সমাজমাধ্যমের জনপ্রিয়তা যত বাড়ছে, বাড়ছে ট্রোল-এর প্রতাপও। কম বেশি সকলেই এর সমালোচনা করি। কিন্তু একটু ভেবে দেখবেন তো, কেউ যখন ট্রোলের শিকার হন, কখনও কি হঠাৎ মনে হয়েছে— “ঠিক হয়েছে ট্রোল্ড হচ্ছে!” অথবা কোনও তারকার তথাকথিত ‘খোলামেলা’ ছবির নীচে ট্রোলদের বক্তব্য দেখে মনে হয়েছে— বেশ হয়েছে?
জার্মান ভাষায় ‘শাড্নফ্রয়ডা’-র অর্থ ‘অন্যের দুর্ভোগে আনন্দ পাওয়া’। এ এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে এক জন অন্যের হেনস্থা বা কষ্ট দেখে গোপনে বা প্রকাশ্যে আনন্দ উপভোগ করেন। ডিজিটাল যুগে, এই ‘শাড্নফ্রয়ডা’-র প্রকাশ্য মঞ্চ সমাজমাধ্যম। মনোবিজ্ঞানীরা এই মানসিক অবস্থাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। কেউ ট্রোলের শিকার হলে তাঁর সঙ্গে নিজের এক ধরনের তুলনা চলে। মনে করা হয়, যিনি ট্রোলের শিকার, তাঁর তুলনায় নিজে অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থানে রয়েছেন। এতে আত্মতুষ্টি হয়। যিনি ট্রোলের শিকার, তিনি কারও মতে হয়তো খুবই অহঙ্কারী। তাই তাঁর মনে হয়, উচিত শাস্তি পাচ্ছেন। তাতে তিনি পুলকিত হচ্ছেন এবং ট্রোলদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। সামাজিক অবস্থানের হেরফেরও ট্রোলিং-এর প্রবণতা বাড়ায়। যাঁর কাছে হয়তো কোনও দিন পৌঁছনোই যাবে না, তাঁকে খোলামেলা সমাজমাধ্যমে কথার চিমটি কাটাতেও আনন্দ পান অনেকে।
মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার জেমিমা রড্রিগস মাঠে শুয়ে কেন জয় উদ্যাপন করছেন, সেই নিয়ে শুরু হয়েছে ট্রোল। জেমিমার কৃতিত্ব, প্রতিভা বাদ দিয়ে এক দল তাঁর কী করা উচিত তাই নিয়ে শুরু করেছে নীতিপুলিশি। অবশ্য এর আগেও জেমিমা কুৎসিত ট্রোলিংয়ের শিকার হয়েছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী বলেছেন, “ট্রোলের উপরে রাগ করা মানে রাগের অপচয়।” (৩০-১০) ঋত্বিক ট্রোলের বুদ্ধিদীপ্ত পাল্টা জবাবও কোনও কোনও সময় দেন। কিন্তু সকলে হয়তো এমন দিতে পারেন না। অজস্র ডিজিটাল চিমটির উত্তর দেওয়া সম্ভবও নয়। কেউ কাউকে মুখোমুখি চেনে না। কেন আক্রোশ তৈরি হল কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাও অজানা। কম্পিউটারের অথবা ফোনের বোতাম টিপে টিপে চলছে আক্রমণ। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক তরফা। ইচ্ছাকৃত ভাবে উস্কানিমূলক, আক্রমণাত্মক মন্তব্য পোস্ট করে অন্যদের মনে বিরক্তি, রাগ বা দুঃখ সৃষ্টি করার অভ্যাস।
ফলে ট্রোলের শিকার হলে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা গ্রাস করতে পারে অনেককেই। অন্যের দুর্ভোগে আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা সমাজে সহানুভূতির অভাবকে বাড়িয়ে তুলছে এবং ভার্চুয়াল জগৎকে আরও বিষাক্ত করে তুলছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় যায় যে, ট্রোলিং অনলাইন আলোচনাকে অপ্রাসঙ্গিক, আক্রমণাত্মক এমনকি অর্থহীনও করে তোলে। ফলে গঠনমূলক আলোচনাও কোনও কোনও ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কোনও ট্রোল যাকে অনলাইনে কটু কথা বলছে, হয়তো বাস্তব জীবনে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তাঁকে বিন্দুমাত্র খারাপ কথা বলার সাহস করতে পারে না। কিন্তু সমাজমাধ্যমে অবলীলায় বলে দিচ্ছে।
ইন্টারনেট এসেছে তাই ট্রোলও এসে দাঁড়িয়েছে, এমন কিন্তু নয়। ট্রোলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান লোককাহিনিতে। গবেষকেরা এই ট্রোলের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বর্তমান অনলাইন আচরণের ধ্বংসাত্মক এবং বিরক্তিকর প্রকৃতির সামঞ্জস্য রয়েছে বলে মনে করেন। বাস্তবে টিটকিরি, খোঁচা মেরে কথা বলে আত্মতুষ্টি লাভ— এই সবের উপস্থিতিও যুগে যুগে কালে কালে রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে যে ‘ট্রোল’ করছেন তাঁকে চেনা যায়, বোঝা যায়। ইন্টারনেটে ছদ্মনাম ব্যবহার করার সুযোগ থাকায়, ‘শাড্নফ্রয়ডা’র মতো নেতিবাচক অনুভূতিগুলি প্রকাশ করা আরও অনেক সহজ হয়ে যায়। বাস্তব জীবনে যা সামাজিক ভাবে নিন্দনীয়,তা ভার্চুয়াল জগতে কোনও পরিণতির ভয় ছাড়াই করা যায়।
এঁরা হয়তো জানেন না, বা জানলেও পরোয়া করেন না যে, ট্রোলিং কিন্তু বেআইনি। ভারতে ‘তথ্য প্রযুক্তি আইন’ (২০০০)-সহ বিভিন্ন আইনের আওতায় রয়েছে ট্রোলিং। এই সব আইন অনুযায়ী আপত্তিকর বার্তা পাঠানো, গোপনীয়তা লঙ্ঘন, হয়রানি করাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। জরিমানা থেকে কারাদণ্ড, সবই হতে পারে।
তবে, আইনি পথের ভরসাতেই বা থাকা কেন? ট্রোলিং-এর এই অদ্ভুত নেতিবাচক মানসিকতা ভাঙতে হলে, ব্যক্তিগত জীবনেও সহানুভূতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার অনুশীলন করা প্রয়োজন। সঙ্গে সমাজমাধ্যমের ট্রোলিং-রোধক পদ্ধতি মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন এঁদের ‘ব্লক’ করা। এঁদের বিরুদ্ধে ‘রিপোর্ট’ করা। তবে রিপোর্টে সব সময় সুফল মেলে না। পোস্টের মন্তব্য অংশের ‘নোটিফিকেশন’ সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখাও যায়।
সমাজমাধ্যম আরও বহু পথ হাঁটবে। এই ট্রোলে আগ্রহীরাও থাকবেন। তাই ট্রোলিংয়ের প্রবণতা কমানোর বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। স্কুল, কলেজ এবং অনলাইন ফোরামগুলিতে ডিজিটাল শিষ্টাচার এবং সহানুভূতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার করার সময় এসেছে। বোঝানোর সময় এসেছে ভার্চুয়াল জগতের আচরণে বাস্তব জীবনে প্রভাব পড়ে। সম্পর্ক বিষাক্ত করে তোলে। এর শেষ হওয়া প্রয়োজন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)