Advertisement
E-Paper

কালো যদি মন্দ হবে...

সাদার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এই সমাজমনকে কে বোঝাবে, এই ‘ফেয়ার’-এর মধ্যে নিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই— গোটাটাই একটা আরোপিত পক্ষপাতিত্ব। তা অমানবিক, অন্যায়। ‘আনফেয়ার’।

শ্রীদীপ

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ০৬:২৮
Share
Save

আমাদের সমাজ কথায়, আচরণে, আকারে-ইঙ্গিতে প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেয়, সাদার অধিকার অপ্রতিরোধ্য, সাদাই সোহাগযোগ্য। সাদা তথা ফর্সা হওয়ার স্বপ্ন আমাদের যেন মজ্জাগত, আর তার অফুরন্ত জোগাড় ও আহ্বানও বাজারের প্রতি কোণে। সাদা-প্রীতি নিয়ে আমাদের কোনও রাখঢাক নেই। শ্বেত-লালসা এমনই চরম মাত্রায় আমাদের মনে বিরাজমান যে, তা নিয়ে বিব্রত হওয়ার দায় একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গের। বিয়ের পছন্দে, বিজ্ঞাপনে, চলচ্চিত্রে, পোশাকে. দেওয়ালের রং নির্বাচনে— সর্বত্রই যাহা ফর্সা তাহাই সুদর্শন, অনুকূল, সৎ, স্বীকৃত, পবিত্র। সাদার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এই সমাজমনকে কে বোঝাবে, এই ‘ফেয়ার’-এর মধ্যে নিরপেক্ষতার লেশমাত্র নেই— গোটাটাই একটা আরোপিত পক্ষপাতিত্ব। তা অমানবিক, অন্যায়। ‘আনফেয়ার’।

সাদাই সদা সত্য, সাদাই আদর্শ— এই সামাজিক ধারণাটি বিভেদ সৃষ্টি করে, বিভেদকে উৎসাহ দেয়। সমাজ এই পার্থক্য চাগিয়ে রেখে বিভাজন গড়ে তুলেছে, তাকে জিইয়ে রেখেছে। তুচ্ছ সব প্রাকৃতিক পার্থক্যকে সামাজিক অনুক্রমে পরিণত করাই বৈষম্যের মূলমন্ত্র। আর্যরা সাদা, দস্যুরা কালো; নামজাদা রাজারা সাদা, নাম না-জানা প্রজারা কালো; দখলদার সাহেব সাদা, উপনিবেশবাসী কালো; ইউরোপ সাদা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া কালো; মালিক সাদা, মজদুর কালো। সর্বোপরি: ‘সভ্য’রা সাদা; ‘অসভ্য’রা কালো। সাদার অধিষ্ঠান উপরে, সাদা বিজয়ী, বড়; কালো পরাজিত, ছোটলোক।

জনপ্রিয় প্রতিনিধিত্বের নিরিখেও এই সমীকরণ সত্য— নায়ক সাদা, খলনায়ক কালো। ভৃত্যস্থানীয় ও গরিব মানুষ কালো; জনজাতি, দলিত কালো। কালো বঞ্চিত, নির্যাতিতের রং, শাসিত ও শোষিতের রং— সাদা সেখানে ক্ষমতার। সাদার তত্ত্ব জুড়ে রয়েছে সহস্র শতাব্দীব্যাপী আধিপত্যের ইতিহাস। সাদাকে তোল্লাই দিয়ে প্রসাধন বেচছে যে কোটি কোটি টাকার পুঁজি, সেই আকাঙ্ক্ষিত ঔজ্জ্বল্যের স্তম্ভ গড়ে উঠেছে কালোকে সামাজিক ভাবে কলুষিত করার আয়োজনে। কালো মানেই ‘কলঙ্ক’, হীনম্মন্যতা— সাবান-ক্রিম ডলে সাদার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা, তার মতো দেখতে হতে চাওয়া। কালো মানে তাই সাদা হওয়ার বিপুল পরিশ্রমও। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই পরিশ্রমের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নারীর উপরে। সাদার মাপকাঠি দিয়ে পুরুষতন্ত্র ও তার নির্মিত বাজার মেপেছে ও এখনও মাপছে— নারীর মর্যাদা, যোগ্যতা, আকর্ষণ ও বিয়ের দর। ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে স্বচ্ছ ত্বকের প্রতি প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন অনুরক্তির ভূরি ভূরি উদাহরণ। কালো মেয়ের সামাজিক বঞ্চনার অন্ত নেই আজও।

রঙের এই আরোপিত বৈষম্য আসলে যত না শারীরিক, তারও অনেক বেশি সামাজিক। জন্মগত রঙের পার্থক্য সামাজিক বিভাজনের মানদণ্ড। তা এক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতাও, কারণ সাদার হুঙ্কার সমাজকে বুঝিয়ে ছেড়েছে যে সাদা মানেই সম্ভাবনা— জীবিকার, যৌবনের উল্লাসের। সাদা মানেই অঢেল সুযোগ, আর কালো মানেই নিরাশা, ব্যর্থতা, উপেক্ষা, পিছিয়ে পড়া। পারিবারিক সামাজিক অনুষ্ঠানে চার পাশে কান পাতলেই শোনা যাবে এ-হেন প্রশংসা: “আহা, কী গায়ের রং, আলো যেন পিছলে পড়ছে!” শুভ অনুষ্ঠানে কালো পোশাক অবধি ব্রাত্য। সোনার ছেলে, সোনার ফসল, সোনার বাংলা— একটাও কালচে নয় আমাদের কল্পনাতেও। খেলার পুতুল থেকে রূপকথার রাজকুমারী, সবাই সাদা। এ সব যে নেহাত কাকতালীয় নয়, তা-ও ভাবি না আমরা।

সাদার মোহ এতটাই দৃঢ় যে তার বিপ্রতীপে কালোর ছায়া স্রেফ মানুষকে ছাড়িয়ে প্রলম্বিত হয়েছে আরও অনেক কিছুতেই। তাই কালো আরও অনেক কিছুই খারাপের তালিকায়। সমাজের বহু অপ্রীতিকর ব্যাপারকেই আমরা কালো বলে চিহ্নিত করি— কালো বাজার, কালো টাকা। অপ্রিয় শাসকের কালো হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে মিছিল নামে পথে; কালো পতাকা দেখিয়ে বলা হয় ‘গো ব্যাক’! সমাজের বহু অবাঞ্ছিত বস্তু, প্রথা, স্থান-কাল-পাত্রের উপসর্গে কালো। সাদার একচ্ছত্র আধিপত্যে ধূসরতার মাত্রা এতই ক্ষীণ যে প্রতিরোধকারীদেরও মনে করিয়ে দিতে হয়, কালো হলেও তারা মানুষ। তাদেরও জীবনের মূল্য আছে। আর মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় শোনা সেই অমোঘ সত্যগর্ভ গান— ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দো ক্যানে?’

সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dark fair Society

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}