এর ১৪৮ বছরের পুরনো রথযাত্রা হবে। রথযাত্রাই হতে পারে আজকের অর্বাচীন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান স্লোগানের বিরুদ্ধে রশির টান।
জগন্নাথের রথ চমকপ্রদ আরও একটি কারণে। বেদ-বেদান্ত-গীতা-তন্ত্র ইত্যাদির কোথাও যে রথযাত্রার উল্লেখমাত্র নেই, পুরী তথা ওড়িশার হাত ধরে সেটিই হয়ে গেল ভারতের অন্যতম উৎসব। রাজা অনঙ্গভীম দেবের রাজসভার নাট্যকার মুরারির অনঙ্গভাব নাটকে প্রথম এল ‘পুরুষোত্তমের যাত্রা’র কথা। হারমান কুলকে, জ্যাকব রাসেল প্রমুখ ইতিহাসকার বলছেন, এটিই রথযাত্রার প্রথম সাহিত্যিক তথ্যসূত্র। পরের সুতোটা আরও দূরে। বাবা আলাউদ্দিন-খ্যাত মধ্যপ্রদেশের মাইহারের এক শিলালেখ। সেখানে লেখা, ষোলো বছরের এক ব্রাহ্মণ তরুণ ওড্রদেশে পুরুষোত্তম দর্শনে যায়, ফেরার পথে সলিলসমাধি হয়। মানে, পুরী এবং জগন্নাথ নামটি তখনও এত পরিচিত হয়নি। কিন্তু হিন্দু রাজ্য ওড়িশার রাষ্ট্রদেবতার খ্যাতি তত দিনে রাজ্যের গণ্ডি ছাপিয়ে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে।
রাষ্ট্রদেবতা! পুরী তখন কটকের চোরগঙ্গ রাজাদের অধিকারে। ১২৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় রাজা তৃতীয় অনঙ্গভীম দেব মহানদীতে স্নান সেরে জানালেন, তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের ব্রাহ্মণদের জন্য জমি ও অর্থ দান করছেন। পুরী ও জগন্নাথ নামটি তখনও পরিচিত হয়নি। অনঙ্গভীম নিজে শৈব, তাঁর আরাধ্য শিবের পাশাপাশি জাজপুরের দুর্গা বিরজার ভক্ত। অতঃপর অনঙ্গভীম তাঁর শাসনাধীন কলিঙ্গ রাজ্য উৎসর্গ করলেন পুরুষোত্তমদেবকে। জানালেন, তিনি নিজে রাজা নন, পুরুষোত্তমের প্রতিনিধি হিসাবে শাসন করছেন মাত্র। এমনকি, নিজের অভিষেকপর্বও প্রত্যাখ্যান করলেন। আসল রাজা তো পুরুষোত্তম, তিনি তাঁর প্রতিনিধি, তা হলে রাজমুকুট পরবেন কী ভাবে? শুধু পুরীতেই রথযাত্রা শুরুর আগে ‘ছেঁড়া পহরা’ বা রাজা রাস্তায় ঝাঁট দেন কেন? রাজ্যের প্রকৃত নৃপতি সফরে বেরিয়েছেন, প্রতিনিধি তো রাস্তা সাফ করবেনই। ধর্ম মানে শুধু উৎসব নয়, তার প্রতি আচার-অনুষ্ঠানের পিছনে বিস্মৃত ইতিহাস।
এই ছেঁড়া পহরা এবং ৩৬ নিয়োগের জন্য ইতিহাস আজও কৃতিত্ব দেয় ওই তৃতীয় অনঙ্গভীমকে। ৩৬ নিয়োগ মানে কোনও জাতপাত থাকবে না, হিন্দু রাজ্যের যে কেউ আসতে পারেন মন্দিরে। তাঁদের মধ্য থেকেই বংশানুক্রমিক ভাবে নিযুক্ত হবে সূপকার, করণিক, পান্ডা। শুধু রথযাত্রা নয়, পুরীর মন্দিরে স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, চন্দনযাত্রা (তিন বিগ্রহকে নৌকাসফরে নিয়ে যাওয়া হয়), নবকলেবর ইত্যাদি বারো রকম যাত্রা আছে। সব ক’টি যাত্রাই নাকি অনঙ্গভীম দেবের আমলে শুরু।
পুরীর মন্দিরের সেবায়েতদের নিয়ে আজকাল ‘দ্বৈতাপতি’ জোড়শব্দটি খুব চালু। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি ভুল শব্দ। ‘দ্বৈতা’ মানে যাঁরা শবরদের উত্তরসূরি, ‘পতি’ মনে যাঁরা ব্রাহ্মণ। পরবর্তী কালে আমরা সাহেবদের দৌলতে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি হরেক শব্দ শিখেছি, কিন্তু সেই মধ্যযুগে এক শৈব নৃপতি তাঁর গোটা রাজ্য বিষ্ণু বা পুরুষোত্তমকে উৎসর্গ করছেন, শবর দ্বৈতা ও ব্রাহ্মণ পতি এক সঙ্গে দেবতার আরাধনায় রত, জাতপাত ভুলে সকলে একই সঙ্গে রান্না করা মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে রথের রশিতে টান দিতে পারে, সেখানে কি নেই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সমগ্র হিন্দু রাজ্যকে একাকার করার আদি চিহ্ন? আধুনিকতা এই গৌরবজনক মধ্যযুগীয় ইতিহাস বিস্মৃত হয়েছে, হরিজন আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মহাত্মা গান্ধীকেও পুরীর মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। মধ্যযুগ মানে অন্ধকার আর আধুনিকতা মানে আলোময় নক্ষত্রমালা, এই ধারণা থেকে এ বার বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে।
হয়তো গোটাটাই রাজনৈতিক বুদ্ধিপ্রণোদিত। চার পাশে আফগান-তুর্কি শাসনের মধ্যে তখন ওড়িশাই একমাত্র হিন্দু দ্বীপ। সেই সময় শবরপূজিত এক দেবতাকে বিষ্ণু পুরুষোত্তমের সঙ্গে একাকার করে দেওয়ায়, রাজ্য রক্ষার্থে তাঁর নাম করে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলকেই তো একত্র যুদ্ধযাত্রা করতে হবে। যে রাজনৈতিক বুদ্ধি প্রজাদের মধ্যে বিভেদ তৈরির বদলে সকলকে এক সুতোয় গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাকে একুশ শতকের ভারতেও কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। সংশয়ীরা পুরীর মন্দিরে হিন্দু ব্যতিরেকে অন্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার কথা বলতে পারেন। কিন্তু সেই একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে স্বাধীন হিন্দু রাজ্য ওড়িশায় ক’জন মুসলমান ছিলেন? হুসেন শাহের রাজ্যের প্রজা শ্রীচৈতন্য কি মোগলশাসিত মথুরা, বৃন্দাবন হয়ে শেষ অবধি পুরীতে আশ্রয় নেননি?
ওড়িশায় শ্রীচৈতন্যের সবচেয়ে বড় প্রভাব কী? আজও বলরাম দাস, জগন্নাথ দাস, অচ্যুতানন্দ দাস, যশোবন্ত দাস ও শিশু অনন্ত দাসের মতো পাঁচ কবি বা ‘পঞ্চসখা’র রাধাকৃষ্ণ ভক্তিতত্ত্বের প্রভাব। জগন্নাথ মন্দিরে আজও গীতগোবিন্দ পাঠ হয়। আর জরা শবরের তিরে নিহত শ্রীকৃষ্ণের নাভি সমুদ্রে ভেসে আসার উপাখ্যানটি সরলা দাসের মহাভারত থেকে নেওয়া। গড়পড়তা বাঙালি খেয়াল রাখে না, ওড়িয়া ভাষার সরলা মহাভারত অন্যতম বৃহৎ মহাভারত, আয়তনে কাশীরাম দাসকেও অক্লেশে ছাপিয়ে যায়। এই যে ধর্ম থেকে সাধারণ সংস্কৃতি সর্বত্র জগন্নাথ, তার প্রভাবে কী হল? কোম্পানির আমলে ওড়িশার পাইক বিদ্রোহের সময়েও নেতারা জানালেন, জগন্নাথ তাঁদের আরাধ্য। পুরী ছাড়া অন্যত্র জগন্নাথ মন্দির বা অসম ছাড়া অন্যত্র কামাখ্যা মন্দির বানালে স্থানমাহাত্ম্য বা জাতীয়তাবাদ কোনওটিই রক্ষিত হয় না।
আর জগন্নাথের দারুশিল্পীর ছদ্মবেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের মন্দিরে এসে মূর্তি তৈরি? কাল্পনিক আখ্যানমাত্র। পুরীমাহাত্ম্য নামে ওড়িয়া ভাষার বই জানায়, ইন্দ্রদ্যুম্নের সেই মন্দির স্বর্গের থেকেও উঁচু ছিল। তিনি পৌরোহিত্যের জন্য ব্রহ্মাকে অনুরোধ জানাতে যান, কিন্তু ব্রহ্মলোকে কয়েক মুহূর্ত কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে দেখেন, ইতিমধ্যে কয়েক যুগ অতিক্রান্ত। মন্দির বালিতে ঢাকা পড়েছে, সে কোথায় কেউ জানে না।
মিথের রথচক্র এ বার ইতিহাসের দিকে এগিয়ে এল, বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গেল!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)