আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে, দুঃখসুখের-ঢেউ-খেলানো এই সাগরের তীরে।” তিন বছর আগে ঢাকায় পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তথা সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাগুলি আবৃত্তি করার সময় কয়েকটি শব্দ বদলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে, দুঃখসুখের-ঢেউ-খেলানো পদ্মা নদীর তীরে।’
গোটা বাংলাদেশ সে সময় পদ্মা সেতু নিয়ে আবেগে উত্তাল। দেখছিলাম, ঢাকায় বহু মানুষ সেতু উদ্বোধনের ১২৭ বছর আগে লেখা রবীন্দ্রনাথের ‘পদ্মা’ কবিতা আবৃত্তি করছেন, ‘কতদিন ভাবিয়াছি বসি তব তীরে, পরজন্মে এ ধরায় যদি আসি ফিরে, যদি কোনো দূরতর জন্মভূমি হতে, তরী বেয়ে ভেসে আসি তব খরস্রোতে’। রবীন্দ্রনাথের পরজন্মে পদ্মার তীরে ফিরে আসার আকুতি বারবার আলাপ-আলোচনায় ঘুরে-ফিরে আসছে। ঢাকার মানুষের এই যে আলাপ-আলোচনা, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবেগের বহিঃপ্রকাশ, তা কোন ভাষায় ছিল? বাংলায়? না কি বাংলাদেশিতে?
যাঁরা ঢাকায় গিয়েছেন, তাঁরা জানেন, ঢাকা শহরের মুখের ভাষার সঙ্গে কলকাতার মানুষের মুখের ভাষার বিশেষ ফারাক নেই। কিছু ভাবের প্রকাশ অবশ্যই আলাদা। কলকাতায় কেউ ইলিশ খেয়ে ‘ভাল লেগেছে’ বললে ঢাকার মানুষ বলবেন, ‘মজা হয়েছে’। এমন কিছু ব্যতিক্রম বাদে সিংহভাগই এক। ঢাকায় অফিস-কাছারিতে কেউ নোয়াখাইল্লা, বরিশাইল্লা বা সিলেটিতে কথা বলেন না। কেউ বললে, তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টাও হতে পারে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশে একটি বিজ্ঞাপন খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। ঢাকায় বাসে, শপিং মলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ চাটগাঁইয়া বা ফরিদপুইরাতে কথা বললে, তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা হচ্ছে। এই মানসিকতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপনের বার্তা ছিল, কথা বলতে লজ্জা কিসের? এ তো মায়ের ভাষা!
প্রশ্ন হল, তা হলে বাংলাদেশি ভাষা কোনটা? ঢাকা শহরের তথাকথিত আধুনিক বাংলা? না কি নোয়াখাইল্লা, বরিশাইল্লা বা সিলেটি?
দিল্লি পুলিশের লোদী কলোনি থানা কয়েক জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে পাকড়াও করেছে। তাঁদের কাছে ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় যে সব সরকারি নথি মিলেছে, তা অনুবাদ করতে সাহায্য চেয়ে থানার অফিসার দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথিশালা বঙ্গভবনে চিঠি পাঠিয়েছেন।দিল্লি পুলিশ অমিত শাহের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এমন হাতিয়ার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতছাড়া করেননি। তিনি স্বাভাবিক নিয়মেই বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে অপমান করার অভিযোগ তুলেছেন।
ধরা যাক, দিল্লি পুলিশের এত দুরভিসন্ধি ছিল না। পুরোটাই অজ্ঞতা। পুলিশ সত্যিই মনে করেছে, বাংলা ও বাংলাদেশি আলাদা ভাষা। বাংলাদেশের সরকারি নথিতে নাম-ধামও হয়তো সিলেটি বা বরিশাইল্লাতে লেখা রয়েছে! যদি তা-ই হবে, তা হলে সেই ‘বাংলাদেশি ভাষা’ অনুবাদের জন্য দিল্লির বাংলাদেশ হাই কমিশনের বদলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গভবনের সাহায্য চাওয়া হল কেন?
মুশকিল হল, এর পরে অমিত শাহের দিল্লি পুলিশকে বাঁচাতে বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় মাঠে নামলেন। দাবি করলেন, বাংলাদেশি ও বাংলা বাস্তবেই আলাদা ভাষা। ভারতের বাঙালিরা সিলেটি বোঝেন না। আরও এক ধাপ এগিয়ে দাবি করলেন, ‘বেঙ্গলি’ বা বাংলা বলে কোনও ভাষাই নেই। প্রসঙ্গত বলা থাক, অমিত মালবীয় শুধু বিজেপি আইটি সেলের প্রধান নন। তিনি বহু বছর ধরে বিজেপির সংগঠনে পশ্চিমবঙ্গের সহ-ভারপ্রাপ্ত নেতা। অথচ তাঁর জানা নেই, বাগবাজার ও বাঁকুড়ার মানুষের কথার উচ্চারণ ও টান আলাদা। তা বলে ভাষাটা আলাদা হয়ে যায় না।
বিজেপির আইটি সেলের প্রধান ভুলে যেতেই পারেন, এই বাংলা ভাষার উপরে জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধেই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। সেই ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতেই ২১ ফেব্রুয়ারি গোটা বিশ্ব জুড়ে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস পালিত হয়। কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন কী ভাবে যে গত বছর অক্টোবরেই নরেন্দ্র মোদীর সরকার বাংলাকে ‘ধ্রুপদী’ ভাষার তকমা দিয়েছে?এই স্মৃতিবিলোপ, অজ্ঞতা বা মূর্খামি, যা-ই বলুন না কেন, তার ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রের পরে পশ্চিমবঙ্গেও ভাষা নিয়ে রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার বোকামি করেছে বিজেপি।
আসলে সমস্যাটা অন্যত্র। বিজেপির এই আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে অজ্ঞতার কারণ, হিন্দি নিয়ে বিজেপি, বিশেষত আরএসএসের মোহগ্রস্ত হয়ে থাকা। বাংলা-তামিল-মরাঠিকে নস্যাৎ করা ও হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়া, একই মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ। অমিত শাহ এখন হিন্দির পক্ষে নিয়মিত সওয়াল করেন। এও বলেন, অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে ইংরেজি বলিয়ে-কইয়েরা লজ্জা বোধ করবেন। যদিও বিজেপির তাবড় নেতা-মন্ত্রীদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেই পড়াশোনা করে। হিন্দি বলয়ে রাজনৈতিক সাফল্যে অনুপ্রাণিত বিজেপি নেতৃত্ব মনে করেন, উত্তর ভারতের সীমানা ছেড়ে পূর্ব ও দক্ষিণে হিন্দি যত ছড়াবে, ততই বিজেপির সাম্রাজ্য বাড়বে। আরএসএসের ‘গুরুজি’, দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর মনে করতেন, ইংরেজি ভারতীয় ভাষা নয়। হিন্দিকে দেশের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রাধান্য দিতে হবে। যত দিন না সংস্কৃত যোগাযোগের ভাষা হয়ে ওঠে। ষাট বছর আগে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, এক দিন সংস্কৃত ভারতের যোগাযোগের ভাষা হয়ে উঠবে। বর্তমান সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত গত সপ্তাহেও সেই একই স্বপ্নের কথা বলেছেন। আরএসএসের এই ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতিরমেলবন্ধনের ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ হল, ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’। গোটা হিন্দুস্থানের একটাই ধর্ম, হিন্দু, একটাই ভাষা, হিন্দি। মোদী সরকারের তৈরি ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’-র মাধ্যমে এই ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’-এর মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেবিরোধীদের অভিযোগ।
গোলওয়ালকর বরাবরই তামিল ও দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের সমালোচক ছিলেন। তামিল ভাষা-সংস্কৃতির নিজস্বতার দাবি তাঁর পছন্দ ছিল না। তাৎপর্যপূর্ণ, এই নরেন্দ্র মোদী-মোহন ভাগবতের জমানাতেও তামিলনাড়ুতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা সবচেয়ে প্রবল। বাংলাকে বাংলাদেশি ভাষা বলার বিরোধিতাতেও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন সরব হয়ে বলেছেন, এ হল বিজেপির অ-হিন্দি ভাষার উপরে আক্রমণ। বিজেপির ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্রকে নস্যাৎ করে দেওয়ার মানসিকতার প্রতিফলন। যে ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত লেখা হয়েছে, সেই ভাষার অপমান। দক্ষিণের রাজ্য কেরলেও কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দি জানাকে অগ্রাধিকার দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছে। কর্নাটকেও প্রশ্ন উঠেছে, কেন হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে তুলে ধরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? উত্তর-পূর্বে আগেই হিন্দি ভাষা চাপানো নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। মহারাষ্ট্রে স্কুলে হিন্দি ভাষাকে তৃতীয় ভাষা হিসেবে শেখানো বাধ্যতামূলক করতে গিয়ে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েছে সে রাজ্যের বিজেপি সরকার। এই হিন্দির বিরোধিতার মঞ্চকে কাজে লাগিয়ে মরাঠি অস্মিতার মন্ত্রে দুই বিবদমান খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাই উদ্ধব ও রাজ ঠাকরে আবার হাত মিলিয়েছেন।বিজেপি কি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে একই ভাবে তৃণমূলের হাতে ‘বাঙালি অস্মিতা’-র ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিল?
হয়তো। হয়তো নয়। তার উত্তর সময় দেবে। তবে হিন্দিতে মোহগ্রস্ত হয়ে থেকে বাংলা, মরাঠি, তামিলকে নস্যাৎ করতে বসা বিজেপিকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ২০১১-র জনগণনায় দেখা গিয়েছিল, সেই সময়ের ১২১ কোটি জনসংখ্যার ৫২.৮ কোটি হিন্দিভাষী। তবে তার মধ্যে ভোজপুরি, ছত্তীসগঢ়ি ও কুমাউনি ভাষাভাষী ২০.৬ কোটি মানুষও রয়েছেন। এই সব ভাষাকেও হিন্দির প্রকারভেদ হিসেবে ধরা হয়েছিল। তা বাদ দিলে হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা ৩২ কোটিতে নেমে যায়। জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ।
অমিত মালবীয়র জন্ম উত্তরপ্রদেশের ইলাহাবাদে, অধুনা প্রয়াগরাজে। এই উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমের গাজিয়াবাদ থেকে পূর্বের গোরক্ষপুর পর্যন্ত রাস্তা ধরে গেলে দেখা যাবে, প্রতি ৫০ কিলোমিটার অন্তর হিন্দির ধরন, উচ্চারণ, টান বদলে যাচ্ছে। মথুরা, লখনউ, বারাণসীর স্থানীয় মানুষের হিন্দির অনেক ফারাক। খড়ি বোলি, ব্রজভাষা, বুন্দেলি, কনৌজি, হরিয়ানভি, বাঘেলি, অবধি এবং হিন্দি-উর্দুর মিশ্রণে তৈরি হিন্দুস্থানি— হিন্দির নানা রূপ। বলিউডের সিনেমা দেখে হিন্দি শেখা অনেকেরই এ সব বুঝতে অসুবিধা হবে। তা হলে কি হিন্দি বলেও কোনও ভাষা নেই? না কি এ বার হিন্দি ও হিন্দুস্থানি আলাদা ভাষা বলে দাবি করবে বিজেপি!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)