Advertisement
১১ মে ২০২৪
Bengali Language

বাংলা ভাষার ব্যবহারটাই জরুরি

তবে, রাজনীতির যা বিপদ, যে কোনও সামাজিক প্রগতিকেই সে কায়েমি স্বার্থের বাক্সে ভরে ফেলতে পারে। বাংলাতেও তা ঘটছে।

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২২ ০৬:০১
Share: Save:

বাঙালি ইদানীং মাতৃভাষা নিয়ে বেশ সচেতন। পথে-ঘাটে ‘কেন কি’ বা ‘খাবার লাগিয়ে দিলাম’ জাতীয় কথা শুনে রে-রে করে ওঠার মতো স্বেচ্ছাসেবক এখন পাওয়া দুষ্কর নয়। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও তার ছোঁয়া। সাম্প্রতিক এক ছবিতে দাম্পত্য কলহের দৃশ্যে নায়কের সংলাপ: “যে ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে, সে ভাষা বলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে হিন্দিতে ‘হাত ধোকে পিছে পড়না’র আক্ষরিক অনুবাদ করতে হচ্ছে, এটা তো ভীষণই বেদনাদায়ক।” মনে হয়, মুখে-মুখেই বাঙালি নাগরিক সমাজে একটা ঐকমত্য তৈরি হয়েছে— হিন্দি আগ্রাসনের সামনে বাংলা ভাষা আজ বিপন্ন।

প্রশ্নটি অতঃপর ক্রমশ পরিচিতির হয়ে উঠছে, তৎসূত্রে রাজনৈতিকও। গত বিধানসভা ভোটের পর সমাজবিজ্ঞানী দীপঙ্কর গুপ্তের মতো অনেকেই বলেছিলেন, ভাষা আর সংস্কৃতিই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-কে হারিয়ে দিল। কী রকম? হিব্রু বাইবেল অনুসারে, পরাজিত এফ্রাইল জনজাতির মানুষ যখন মুক্তির আশায় জর্ডন নদী পার হচ্ছিল, তখন তারা ধরা পড়ে বিজেতা গিলিয়ড অঞ্চলের লোকেদের হাতে। এফ্রাইলদের পরিচয় বুঝে নিতে গিলিয়ড-রা কেবল একটি শব্দ তাঁদের বলতে বলে: ‘শিবোলেথ’। উচ্চারণের ফারাকে ভূমিপুত্র-বহিরাগত শনাক্তকরণ। দীপঙ্কর বলছেন, বিজেপি নেতাদের মুখে ‘খেলা হোবে’, ‘আশোল পোরিবোর্তোন’, ‘পোদ্দোফুল’ ইত্যাকার শব্দ ঠিক ওই শিবোলেথের মতোই কাজ করেছিল। “...বাংলায় ৫৬-ইঞ্চি ছাতি বলতে মহৎ হৃদয় বোঝায় না, বরং তাকে আক্ষরিক অর্থে ধরে বহু মানুষের মনে ধন্দ জেগেছিল। তার বদলে বিজেপি যদি ‘বুকের পাটা’ বা ‘বুক ফুলিয়ে’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করত... অনেক বেশি বাঙালির কাছে ঠিক বার্তা যেত।” অর্থাৎ, মমতাবিরোধী বাগাড়ম্বরে যখন বাঙালির সদ্য মন মজেছে, তখন বাঁকাচোরা বাংলাই অনেকাংশে তার আকর্ষণ চটকে দিল।

তবে, রাজনীতির যা বিপদ, যে কোনও সামাজিক প্রগতিকেই সে কায়েমি স্বার্থের বাক্সে ভরে ফেলতে পারে। বাংলাতেও তা ঘটছে। সচেতন নাগরিকদের একটি অংশ জাতিবাদ বা ‘শভিনিজ়ম’-এর কানাগলিতে ঢুকে পড়ছে। প্রান্তিক হলেও এই প্রতিপাদ্যে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়ে গিয়েছে, যারা সর্বত্র বাঙালির বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী, ‘গুটখাখোর’ দেখলে মারমুখী! হিন্দি জাতিবাদ যে ভাবে ‘ভারতীয়ত্ব’-র নাম করে দেশের অন্যান্য ছোট-বড় ভাষাভিত্তিক জাতিকে গিলে ফেলতে চায়, এ রাজ্যের ছোট ছোট ভাষার ক্ষেত্রে বাংলার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার চরিত্রও প্রায় তেমন। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র ভারতের মূল পরিচয় তার বহুভাষায়, তার গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বহুভাষার আকাঙ্ক্ষাতেও আঘাত করা চলবে না। হিন্দির বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে কেউ মাতৃভাষার জন্য লড়াই করতেই পারেন— তা অতি জরুরিও— কিন্তু তার রাজনৈতিক ভাষ্যটি যেন পাল্টা আগ্রাসী না হয়।

প্রশ্ন হল, তা হলে কী ভাবে হিন্দি ঠেকাব এবং বাংলার জন্য লড়ব? তার জন্য জানা দরকার, সংবিধানের দ্বাদশ খণ্ডের প্রথম অধ্যায়ের ‘ল্যাঙ্গোয়েজেস অব দি ইউনিয়ন’ অংশে ৩৪৩ থেকে ৩৫১ ধারার মধ্যে ভারতীয় ভাষাগুলোর একটা ক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। এক, প্রশাসনিক ভাষা (‘অফিশিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ’), যা হল হিন্দি ও ইংরেজি। দুই, আঞ্চলিক ভাষা, যেগুলি রাজ্য স্তরের সরকারি ভাষা, যেমন বাংলা মরাঠি তামিল অসমিয়া ইত্যাদি। তিন, ‘গণতন্ত্র’-এর ভাষা, অর্থাৎ মানুষ যে সব ভাষায় রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করতে পারে। অন্য দিকে, সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ৩৪৪(১) এবং ৩৫১ ধারায় এখনও পর্যন্ত ২২টি ভাষাকে জাতীয় ভাষা বা ‘ন্যাশনাল ল্যাঙ্গোয়েজ’-এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাতে বাংলা ও হিন্দি দুই-ই আছে। সরকারি ভাবে, পাপুয়া নিউ গিনি (৮৪০), ইন্দোনেশিয়া (৭১০) এবং নাইজিরিয়া-র (৫২৪) পরেই ভারতের ভাষা-সংখ্যা: ৪৪৭। আবার, ভাষাবিজ্ঞানের নিরিখে সর্বোচ্চ স্থানে আছে দুই জাতীয় ভাষা (হিন্দি ও ইংরেজি), তার পর তফসিলভুক্ত ভাষা, অতঃপর ব্যাপক ব্যবহারের ভাষা অর্থাৎ যা শিক্ষার মাধ্যম, শিক্ষার বিষয় বা সংবাদমাধ্যমে ব্যবহৃত, এবং শেষে স্থানীয় গৌণ ভাষা যেখানে ভাষারূপের সংখ্যা প্রায় ২০০, শুমারি-উল্লিখিত ‘মাতৃভাষা’ দেড় সহস্রাধিক। তা হলে কী দাঁড়াল? হিন্দি ও বাংলা দু’টিই আমাদের সংবিধানস্বীকৃত জাতীয় ভাষা। নিজ নিজ স্তরে তারা সরকারি ভাষাও, তবে হিন্দির ক্ষেত্র যে হেতু কেন্দ্রীয় এবং বাংলার প্রাদেশিক, তাই সামাজিক ভাষাক্রমে হিন্দি উপরে, যেমন ইংরেজি। ঠিক এ ভাবে তফসিলভুক্ত ভাষা হয়েও বাংলার নীচে সাঁওতালি, কেননা তা রাজ্য স্তরের প্রথম সরকারি ভাষা নয়। সুতরাং, বাংলার পক্ষ নেওয়া লড়াকুরা যখন প্রচার করবেন ‘হিন্দি আমাদের জাতীয় ভাষা নয়’, তখন তাঁদের বলতে হবে যে, ২২টা ভাষাই আমাদের জাতীয় ভাষা, তাদের মর্যাদাও সমান, কেউ বেশি বা কম ভারতীয় নয়।

আরও একটা বিপদ, হিন্দিগন্ধী বাংলায় যাঁদের বিরাগ, তাঁরা কিন্তু ছেলেমেয়েকে ‘গুয়াভা খাও’, ‘ওই দেখো এলিফ্যান্ট’ বা ‘জাম্প করো’ জাতীয় শব্দবন্ধ শিখিয়ে চলেছেন। এ-ও কিন্তু আগ্রাসন। এক ভাষা যখন আর এক ভাষাকে গিলে ফেলে, তখন সে কাজটা শুরু হয় নামপদ দিয়েই। উনিশ শতকে আরবি-ফারসি প্রভাব সরিয়ে বাংলাকে সংস্কৃতায়িত করার কাজটিও এ ভাবেই শুরু হয়েছিল। ভাষাবিজ্ঞানী পেগি মোহন ‘হিংলিশ’ (হিন্দি+ইংলিশ)-কে প্রায় আলাদা ভাষা হিসেবে দেখিয়েছেন। তার ব্যাকরণগত কাঠামো হিন্দির হলেও শব্দকোষ ইংরেজিতে ঢেকে গিয়েছে। সমস্যা হল, হিন্দির আক্রমণ দেখলেও যাঁরা ইংরেজিরটা দেখেন না, তাঁদেরও নিজস্ব যুক্তি আছে। ইংরেজি পৃথিবীস্বীকৃত জ্ঞানের ভাষা, তার হাত ধরেই আমাদের অগ্রগতি, তা বাদ দিলে চলবে? আর, বাংলায় ভাল লেখাপড়ার উপকরণই বা কোথায়? এর জবাবে এটুকু বলা যায় যে, উনিশ শতকে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনার গুরুত্ব স্বীকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্রের সাধুবাদ পেয়েছিল। বঙ্কিম নিজেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে তা বাতিল হয়ে যায়। বাংলায় ভাল লেখাপড়া তো তখনই হবে, যখন ভাবব যে সে ভাষায় লেখাপড়া করা যায়। আসলে বিশেষ ভাষাকে অভিযুক্ত করা নয়, স্বভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করাই জরুরি কাজ। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলি, “কিছু একটা করবার জন্য ডাক দেওয়াটা শক্ত। সহজ হচ্ছে না করবার দিকে ডাক দেওয়া।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Language Hindi Language
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE