E-Paper

ক্রমশ শিথিল অবস্থান

সিপিআই(এম)-এর কাঠামোগত সংস্কারের দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সংবিধানের ৩৫৬ ধারা (রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষণা করে কেন্দ্র দ্বারা নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করা) বাতিল করা এবং রাজ্যপাল পদের অবলুপ্তি।

অয়ন গুহ

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৫ ০৫:৩৮

অনেক সময়েই ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলিকে একটি দুরূহ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়— উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আদর্শগত ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কী ভাবে নির্বাচনী সাফল্য এবং রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করা যায়? সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙন এবং নয়া-উদারনীতিবাদের আধিপত্য এই দ্বিধাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। গবেষকরা সিপিআই(এম)-এর অর্থনৈতিক নীতির উপর এই দ্বিধার প্রভাব বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংক্ৰান্ত বিষয়ে সিপিআই(এম)-এর অবস্থান কী ভাবে এই সমস্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তার পর্যালোচনা এখনও উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে। এই বছর যখন ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ১০০ বছর পূর্ণ করছে, তখন বিষয়টি আর এক বার ফিরে ভাবা যেতে পারে।

ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ে সিপিআই(এম) ধারাবাহিক ভাবেই সরব থেকেছে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল এবং ত্রিপুরার কমিউনিস্ট সরকারগুলির তরফে জারি থেকেছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্যগুলির অধিকার সম্প্রসারণের পক্ষে রাজনৈতিক প্রচার। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে এই দলের দাবিগুলিকে মূলত দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে— কাঠামোগত সংস্কারের দাবি এবং প্রয়োগসংক্রান্ত দাবি। কাঠামোগত দাবির লক্ষ্য, সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতা বিন্যাসে মৌলিক পরিবর্তন আনা। অন্য দিকে, প্রয়োগসংক্রান্ত দাবি— রাজ্যগুলির অধিকার সম্পর্কিত সাংবিধানিক নীতির প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবহারিক আনুগত্যের প্রত্যাশা। অন্য অ-কংগ্রেসি রাজনৈতিক দলগুলি মাঝেমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের দাবি জানালেও মূলত কমিউনিস্টরাই ক্ষমতা ভাগাভাগিতে মৌলিক পরিবর্তনের দাবি তুলে ধরতে চেয়েছেন।

সিপিআই(এম)-এর কাঠামোগত সংস্কারের দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সংবিধানের ৩৫৬ ধারা (রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষণা করে কেন্দ্র দ্বারা নির্বাচিত রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করা) বাতিল করা এবং রাজ্যপাল পদের অবলুপ্তি। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, মুদ্রা, যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ারকে সীমাবদ্ধ করে সংবিধানের অন্তর্গত অবশিষ্ট ক্ষমতা এবং সমবর্তী তালিকার বেশির ভাগ বিষয় রাজ্যকে হস্তান্তর করার পক্ষপাতী তারা। সংবিধানের ২০০ এবং ২০১ ধারা (যা রাজ্যপালকে বিধানসভা কর্তৃক পাশ হওয়া বিলগুলিকে রাষ্ট্রপতির সম্মতির উপর নির্ভরশীল করে) বাতিল করা, নতুন রাজ্য গঠন বা বর্তমান রাজ্যগুলির পুনর্বিন্যাসের জন্য রাজ্যের সম্মতি বাধ্যতামূলক করা— এগুলিও রয়েছে তার মধ্যে। সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত স্মারকলিপি (১৯৭৭), পুরনো নির্বাচনী ইস্তাহার এবং কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের লেখায় এই সব দাবি স্পষ্ট।

গত দুই দশক ধরে সিপিআই(এম)-এর জাতীয় নির্বাচনী ইস্তাহারে উঠে এসেছে ৩৫৬ ধারার পরিবর্তে উপযুক্ত বিধান রাখার প্রস্তাব। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, রাষ্ট্রপতি শাসন বিষয়ে সিপিআই(এম)-এর মনোভাব ক্রমাগতই নরম হয়েছে। দলের ১৯তম (২০০৮) এবং ২০তম কংগ্রেসের (২০১২) রাজনৈতিক প্রস্তাব বলছে— সুপ্রিম কোর্টের বোম্মাই রায় (১৯৯৪) এবং কেন্দ্রে জোট সরকারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করে। লক্ষণীয়, ২৩তম কংগ্রেসের (২০২২) রাজনৈতিক প্রস্তাবেও ৩৫৬ ধারার সংশোধনের প্রসঙ্গে ‘উপযুক্ত বিধান’ শব্দবন্ধের পরিবর্তে ‘উপযুক্ত রক্ষাকবচ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত। সুতরাং, এ ক্ষেত্রে ৩৫৬ ধারার দ্ব্যর্থহীন বিরোধিতার পরিবর্তে শর্তসাপেক্ষ এবং সংযমী বিরোধিতার কৌশলই বেছে নেওয়া হয়েছে বলে ভাবা যেতে পারে।

একই ভাবে, সময়ের সঙ্গে রাজ্যপাল পদের প্রতি সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গিতেও এসেছে সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক নথিতে (২০০৮) রাজ্যপাল পদ সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত করার প্রস্তাবের পরিবর্তে রয়েছে রাজ্যপালের ক্ষমতা সীমিত করার পরামর্শ। একই ভাবে, ২২তম কংগ্রেসে (২০১৮) রাজ্যপালের ভূমিকা সংশোধনের দাবি তোলা হয়েছে, ২৩তম কংগ্রেসে (২০২২) রাজ্যপাল প্রতিষ্ঠানটির পুনর্বিবেচনার দাবি ওঠানো হয়েছে। রাজ্যের ক্ষমতায়নের কথা বলা হলেও, দেখা যাচ্ছে এই প্রসঙ্গে আগের মতো সুনির্দিষ্ট দাবি আর উচ্চারিত হচ্ছে না। সাম্প্রতিক পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তাবে (২০১২, ২০১৫, ২০১৮, ২০২২) ধারাবাহিক ভাবে রাজ্যগুলিকে আরও ক্ষমতা দিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নতুন ভাবে তৈরির কথা বলা থাকলেও কোনও নির্দিষ্ট দাবি তোলা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কারের দাবিটি সিপিআই(এম)-এর রাজনৈতিক ভাষ্যে ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের দলিলগুলিতে প্রাধান্য পেয়েছে নানা প্রায়োগিক দাবি। এই সব দাবি মূলত কেন্দ্র কর্তৃক রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বিষয়ক। যেমন, কেন্দ্রীয় অনুদানের ক্ষেত্রে রাজ্যের উপর কেন্দ্র যাতে এত শর্ত আরোপ না করে, কিংবা কর থেকে প্রাপ্ত আয়ের বৈধ ভাগ থেকে রাজ্যগুলিকে যাতে বঞ্চিত করা না হয় ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, ২০তম কংগ্রেসে (২০১২) উঠে এসেছে, ৩৫৬ ধারার ব্যবহারের মতো বিষয়ে কেন্দ্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হ্রাস পেলেও, আর্থিক ও আইনজনিত ক্ষেত্রে কিন্তু রাজ্যের অধিকারের উপর কেন্দ্রের আক্রমণ একই রকম তীব্র। এটা কোনও কাঠামোগত সংস্কারের দাবি নয়, প্রায়োগিক সংস্কারের দাবি।

কিন্তু কেন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ে দলের আদর্শগত অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হয়ে গেল? তার পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ— ত্রিপুরা, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় সিপিআই(এম)-এর সুদীর্ঘ স্থায়িত্বের দিন শেষ। আগে এই রাজ্যগুলিতে সুষ্ঠু ভাবে সরকার পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কার্যকারিতার উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজনীয়তা ছিল। তদুপরি, সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙন এবং ১৯৯১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক উদারীকরণের সূচনার পরবর্তী সময়ে, সিপিআই(এম)-এর পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীতিকে মোকাবিলা করা ছিল একটি কঠিন পর্ব। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিপিআই(এম)-এর ১৪তম কংগ্রেসে (১৯৯২) ‘অন সার্টেন আইডিয়োলজিক্যাল ইস্যুজ়’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এতে নতুন বাস্তবতাকে স্বীকার করে উদারীকরণের পক্ষে অনুকূল নীতি গ্রহণের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করা হয়। এ ভাবে নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অর্থ— প্রকারান্তরে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে বিদ্যমান যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-বণ্টন কাঠামোর মধ্যেও সমন্বয় সাধন করা। উদাহরণস্বরূপ, সিপিআই(এম)-এর ২০তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেস ‘লেফট ফ্রন্ট গভর্নমেন্ট অ্যান্ড আওয়ার টাস্কস’ শিরোনামে যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে, তা কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেছিল যে ভারতের বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, পুঁজিবাদী নীতির কোনও বিকল্প সম্ভব নয়।

কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের প্রশ্নে সিপিআই(এম)-এর আদর্শগত অবক্ষয় আসলে এ দেশের নির্বাচনী রাজনীতি ও নয়া-উদারনীতিবাদেরই অতি স্বাভাবিক পরিণতি। নির্বাচনী রাজনীতি ও নয়া-উদারনীতিবাদের এই আধিপত্যের অর্থ— দীর্ঘমেয়াদি আদর্শগত লক্ষ্যের থেকে স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

তবে, এটাও উল্লেখ করা জরুরি, প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন করলেও পশ্চিমবঙ্গ ও অন্য রাজ্যে সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সিপিআই(এম) গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতি ও চেতনা কার্যকর করতে কোনও সাফল্যই অর্জন করতে পারেনি। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, সিপিআই(এম)-এর ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ সংস্কৃতির প্রতি আসক্তির কারণে পঞ্চায়েতের উপর দলের অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়েছে। এর ফলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাধা পেয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী— গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির প্রতি সিপিআই(এম)-এর অটল আনুগত্য। বছরের পর বছর ধরে সিপিআই(এম) তাদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে দলের অভ্যন্তরে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রবণতার বিরোধিতা করে গিয়েছে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার পক্ষে জোর সওয়াল করেছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণাম— শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের ঘোষিত লক্ষ্য এবং দলীয় সংগঠনে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নীতির মধ্যে অনিবার্য সংঘাত।

স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজ়, ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Central Government State Government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy