E-Paper

একনায়কের নতুন অস্ত্র

প্রজাপতির প্রভাব বলে একটা কথা আছে। পৃথিবীর এক কোনায় এক প্রজাপতির ডানার দোলায় পৃথিবীর আর এক প্রান্তে ঝড় উঠতে পারে। হাওড়ার দাশনগরে কোনও গন্ডগোল হলে নিউ ইয়র্কের পথচারীরা রাস্তার গর্তে পড়ে যেতে পারেন।

মোহিত রায়

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৪৫
ভান্ডারি: বিরল মৃত্তিকা খননকারী শ্রমিকদের দূরচিত্র, মঙ্গোলিয়া, চিন, ১৬ জুলাই ২০১১।

ভান্ডারি: বিরল মৃত্তিকা খননকারী শ্রমিকদের দূরচিত্র, মঙ্গোলিয়া, চিন, ১৬ জুলাই ২০১১। ছবি: রয়টার্স।

অধিকাংশ সময়েই উপাদানের বিরলতা ব্যঞ্জনার গভীরতাকে অভ্যর্থনা করে আনে। সেই বিরলতাকে কেউ-বা বলে শূন্য, কেউ পূর্ণ ব’লে অনুভব করে।”— ঠিক একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা এখন নতুন ব্যঞ্জনায় ফিরে এসেছে বিরল মৃত্তিকা বা রেয়ার আর্থ বণিজ্য নিয়ে। যে বিরলতাকে শূন্য ভেবেছিল বাকি বিশ্ব, পূর্ণ ভেবেছিল চিন। ফলে আজ বিশ্ব রাজনীতি অর্থনীতির নতুন অস্ত্র বিরল মৃত্তিকা।

প্রজাপতির প্রভাব বলে একটা কথা আছে। পৃথিবীর এক কোনায় এক প্রজাপতির ডানার দোলায় পৃথিবীর আর এক প্রান্তে ঝড় উঠতে পারে। হাওড়ার দাশনগরে কোনও গন্ডগোল হলে নিউ ইয়র্কের পথচারীরা রাস্তার গর্তে পড়ে যেতে পারেন। আসলে নিউ ইয়র্কের ফুটপাতের ম্যানহোলের ঢাকনা তৈরি হত হাওড়ার দাশনগরে। কোনও গন্ডগোলের জেরে সেখান থেকে সরবরাহ বন্ধ হলেই নিউ ইয়র্কে ঝামেলা। কেন এমন হত, তা বোঝা সহজ। কাঁচামাল, শ্রমিকদের বেতন অনেক কম। কর্মস্থলের সুরক্ষা ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নিম্নমানের। যে ভাবে বাংলাদেশের জামাকাপড় পশ্চিমে দেদার বিকোয়, শুধু পুড়ে যায় বহুতল বস্ত্র কারখানা।

দেশে দেশে এ ভাবেই বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু তা রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠলে বিপদ বাড়ে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর পশ্চিম এশিয়ার তেল হয়ে উঠেছিল আরব দেশগুলির হাতিয়ার। এখন আবার একই পরিস্থিতি বিরল মৃত্তিকা বা রেয়ার আর্থ বাণিজ্য নিয়ে। বিশ্বের এই বিরল সম্পদের প্রায় সবটাই চিনের অধীনে, যার প্রাচীরে ঠেকে সব গণতন্ত্র, মানবাধিকার বিফল হয়ে ফিরে আসে।

রসায়নের পুস্তকে মৌল পদার্থগুলিকে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী সাজানো হয়েছে পর্যায় সারণিতে। সারণির রূপটিকে সংবদ্ধ করতে ১১৮টি মৌলের ৮৯টি মৌল এক-একটি ঘর নিয়ে বসে আছে। কিন্তু বাকিগুলির জন্য বরাদ্দ দু’টি ঘর। এর প্রথম ১৪টি মৌল রয়েছে এক সঙ্গে, ৫৭ থেকে ৭০ পারমাণবিক সংখ্যা। এদের এক কথায় বলা হয় ল্যান্থেনাইডস আর এদেরই বলা হয় বিরল মৃত্তিকা, মৌল বা রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস। বিরল মৃত্তিকা সব যে বিরল তা নয়। কিন্তু বিভিন্ন ধাতুর সঙ্গে এরা অতি স্বল্প পরিমাণে যুক্ত থাকে এবং এগুলিকে আলাদা করে নিষ্কাশন খুব কঠিন ব্যাপার। এ নিয়ে দীর্ঘ দিন খুব একটা চিন্তাভাবনা ছিল না। পরিকাঠামো, যানবাহন ইত্যাদি নির্মাণে আমাদের দরকারি ধাতু লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম— এ সব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু গত কয়েক দশকে বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন জগতের এক নতুন বিবর্তনে বিরল মৃত্তিকারা গুরুত্বে উঠে এল।

আজকের পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের নির্মাণ নির্ভর করছে এর উপর। সে দিন একটি পরিবেশ সংক্রান্ত সভায় গিয়েছিলাম। সবাই উন্নয়নকে বেশ গালমন্দ করছেন। এই উন্নয়ন-বিরোধী চকচকে ছেলেমেয়েরা সব ঝকঝকে মোবাইল ফোন ব্যবহারে পারদর্শী। তাদের জীবনযাত্রার অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই মোবাইল ফোনে লাগে এই সব বিরল মৃত্তিকা মৌল— মোবাইল ফোনের স্পিকার, ইয়ার ফোন থেকে উজ্জ্বল স্ক্রিন সবেতেই। এই মৌলগুলির একটি বিশেষ গুণ হল এরা খুব শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে অপরিহার্য। আজকের বিশ্বে যখন পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎচালিত মোটর গাড়ি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, মৃত্তিকাগুলির চাহিদাও সহজবোধ্য। অনেকের মতে, তেল নয়, এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হয়ে উঠেছে এই বিরল মৃত্তিকার জোগান।

এ-হেন বিরল মৃত্তিকার দুনিয়ায় চিন একাই সম্রাট— এর খননের ৭০ শতাংশ তার দখলে এবং তার ৯০ শতাংশ ও দেশে পরিশোধিত হয়। চিন নিয়োডাইমিয়াম দিয়ে তৈরি শক্তিশালী চুম্বকের ৯২ শতাংশ তৈরি করে যা লাগে ডুবোজাহাজ থেকে টেসলার বৈদ্যুতিক গাড়ির নির্মাণে। আকর পরিশোধন করে বিরল মৃত্তিকার বিভিন্ন মৌলকে আলাদা করে নিষ্কাশন একটি জটিল ব্যয়সাধ্য পদ্ধতি। গত তিন দশকে বিপুল গবেষণা করে চিন এখন এই প্রযুক্তিতে শীর্ষে। অবশ্য তিন দশক আগে আমেরিকাতেই শুরু হয়েছিল বিরল মৃত্তিকার খনন ও নিষ্কাশন। সেখান থেকেই প্রযুক্তি শেখে চিন, শুরু করে তার নিজস্ব যাত্রা। বিরল মৃত্তিকার বাজারের মূল্য তখন সামান্যই, কিন্তু চিন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার শুরু করল। পরিবেশগত হইচইয়ের জেরে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমেরিকার একমাত্র বিরল মৃত্তিকার খনিটি বন্ধ হয়ে যায়। যে আমেরিকা এক সময় ধাতু, কয়লা খনন আর ধাতুবিদ্যার গর্ব নিয়ে শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল, আজকের পশ্চিমে সেই ধাতুশিল্প একটি ঘৃণিত দূষিত শিল্প। যে ভাবে হাওড়ার দাশনগরে চলে এল ম্যানহোল বানানোর বরাত, ঠিক তেমনই বিরল মৃত্তিকার পরিশোধনের নোংরা কাজটি ছেড়ে দেওয়া হল চিনের হাতে। চিন অবশ্য শুধু নোংরা কাজটিই করেনি, গত তিন দশকে এই পরিশোধনে তারা বিপুল গবেষণার জন্য ব্যয় করেছে, কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কেন্দ্রকে এই কাজে নিযুক্ত করেছে। ফলে এখন তারাই বিরল মৃত্তিকার বিশ্বজোড়া ব্যবহারের একমাত্র নিয়ন্ত্রক।

বিশ্ব বাণিজ্যে বিভিন্ন জিনিসে কোনও কোনও দেশের প্রাধান্য সব সময়ই থাকে, সুতরাং এত চিন্তা কিসের? চিন্তা আসলে অন্যত্র। দেশটা হল চিন যেখানে গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের নামগন্ধ নেই। বিভিন্ন উৎপাদনে, বিশেষত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রণী এই দেশ, কেননা বিরাট সংখ্যক শ্রমিক শ্রেণি সেখানে। তেমনই কমিউনিস্ট সরকারের তাঁদের যথেচ্ছ ভাবে কাজ করানোর ক্ষমতা। চিনে একটিই সরকার অনুমোদিত শ্রমিক ইউনিয়ন, অর্থাৎ শ্রমিকদের দাবিদাওয়া সবই সরকার-নির্ভর। সেখানে নামে একটি পার্লামেন্ট আছে বটে, কিন্তু তাতে বিরোধী দল নেই, বিরোধী নেতা নেই। ফলে চিন নামক সুদৃশ্য জেলখানায় শ্রমিকের বেতন, শ্রম সময়, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা— সব কিছুই কম খরচায় করে বিশ্ব বাজার হাতে রাখতে পারে।

ভারতের লোকসভায় অপারেশন সিঁদুর নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু চিনে কোভিড নিয়েও কোনও বিতর্ক হয়নি। এই চিনের প্রাচীর ভেদ করে সঠিক তথ্য পাওয়াই দুষ্কর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৩১ মে ২০২১-এর তথ্য বলছে যে, কোভিডে আমেরিকায় মৃত্যু হয়েছে ৬ লক্ষ ৯ হাজার জনের, ভারতে মৃত্যু ৩ লক্ষ ২৭ হাজার জনের। আর চিনে যেখানে এর শুরু সেখানে মৃত্যু মাত্র ৪ হাজার ৬০০ জনের, যা বিশ্বাস করাই কঠিন, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করেছে। সমস্যা হচ্ছে সস্তা শ্রম, বিপুল শ্রমিকের শ্রম— এই দুইয়ের লোভে পশ্চিমি দুনিয়া চিনের উপর নির্ভর করেছে নিশ্চিন্তে। এখন সেই চিনের হাতে নতুন অস্ত্র হয়ে উঠছে বিরল মৃত্তিকা।

যেখানে আমেরিকা পশ্চিম ইউরোপ বিরল মৃত্তিকার ব্যাপারে এত পিছিয়ে, সেখানে ভারতের ভূমিকা যে প্রায় অদৃশ্য, তা খুব অস্বাভাবিক নয়। তবে অতি সম্প্রতি ভারতে কয়েকটি খনিতে বিরল মৃত্তিকার জন্যও কাজ শুরু হয়েছে। এই বিরল মৃত্তিকা পরিশোধনের প্রযুক্তির লক্ষ্যে চারটি আইআইটি-সহ সাতটি গবেষণা কেন্দ্রকে নির্বাচিত করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু ভারত গণতান্ত্রিক দেশ, তাকে খনন, প্রযুক্তি, গবেষণার বাইরেও অনেক কিছু ভাবতে হয়। যেমন, দেড় দশক আগে ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড়ে অ্যালুমিনিয়াম তৈরির আকর বক্সাইট খনির প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল। এক বিশেষ আইনমতে, আদিবাসী অঞ্চলে গ্রামসভা যদি মনে করে কোনও প্রকল্প তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করছে, তবে তা বাতিল করতে হবে। এতে পরিবেশের বা আদিবাসীদের আদৌ কোনও লাভ হল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, তবে এও মনে রাখা ভাল, কূটনীতি ও অর্থনীতির দুনিয়ায় এর বিরাট প্রভাব পড়ল, এই গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর অন্যতম উৎপাদক হয়ে রইল চিন। পরিবেশ-প্রশ্ন নিশ্চয়ই জরুরি, তবে পরিবেশের নামে সংস্কারের প্রাধান্য রাখা হচ্ছে কি না, এবং সংস্কারের সঙ্গে আপস করে দেশের মানুষের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হচ্ছে কি না, সেটাও ভাবা জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Economy Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy