Advertisement
০১ মে ২০২৪
শ্রেষ্ঠত্বের বৃত্তে মেয়েরা ক্রমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠছে
Education Sytem

শিক্ষা বিষয়ে চারটি চিন্তা

প্রথম কথাটি ছেলেমেয়েদের নাম নিয়ে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের উপর আমরা একটা বিশেষ গোত্রের নামের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি— ইংরেজি ‘এ’ অক্ষরটি দিয়ে শুরু হওয়া নামের বোঝা।

শশী তারুর
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৩ ০৭:৩২
Share: Save:

কয়েক দিন আগে গ্রামীণ কেরলের একটা চমৎকার এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রাপকদের হাতে শংসাপত্র আর পুরস্কার তুলে দিতে দিতে চারটে কথা মাথায় এল। স্বীকার করা ভাল যে, কথাগুলো এই প্রথম মাথায় এল, তা নয়— গত এক দশকে পঞ্চাশটিরও বেশি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে আমার, এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো মনে দানা বাঁধছিল। এ দিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে সেই চিন্তাগুলো আরও মজবুত হল।

প্রথম কথাটি ছেলেমেয়েদের নাম নিয়ে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের উপর আমরা একটা বিশেষ গোত্রের নামের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি— ইংরেজি ‘এ’ অক্ষরটি দিয়ে শুরু হওয়া নামের বোঝা। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যে প্রজন্মের মা-বাবার সন্তান, তাঁদের মনের গঠনটি অতি-প্রতিযোগিতাকেন্দ্রিক। যে কোনও প্রতিযোগিতায় ছেলেমেয়েকে এগিয়ে রাখার কোনও সুযোগই এই মা-বাবারা ছাড়েন না। ফলে, তাঁরা সন্তানের জন্য এমনই নাম বাছেন, যে নাম তাঁদের প্রথম সারিতে বসার সুযোগ করে দেবে; স্কুলের যে কোনও অনুষ্ঠানে সবার আগে ডাকা হবে তাঁদের সন্তানের নাম; যেখানেই নাম অনুসারে তালিকা তৈরি হবে, সেখানেই তাঁদের সন্তান সবার আগে থাকবে।

পশ্চিমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সচরাচর পদবি অনুসারে চলে। ভারতে ব্যাপারটা উল্টো, এখানে সাধারণত প্রথম নাম অনুসারেই সব তালিকা তৈরি হয় (স্বাভাবিক, কারণ গোটা দেশের মধ্যে তো বটেই, এমনকি রাজ্য বা কোনও গোষ্ঠীর মধ্যেও নামকরণের প্রথা খুব আলাদা রকমের)। কাজেই, ধরে নেওয়া হয় যে, ইংরেজি ‘এ’ অক্ষর দিয়ে নাম শুরু হলে তা সন্তানের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক হবে। মুশকিল হল, বহু মা-বাবাই এই কথাটা ভাবেন, ফলে বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ক্লাসের সিকি ভাগ ছেলেমেয়ের নামই শুরু হচ্ছে ‘এ’ দিয়ে। ফলে, সুবিধার অনেকখানিই মাঠে মারা যায়।

এই সমস্যারও একটা সমাধান বার করে ফেলেছেন অভিভাবকরা। একটা ‘এ’-তে কাজ হচ্ছে না, তাই নামের গোড়ায় এখন দুটো ‘এ’! ‘আরোন’, ‘আশিস’, ‘আশিক’— এমন নামের ছড়াছড়ি। সত্যি কথা বলতে, যে তিনটে নামের কথা বললাম, তার মধ্যে শেষ দুটোর জন্য আদৌ জোড়া ‘এ’-র কোনও প্রয়োজন নেই। মাত্র এক প্রজন্ম আগেও এই নামগুলোর বানানে একটাই ‘এ’ থাকত, এবং তাতেই দিব্য কাজ চলে যেত। আর চলছে না। আশঙ্কা হচ্ছে, কিছু দিনের মধ্যেই জোড়া ‘এ’-ওয়ালা ‘আশা’ও চোখে পড়বে। এখানেই অবশ্য গল্প শেষ নয়। কিছু অভিভাবক আরও এক ধাপ এগিয়ে প্রচলিত নামের বানানই পাল্টে দিচ্ছেন সম্পূর্ণ। কেরলে একটা পরিচিত নাম এবিন (শুরু হয় ইংরেজি ‘ই’ অক্ষরটি দিয়ে)। ইদানীং দেখছি, অনেকেরই এবিন নামের বানান লেখা হচ্ছে ‘এ’ দিয়ে। মনে হয়, এর পর কেউ ঊর্মিলা নামের বানানটিও ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের বদলে শুরু করবেন ‘এ’ দিয়ে। এই বিচিত্র অভ্যাসটি কবে বদলাবে, কে জানে! আর কত দিন পরে মা-বাবারা সন্তানের ঘাড়ে এই বিকৃত বানানের বোঝা চাপানো বন্ধ করবেন? কবে তাঁরা বুঝবেন যে, এতে যে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, তা বড় জোর সাময়িক, এবং সেই সুবিধাটুকুও মূলত বিভ্রমমাত্র?

দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণটি হল, যত দিন যাচ্ছে, শিক্ষায় ততই মেয়েদের জয়ধ্বজা উড়ছে। এই কলেজটিতে যেমন, আগেও যত কো-এডুকেশনাল কলেজে আমি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাজির থেকেছি, সর্বত্রই মেয়ে পড়ুয়ারা সংখ্যালঘু— মোট ছাত্রছাত্রীর ৩০ শতাংশ মতো। কিন্তু, আগের কলেজগুলোর মতোই এখানেও দেখলাম, পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায়, সাম্মানিক স্নাতক হওয়ার ক্ষেত্রে, বা সাধারণ ভাবে লেখাপড়ায় এগিয়ে থাকার ব্যাপারে মেয়েদের প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

এবং, কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে নয়, সব বিষয়েই এই প্রবণতাটি চোখে পড়ার মতো— বিজ্ঞান ও কলা বিভাগ, এঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি, ডেন্টাল কোর্স, আয়ুর্বেদ, সবেতে (একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং, যেটি এখনও পর্যন্ত ‘পুরুষদের ক্ষেত্র’ হিসাবেই পরিচিত)। কোর্সগুলিতে হয়তো বেশির ভাগ পড়ুয়াই ছেলে, কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই টপার কোনও না কোনও মেয়ে। একবিংশ শতাব্দী নিশ্চিত ভাবেই মেয়েদের শতক হতে চলেছে, এবং তাতে আমাদের সবার লাভ।

তৃতীয়ত, শিক্ষার জন্য খিদে বেড়েছে বিপুল ভাবে, এবং তার পিছনে প্রধানত রয়েছেন অভিভাবকরা। একটা ভাল কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জনকে তাঁরা সামাজিক চলমানতার শ্রেষ্ঠ পথ হিসাবে বুঝেছেন। সমাবর্তনের মঞ্চ থেকে আমি প্রায়শই দেখি যে, ধুতি বা অন্য কোনও নিতান্ত সাদামাটা গ্রামীণ পোশাক পরা অভিভাবক অতিথি আসনে সগর্বে বসে সন্তানকে গাউন ও টুপি পরিহিত অবস্থায় ডিগ্রি হাতে তুলে নিতে দেখছেন। সেই ডিগ্রি তারা অর্জন করেছে ইংরেজি মাধ্যম পাঠক্রমে পড়ে।

কিন্তু, এই স্নাতকদের আমরা এমন একটি কর্মসংস্থান বাস্তুতন্ত্রে পাঠাচ্ছি, যা হয়তো তাদের জায়গা করে দিতে পারবে না। সমাবর্তনের মঞ্চে আমি উল্লেখ করিনি বটে, কিন্তু অল ইন্ডিয়া প্রফেশনালস কংগ্রেস-এর একটি সমীক্ষা বিষয়ে আমি অবহিত, যেখানে বলা হয়েছে, কেরলের প্রতি তিন জন এঞ্জিনিয়ারিং স্নাতকের মধ্যে দু’জন এমন কোনও চাকরিতে যোগ দেন, যেখানে আদৌ এঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির কোনও প্রয়োজনই নেই। চাকরির বাজার কী চাইছে, আর ছাত্রদের পাঠসূচিতে কী পড়ানো হচ্ছে, এই দুইয়ের মধ্যে সাযুজ্য বজায় রাখা খুবই জরুরি।

চতুর্থ এবং শেষ পর্যবেক্ষণটি হল, কালো গ্র্যাজুয়েশন গাউনের দিন ফুরিয়েছে, এ বার তাকে বিদায় করা প্রয়োজন। আমাদের দেশের জলবায়ুর পক্ষে সেই গাউন যথাযথ নয়, ভারতের বর্ণময় সংস্কৃতিতেও তা নিতান্তই বেমানান। আমাদের এই প্রবল গ্রীষ্মের দেশে ডিগ্রি হাতে পেতে কালো গাউন পরে ঘেমে-নেয়ে নাজেহাল হওয়ার বদলে ছেলেমেয়েগুলিকে অন্য পোশাক পরানোই যায়। আমরা ভারতের জন্য কি কোনও বিশেষ সমাবর্তন-সজ্জা তৈরি করতে পারি না— যেমন কুর্তা বা জোব্বা, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনও অঙ্গবস্ত্র, দুটোই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে মানানসই কোনও রঙে? এবং, মর্টার-বোর্ড টাসেলড ক্যাপের বদলে কোনও ভারতীয় টুপি বা পাগড়ি কি নিঃসন্দেহে বেশি মানানসই হবে না? আমার নিজের পছন্দ হল সোনালি পাড়ের মাইসুরু পেটা; টাসেলের বদলে সে রাজ্যেরই ধাতব পেনডেন্ট ব্যবহার করা যায়। আমরা বারে বারেই শিক্ষাকে ঔপনিবেশিক অভ্যাসের দাসত্বের বাইরে আনার কথা বলি। সমাবর্তন নামক অনুষ্ঠানটির শরীর থেকেও ঔপনিবেশিক চিহ্নগুলি মুছবার কথাও কি ভাবার সময় হয়নি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sashi tharoor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE