E-Paper

অর্ধশতকের ও-পার হতে

দূরদর্শন প্রথম মানুষকে ঘরবন্দি করতে শুরু করল। বাঙালি প্রথম অডিয়ো-ভিস্যুয়াল মাধ্যমের অভিজ্ঞতা পেলেন। টিভি বাঙালিকে সব দিয়েছিল।

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৫৩

পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৫-এর ৯ অগস্ট টেলিভিশন এসে বাঙালির জীবনকে কতখানি বদলে দিয়েছিল, আগামী কাল তাকেই ফিরে দেখার দিন।

কলকাতায় টেলিভিশন আসছে জেনে এমন উন্মাদনা তখন, কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে এত মানুষ চাকরির দরখাস্ত পেশ করেছিলেন যে লিখিত পরীক্ষার জন্য সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল-এর প্যারিশ হল ভাড়া নিয়ে বিয়েবাড়ির নেমন্তন্নের মতো ঢালাও টেবিল-চেয়ার সাজিয়ে দিতে হয়েছিল। লিখিত পরীক্ষায় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য এবং ভিস্যুয়ালাইজ়েশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা ম্যারাথন ইন্টারভিউয়ের ডাক পেয়েছিলেন আকাশবাণী ভবনে। টেলিভিশন তখন আকাশবাণীর ছত্রছায়ায়।

পরিচালক মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, তথ্যচিত্র পরিচালক শান্তি চৌধুরীরা বাছাই করেন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের এক দল তরুণ তুর্কিকে। ভাগ্যবলে তাঁদেরই এক জন হওয়ার সুবাদে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের টিভি ফ্যাকাল্টির প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসাবে টিভি প্রোডাকশনের কোর্স করে এসে দেখলাম আমাদের জন্য পুরনো রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োর বাড়িতে অসমাপ্ত টিভি স্টুডিয়ো অপেক্ষমাণ, কলকাতায় সাড়ম্বরে টিভি ট্রান্সমিশন শুরুর জন্য। সেই তরুণ তুর্কি যাঁরা নতুন মাধ্যমটি অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছিলেন, অনেকেই আজ প্রয়াত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগও স্মরণীয়।

শুরুর সময়ের কথা এখন অবিশ্বাস্য মনে হবে— ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার যেন, স্টুডিয়োর কাজ অসম্পূর্ণ, প্রোডাকশন প্যানেলও তৈরি হয়নি, একটা ওবি ভ্যান থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান লাইভ টেলিকাস্ট হল, সেই অবস্থায় অনেক দিন কাজ চলল। নেতৃত্বে অসাধারণ প্রগতিশীল, আধুনিকমনস্ক, উচ্চশিক্ষিতরা। কলকাতার প্রথম ডিরেক্টর মীরা মজুমদার, সহকারী ডিরেক্টর শিপ্রা রায় এবং দিল্লিতে টেলিভিশনের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন পি ভি কৃষ্ণমূর্তি। মাত্র তিন ঘণ্টার সাদা-কালো ট্রান্সমিশন কলকাতায় টেলিভিশন যে চালু করল, পরে তার নাম হল দূরদর্শন কলকাতা, ক্রমে সম্প্রচারের পরিধি বাড়ল। আশির দশকে এশিয়াডের হাত ধরে দূরদর্শনের অনুষ্ঠান সাদা-কালো থেকে রঙিন হল।

উদ্বোধনের আগেই অন্তত তিন মাসের জন্যে আমরা অনুষ্ঠান রেকর্ডিং ব্যাঙ্কিং রাখা শুরু করি। সে বিরাট চ্যালেঞ্জ, কারণ অন্য কোনও টিভি অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ নেই, সামনে কোনও দৃষ্টান্ত নেই, সবই মাথা খাটিয়ে গড়ে তুলতে হবে। আরও চ্যালেঞ্জ, বাংলার শিল্প-সাহিত্যে তখন সোনাঝরা দিন। যেমন শক্তিশালী আকাশবাণী, ঘরে ঘরে রেডিয়ো ট্রানজ়িস্টর, চলচ্চিত্র, থিয়েটার, সঙ্গীতজগৎ— সর্বত্র দিকপালরা সক্রিয়। তেমনই শক্তিশালী বাংলা, ইংরেজি সংবাদপত্র জগৎ। সবাই প্রতিযোগী। এত বর্ণময় আকর্ষণ ছেড়ে লোকে কেন আমাদের আনাড়ি হাতে তৈরি মাত্র তিন ঘণ্টার সাদা-কালো অনুষ্ঠান দেখবেন! একটু এ-দিক ও-দিক হলেই শক্তিশালী মাধ্যমগুলি গিলে ফেলবে। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা অতি দ্রুত ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়ে মানুষের আত্মীয় হয়ে উঠলাম। প্রথম ডিরেক্টরের নীতি অনুসারে দুর্বলতা অসহায়তার কথা, বিশেষত ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকার করে দর্শকদের সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলাম।

৯ অগস্ট পরিবারের এক জনের জন্মদিন মনে করে দর্শকরা চিঠিতে, ফোনে, কার্ডে, হাতে তৈরি কেক বা ফুল এনে রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো প্রাঙ্গণকে উৎসব প্রাঙ্গণের চেহারা দিতেন। প্রথম বর্ষপূর্তিতে সংবাদ ছাড়া পুরো ট্রান্সমিশনটাই ছিল দূরদর্শনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে চিঠি লেখা আমন্ত্রিত দর্শকদের এবং আমাদের প্রথম ডিরেক্টরের উপস্থিতিতে বিশেষ ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠান করা হয়েছিল।

দূরদর্শন প্রথম মানুষকে ঘরবন্দি করতে শুরু করল। বাঙালি প্রথম অডিয়ো-ভিস্যুয়াল মাধ্যমের অভিজ্ঞতা পেলেন। টিভি বাঙালিকে সব দিয়েছিল। খেলা, সিনেমা, সঙ্গীত-নৃত্যের অনুষ্ঠান, নানা উৎসব সরাসরি দেখানো, তথ্যচিত্র, ভ্রমণ, রাজনীতি, নানা বিষয়ে যুক্তিতর্ক। বেসরকারি চ্যানেল তৈরি-থাকা টেলি-সংস্কৃতির মধ্যে পরিবেশনে নতুনত্বের পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে সরকারি প্রচারবিহীন এবং দায়হীন অনুষ্ঠান করে বৃহত্তর দর্শকমণ্ডলীর মন জয় করল। এখনও বিশেষ দিনে, দর্শক দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখার অভ্যেস ছাড়েননি। দুর্গাপুজো, দক্ষিণেশ্বর থেকে কালীপুজো, শান্তিনিকেতন থেকে বসন্তোৎসব, পয়লা বৈশাখ নববর্ষের বৈঠক— ইত্যাদির জন্য।

ডিডি বাংলা-র এখন প্রতিযোগিতা বেসরকারি চ্যানেলগুলোর সঙ্গে। যেন মায়ের সঙ্গে সন্তানদের প্রতিযোগিতা, জীবজগতের নিয়ম অনুযায়ী পুরনোকে ভেঙে ফেলে নতুন জায়গা করে নেয়। প্রতিযোগিতা না ভেবে কলকাতা দূরদর্শনের বর্তমান কর্ণধাররা সহাবস্থানের কথা হয়তো ভাবেন। দূরদর্শন মনে হয় এই দর্শনে বিশ্বাসী— আমি তোমাদের জমি তৈরি করে দিয়েছি, তাই তোমরা ফসল পাচ্ছ।

অডিয়ো-ভিস্যুয়ালের আর একটি জোরালো মাধ্যম চলচ্চিত্র, প্রাকৃতিক কারণে বা দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে না গেলে সেটি সংরক্ষিত হয়। চলচ্চিত্র ও টিভি এক নয়। টিভিতে শুরু থেকে বারে বারে প্রযুক্তিগত কাঠামো বদলেছে। টেপ-নির্ভর সেই বদল পর্বে আগের অনুষ্ঠানটি মুছে ফেলে একটি অনুষ্ঠানের উপরে, অন্য অনুষ্ঠান রেকর্ড করতে হয়েছে। ইতিহাস মুছে গিয়েছে; ছবি, কথা মিলিয়ে গিয়েছে হাওয়ায়। সংরক্ষিত যৎসামান্য।

এই লেখক ডিরেক্টর থাকাকালীন দূরদর্শন আর্কাইভ তৈরি করে তৎকালীন মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির কাছে সাহায্য চাইলে, তিনি অনুমোদন ও সহায়তা দেন। কিন্তু বেসরকারি চ্যানেলগুলি শুরু থেকেই সংরক্ষণে সজাগ। তাই কোনও ঘটনায় কারও বক্তব্যের সঙ্গে তাঁরই বলা কয়েক বছরের পুরনো বক্তব্য চালিয়ে বাজিমাত করে।

টিভি আসার পর যা কিছু ঘটেছে পঞ্চাশ বছরে, তা দৃশ্য-শ্রাব্য ইতিহাসের অঙ্গ করে রাখতে আমরা ব্যর্থ। বাংলায় টেলিভিশনের পদযাত্রা নথিভুক্ত হয়নি, কোনও ইতিহাস রচনার উদ্যোগ করা হয়নি। ভবিষ্যতে হয়তো হবে। আমাদের শিক্ষাজগৎ অর্ধশতক উদ্‌যাপনকে ভ্রম সংশোধনের সময় হিসাবে নির্ধারণ করলে মঙ্গল হবে। যদিও গত পঞ্চাশ বছরকে আর পাওয়া যাবে না, কিন্তু অনাগত সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা শুরু হতেই পারে কালবিলম্ব না করে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Prasar Bharati Televison

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy