দাবিটা হওয়ার কথা ছিল: স্বাস্থ্য নাগরিকের মৌলিক অধিকার। অসুস্থ হলে সুচিকিৎসা পাওয়াটা জাতি, ধর্ম, সামাজিক অবস্থান, আর্থিক ক্ষমতা নির্বিশেষে— নাগরিকের মৌলিক অধিকার। অথচ, আমাদের বোঝানো হল, আর পাঁচটা পণ্য বা পরিষেবার মতো, স্বাস্থ্য-চিকিৎসাও ক্রয়যোগ্য। অর্থাৎ, হতদরিদ্র মানুষ যাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসা পান, সেটুকু সরকার অবশ্যই দেখবে। কিন্তু বাকিরা নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী, নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে, চিকিৎসা কিনে নেবেন।
সুতরাং, তৈরি হল একের পর এক পাঁচতারা হাসপাতাল। সে সব হাসপাতালের মস্ত মস্ত হোর্ডিং-এ আকাশ আড়াল হয়ে গেল। আর আমরা জানতে পারলাম, গরিবের জন্য সরকারি হাসপাতাল তো রইলই। যদিও সেই ‘গরিবের হাসপাতাল’-এ সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ কিংবা কর্মী-নিয়োগ বন্ধ করে ব্যবস্থাটিকে রুগ্ণ থেকে মুমূর্ষু করে ফেলা হল। কিন্তু সে যা-ই হোক, সত্যিকারের ‘আন্তর্জাতিক মান’-এর চিকিৎসা পেতে হলে যেতে হবে ওই পাঁচতারা হাসপাতালে। সেরা পরিকাঠামো কিংবা সেরা চিকিৎসক— সবই সেখানে। চিকিৎসার দরকার পড়লে নিতান্ত দরিদ্র ছাড়া সবাইকে, সুতরাং আপনাকেও, যেতে হবে সেখানে।
মুশকিল হল, প্রচার কিংবা বিজ্ঞাপন যা-ই বোঝাক, চিকিৎসা তো সত্যি সত্যি ফেয়ারনেস ক্রিম বা রেস্তরাঁর খাবারের মতো কোনও বিলাসদ্রব্য নয়। এ হল একান্তই জরুরি পরিষেবা, প্রয়োজনের মুহূর্তে যে কোনও মূল্যে মানুষ তা পেতে চান। মুমূর্ষু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সুচিকিৎসা না পেলে গরিবেরও মনে হয়, হয়তো ওই পাঁচতারা হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলেই প্রিয়জন সেরে উঠত। সুতরাং, সরকারি হাসপাতালের প্রতি অশ্রদ্ধা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ক্ষোভ। আর পাঁচতারা হাসপাতাল, ক্রমশই, হয়ে উঠতে থাকে একান্ত কাম্য, মৃত্যুর মুখ থেকে সুস্থ করে ফেলতে পারে এমন স্বপ্নরাজ্যের প্রতীক।
এমতাবস্থায়, সরকারের কাছে অগ্রাধিকার হওয়ার কথা ছিল— সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ, বড় সংখ্যায় কর্মী নিয়োগ ও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন। কিন্তু সে অনেক বড় কাজ, জটিলও বটে, তদুপরি মুনাফামুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার মালিকদের চটিয়ে ফেলার সম্ভাবনার কারণে বিপজ্জনকও। সুতরাং সরকার তিনটি কাজ করল। প্রথমত, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রয়োজনের তুলনায় কত কম সংখ্যক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন, সেই হিসাবে না গিয়ে প্রচার শুরু করল যে, সরকারের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করেন না বলেই মানুষ পরিষেবা পাচ্ছেন না। এর দ্বারা সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা সহজেই চিকিৎসকের প্রতি বিদ্বেষে বদলে ফেলা গেল। তদুপরি, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা-সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতিনির্ধারক কমিটিতেও গুরুত্ব পেতে থাকলেন কর্পোরেট হাসপাতালের ‘বড় ডাক্তার’রা। সুতরাং, স্বাস্থ্য-চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন পথটি আদতে উন্নততর, সে বিষয়ে কোনও ধোঁয়াশা রইল না।
দ্বিতীয়ত, সরকারি স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে হতদরিদ্র মানুষও যাতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হল। গরিব-নিম্নবিত্ত, অর্থাৎ রাজ্যের বড় অংশের মানুষ। এত দিন অবধি তাঁরা পাঁচতারা হাসপাতালের ‘কাস্টমার’ হতে পারতেন না। সরকারি স্বাস্থ্যবিমা সে ব্যবস্থা করল। অর্থাৎ, করদাতাদের অর্থে মুনাফামুখী বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুষ্টি জোগানো গেল। বলা বাহুল্য, বিমার এই অর্থ সরাসরি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হলে অনেক বেশি মানুষের উপকার হত। বিমার টাকা ব্যক্তিমানুষের চিকিৎসায় এককালীন ব্যয় হলেও পরিকাঠামোর উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে লাভ দেয়। সে-হেতু পরিকাঠামোর উন্নয়নে ব্যয় অনেক বেশি দিন ধরে বেশি মানুষের উপকার করতে পারত।
তৃতীয়ত, মুনাফাকামী স্বাস্থ্যব্যবস্থার কর্ণধারদের ডেকে মাঝেমধ্যে সরকার খুব বকুনি দেওয়ার ব্যবস্থা করল। এর দ্বারা জনসাধারণের কাছে বার্তা দেওয়া গেল যে, আপনারা নির্ভয়ে পাঁচতারা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান। খরচ একটু হবে, কিন্তু বেশি খরচ যাতে না হয় সে জন্য সরকার সর্বদাই সজাগ। তবে খরচ হলেও চিকিৎসাটা পাবেন।
এর সঙ্গে আরও কিছু কথা যোগ করাই যেত। যেমন, যেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা হওয়ার কথা, সেই সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা করাতে স্বাস্থ্যবিমার প্রয়োজনীয়তা, যাতে মানুষ দেখতে পান যে, বিমা-কার্ড পাঁচতারা কিংবা সরকারি, দু’জায়গাতেই লাগছে, সুতরাং পাঁচতারার স্বাচ্ছন্দ্যই শ্রেয়। কিন্তু কথা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন। এক কথায়, সরকার যে ভাবে সুপরিকল্পিত পথে পাঁচতারা স্বাস্থ্যব্যবস্থার মান্যতা বৃদ্ধি ও প্রসার ঘটাল, তা সত্যিই চমকপ্রদ।
এ বার সরকারই কর্পোরেট হয়ে উঠতে চলেছে। সরকারি হাসপাতালেই চালু হচ্ছে নতুন ওয়র্ড। খরচ পাঁচতারা হাসপাতালের কাছাকাছিই। খবর পেলাম, রাতপিছু বেড-ভাড়া দাঁড়াবে পাঁচ হাজার টাকা থেকে পনেরো হাজার অবধি। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসার মিলমিশ এ বারে দুধ ও জলের দ্রবণের মতো উপাদেয় হতে চলেছে।
আশা করা চলে, অতঃপর কোনটি সরকারি আর কোনটি বেসরকারি, সেই ব্যবধান ঘুচে যাবে মানুষের মনেও। সেই চাল ও কাঁকরের ‘সমসত্ত্ব’ মিশ্রণে শেষ অবধি কোন পক্ষ লাভবান হবে, সে বিষয়ে সংশয় থাকার কথা নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)