Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের পালাবদলে সংখ্যালঘুর এই বিপন্নতা পরিকল্পিত
Bangladesh

আর কত সইতে হবে

গত কয়েক মাস ধরে সমতলের হিন্দু এবং পাহাড়ের বৌদ্ধদের উপর অত্যাচারের মাত্রা অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। চাকরি থেকে জবরদস্তি ছাঁটাই কিংবা হিন্দু-বৌদ্ধদের দোকান লুট তো নিত্য দিনের ঘটনা।

আক্রান্ত: চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে পুলিশি প্রহরায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ২৬ নভেম্বর।

আক্রান্ত: চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে পুলিশি প্রহরায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ২৬ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:১৭
Share: Save:

মুহম্মদ জ়াফর ইকবালের ‘আজব ছেলে’ গল্পে, এক হোমরাচোমরা ব্যক্তি স্ত্রীকে নিয়ে গাড়ি চড়ে যাওয়ার সময়, খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা এক সদ্য যুবাকে ‘ইন্ডিয়া’য়পালিয়ে যাচ্ছে মনে করে জবরদস্তি নিজের গাড়িতে তুলে এনে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে থাকেন। ইতিমধ্যেই ‘পানি’র বদলে ‘জল’ উচ্চারণ করে ছেলেটি ড্রাইভার ও গাড়ির মালিকের সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে জানায় যে তাকে গাড়িতে নয়, খালি পায়ে হেঁটেই পুরো পথটা যেতে হবে কারণ তাকে গর্ভে নিয়ে তার মা খালি পায়েই ওই রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়েছিলেন। তাঁকে জন্ম দিতে গিয়ে মরে যাওয়া মায়ের কষ্ট বুঝতে ওইটুকু তাঁকেকরতেই হবে।

গল্পটি নিয়ে তৈরি নাটকে ছেলেটির, “আমরা হিন্দু বলে মিলিটারি আমাদের বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছিল” সংলাপ শুনলাম। কিন্তু কথা হল, পাকিস্তানের শাসনে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বলে চিহ্নিত ভূখণ্ডে যা যা হত, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই নৃশংসতা চলছে কেন? কেন এ বারের পুজোতেও অষ্টমীর রাতে পুরনো ঢাকার তাঁতিবাজারের পূজামণ্ডপে পেট্রল-বোমা নিক্ষেপ এবং চার-পাঁচ জন মানুষকে ছুরিকাহত হতে হল? মা দুর্গাকে ভিশওয়া সিম্বোর্স্কার কালজয়ী কবিতা ‘ভিয়েতনাম’-এর সেই নারীর মতো মনে হচ্ছিল, যিনি, অন্যান্য প্রশ্নের উত্তরে ‘জানি না’ বললেও ‘ওরা কি তোমার সন্তান’ জানতে চাওয়া হলে বলে ওঠেন ‘হ্যাঁ’।

গত কয়েক মাস ধরে সমতলের হিন্দু এবং পাহাড়ের বৌদ্ধদের উপর অত্যাচারের মাত্রা অনেকখানি বেড়ে গিয়েছে। চাকরি থেকে জবরদস্তি ছাঁটাই কিংবা হিন্দু-বৌদ্ধদের দোকান লুট তো নিত্য দিনের ঘটনা। রাস্তাঘাটে নাকি শোনা যাচ্ছে ‘যাদের হাতে লাল তাগা/ সাদা শাঁখা; তাদের ধরে ভারতে পাঠা’ স্লোগান। অনেকের হাতের মোবাইল কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে তাঁরা কোনও ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেন কি না।

মুশকিল হল, বাংলাদেশের কমবেশি দু’কোটি হিন্দুর অন্তত চার কোটি আত্মীয় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম বা ভারতের অন্যান্য জায়গায় বসবাস করেন। পশ্চিমবঙ্গে বিগত সত্তর বছরে ঘটি-বাঙাল মিশে যাওয়ায় আত্মীয়তার বৃত্ত বড় হয়েছে। অনেক ঘটি বাড়িরও বাংলাদেশে আত্মীয় রয়েছে এখন। এর পর ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের অনেক মানুষ, রামকৃষ্ণ মিশন কিংবা ভারত সেবাশ্রমের শিষ্য, কী করবেন তাঁরা? কথাগুলো সহজ, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে বুঝবার লোকের অভাব প্রকট হচ্ছে। তবে কি সারদা মায়ের সেই বাণী, ‘আমি শরতেরও মা, আমজাদেরও মা’ একেবারে ভেসে গেল তথাকথিত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র ঢেউয়ে?

মুক্তিযুদ্ধের সময় অবর্ণনীয় অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের উপর। ১৯৬৪ সালেই কাশ্মীরের মসজিদ থেকে পবিত্র স্মারক চুরির গুজবে সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা এবং লাখ-লাখ মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে মেরুদণ্ড ধরে নিয়ে যখন ভূমিষ্ঠ হল নতুন দেশ, তখন ধর্মনির্বিশেষে সকলের সমানাধিকারের প্রত্যাশা কি জাগ্রত হয়নি অনেক হৃদয়ে? বছরের পর বছর অনেক বিচ্যুতির শিকার হয়েছে সেই প্রত্যাশা, তবে একেবারে মরে যায়নি। এমনকি দু’বছর আগেও যখন কুমিল্লার ওই দিঘির পাড়ের পুজোকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে দেওয়া বহু দুর্গাপ্রতিমা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, অনেক মন্দিরে ভাঙচুর চলে, বেশ কিছু মানুষের প্রাণ যায়, তখনও প্রতিরোধ তার পাখা বন্ধ করেনি।

কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানকার পরিস্থিতি অনেক বেশি ভয়াবহ। নইলে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিলেন বা পূর্ববঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের বিরুদ্ধে গড়ের মাঠে সভা করেছিলেন, এমন সর্বৈব মিথ্যা এত মান্যতা পায়? ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীত না রাখার বিপুল ব্যস্ততা দেখে ত্রস্ত হতে হয়। ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভেঙে দেওয়া কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ির দখল নিয়ে নেওয়া, রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের নামবদল অথবা লালন সাঁইয়ের অনুসারীদের আখড়াতেও আক্রমণ, সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। মাদ্রাসা ছাত্রদের নেতৃত্বে ভাঙা হচ্ছে চার-পাঁচশো বছরের পুরনো সব সুফি মাজার। শিল্পী রাহুল আনন্দের বাড়ির সহস্রাধিক বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন আরও বেশ কয়েক জন গায়ক-গায়িকা। হয়তো তাই, ওখানকার বিশিষ্ট লেখক এই মুহূর্তের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালীদের চিহ্নিত করেছেন, ‘বঙ্গীয় তালিবানদের উত্থান, উল্লাস আর উন্মাদনার পৃষ্ঠপোষক’ হিসাবে।

রাজনৈতিক পালাবদলের পর প্রথম দু’সপ্তাহেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ চলছিল। এখন তার প্রাবল্য আরও বেড়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রতিটি আক্রমণের ক্ষেত্রেই অছিলা দেওয়া হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অবস্থানের। যেন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করলেই কাউকে খুন করে ফেলা যায়। এ বার অত্যাচারে নতুনত্ব আনার জন্যই কি আওয়ামী লীগ-এর জায়গায় ইসকন-কে বসানো? চট্টগ্রামে অসহায়, বিপন্ন হিন্দুদের প্রহারের সময় অজুহাত দেওয়া হচ্ছে যে, হিন্দুদের নয়, ইসকনের সদস্যদের মারা হচ্ছে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, ইসকনের কথা বাদ দিন, যে রাম ঠাকুর বা বাবা লোকনাথের মুসলমান ভক্ত হিন্দু ভক্তের তুলনায় কম ছিল না, তাঁদের মন্দির বা আশ্রম আক্রান্তহচ্ছে কেন?

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্ত ও ভারতীয় সেনার বলিদানের বিনিময়ে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটির ইতিহাস তাঁরা ‘রিসেট’ করার কাজ নিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিতে চাইছেন স্মৃতি থেকে, তাঁদের কাছে কোনও উত্তর নেই। তাঁদের সঙ্গে বিপজ্জনক সাদৃশ্য পাওয়া যায় একশো বছর আগের আর্মেনীয় গণহত্যার নায়ক ‘তরুণ তুর্কি’দের। বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ তানের আকচাম-এর দি ইয়ং টার্কস ক্রাইম এগেনস্ট হিউম্যানিটি-র পাতায় পাতায় যে আখ্যান নির্মিত হয়েছিল, তাতে ওই গণহত্যার নায়কদের সঙ্গে আজকের অনির্বাচিত সমন্বয়কদের মিল স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তুরস্কে যেমন রাতারাতি বর্ণমালা বদলে দিয়ে গোটা একটা দেশকে নিরক্ষর বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশেও সাংস্কৃতিক বর্ণমালা বদলে দেওয়ার কাজ চলছে ভয়ঙ্কর দ্রুততার সঙ্গে। ভারতের হরিয়ানা বা রাজস্থানে এক জন মুসলমানের উপর কোনও আক্রমণ হলেও তা অন্যায়। মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নও ততটাই অন্যায়, কাশ্মীরে পণ্ডিত বিতারণ যতটা। কিন্তু ওই রকম ঘটনা ঘটেছে বা ঘটে বলে বাঙালি হিন্দু-বৌদ্ধদের মার খেতে হবে কেন? মায়ানমার কিংবা হরিয়ানায় কি রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা হয়?

মনে রাখতে হবে, এত দিন যাকে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ বা ‘বিপ্লব’ বলা হচ্ছিল, শীর্ষস্তর থেকেই এখন বলা হচ্ছে যে তা ‘চমৎকার ভাবে পূর্ব-পরিকল্পিত’। অর্থাৎ, যে নির্বিচার লুটতরাজ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরচিহ্নিত করা নির্যাতন চলছিল, সেও পরিকল্পনা মাফিকই হয়েছে।

সব রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে অপরাধী পাকিস্তানের ‘মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট’ ভোলেনি যে উনিশশো একাত্তরে ‘পদ্মা-মেঘনা বিধৌত ভূখণ্ডে’ ত্রিশ লাখ বাঙালির প্রাণ তারা কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ভোলেনি বলেই, বাঙালি সংস্কৃতিহীন দেশ বানাতে আজও তৎপর তারা, লক্ষ-লক্ষ শহিদের স্মৃতিকে অপমান করে মহম্মদ আলি জিন্নার স্মরণানুষ্ঠান করাচ্ছে বাংলাদেশে। কাগজে না হলেও মগজে ফিরিয়ে আনছে ‘পূর্ব পাকিস্তান’।

সেই পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-বৌদ্ধদের জন্য বৃষ্টি নেই, কেবলই আগুন। কোনও নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে তা নেবানো সম্ভব নয়, যদি না নতুন কোনও সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর হাতে হাত মিলিয়ে নতুন জাহানারা ইমাম, নতুন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নতুন রফিক-বরকত-সালাম-জব্বররা রুখে দাঁড়ান।

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Non Muslim minorities minorities Religious minority Hindus Religious Discrimination Religious Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy