E-Paper

সেই নাটক সমানে চলছে

ভারতের সঙ্গেও ইজ়রায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক দেশের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। ভারত স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে সমর্থন করে, কিন্তু গত কয়েক বছর নানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইজ়রায়েল-বিরোধী প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেনি।

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৪২
জ়ায়নবাদবিরোধী: ডেনমার্কে প্যালেস্টাইনের পক্ষে রাস্তায় নেমে এসেছেন বহু শত মানুষ, কোপেনহেগেন, ২৪ অগস্ট।

জ়ায়নবাদবিরোধী: ডেনমার্কে প্যালেস্টাইনের পক্ষে রাস্তায় নেমে এসেছেন বহু শত মানুষ, কোপেনহেগেন, ২৪ অগস্ট। ছবি: রয়টার্স।

গত কিছু কাল ধরে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় (জেনারেল অ্যাসেম্বলি) যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে হাজির হন সারা বিশ্বের নেতারা। সবচেয়ে জরুরি সঙ্কটগুলিকে চিহ্নিত করা, তা নিয়ে আলোচনা, বিতর্কের একটা সুযোগ মেলে সেখানে। এই সভায় বার বার উঠে আসে প্যালেস্টাইনের মানুষদের দুর্দশার কথা— কী ভাবে ইজ়রায়েল তাঁদের ভূখণ্ড গ্রাস করছে। নেতারা দাবি করেন, ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা হোক। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সঙ্কটের সমাধান হোক, প্যালেস্টাইনের মানুষ ফিরে পান তাঁদের দেশের জমি। কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায় না। প্যালেস্টাইনিদের দুর্ভোগের শেষ হয় না, বরং ইজ়রায়েলিরা আরও বেশি জমি দখল করায় তাঁদের অবস্থার আরও অবনতি হয়। ২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ১৫৪টি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তাতে প্যালেস্টাইনের প্রতি ইজ়রায়েলের নীতির খুব বেশি বদল হয়নি।

এ বছরটা অবশ্য অন্য রকম। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নির্দেশে ইজ়রায়েলের সেনা যে বিরামহীন আক্রমণ চালাচ্ছে গাজ়ার উপরে, তাতে গাজ়ার দু’লক্ষ মানুষের মধ্যে পঁয়ষট্টি হাজার প্রাণ হারিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এ বারও রাষ্ট্রপ্রধানরা গাজ়ার ভয়ানক পরিস্থিতিতে গভীর শোক-উদ্বেগ প্রকাশ করবেন এবং আরও এক বার যুদ্ধবিরতির দাবি তুলবেন। তবে এ বছরের একটা বিশেষত্ব এই যে, পশ্চিমের ধনী দেশগুলির বেশ কয়েকটি এই প্রথম প্যালেস্টাইনের ‘রাষ্ট্র’ হওয়ার দাবিকে সমর্থন করবে। যদিও ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৪৭টি দেশ প্যালেস্টাইনের স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচয়কে সমর্থন করেছে ইতিমধ্যেই, কিন্তু ফ্রান্স, ব্রিটেন, কানাডা, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়ার মতো কিছু দেশ এত দিন ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার দায় এড়িয়ে গিয়েছে। এ বার কিন্তু তারা সমর্থনের অঙ্গীকার করেছে। খাদ্যের জন্য ক্রন্দনরত, অনশনে শীর্ণ শিশুদের ছবি ইউরোপের দেশগুলোতে প্রভূত ক্ষোভ তৈরি করেছে, যাদের অনেকেই আমেরিকার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এমনকি জার্মানি, যা বরাবরই ইজ়রায়েলের বড়সড় সমর্থক, সম্প্রতি তেল-আভিভকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও প্রকাশ্যে বলেছে যে, ঘটনা যে দিকে যাচ্ছে তাতে আর কিছু দিন পরে কোনও প্যালেস্টাইনি মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তবে এত কথাবার্তার পরেও নিট ফল কী হবে, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান। তাঁরা মনে করেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের এই সভা আসলে কূটনীতির রঙ্গমঞ্চে সদিচ্ছা প্রকাশ, আর ভাল ভাল কথা কপচানোর বার্ষিক পালা। রাষ্ট্রগুলো এ সব করছে আসলে নিজের দেশের মানুষদের খুশি করার জন্য, বিশেষ করে নিজেদের দেশের মুসলিমদের সন্তুষ্ট করতে। প্রতি বছরই তো রাষ্ট্রপ্রধানরা সাধারণ সভায় এসে আবেগঘন বক্তৃতা দেন প্যালেস্টাইন নিয়ে, তার পর ফিরে গতানুগতিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন— যত দিন না ফের সময় হয় সভায় আসার। এক দিকে, এই বার্ষিক নাটক চলতেই থাকে, অন্য দিকে ইজ়রায়েল কেবলই পার পেয়ে যায়, কারণ তার পিছনে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ— আমেরিকা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ের পর ব্রিটেন অটোমান সাম্রাজ্যের জমি প্রশাসনের দায়িত্ব পায়। ১৯১৭ সালে তারা যে ‘বালফোর ঘোষণা’ প্রকাশ করে, অনেকে মনে করেন যে তা থেকেই ইজ়রায়েল-আরব সংঘাতের সূত্রপাত। ওই ঘোষণা ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে এসে বাস করার অনুমতি দেয়। তার কারণ, তার কয়েক বছর আগে থেকেই মধ্য-ইউরোপের নানা দেশে ইহুদিদের উপর আক্রমণ চলছিল, যা থেকে ‘জ়ায়নিস্ট’ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জ়ায়নিস্টরা দাবি করতেন যে, ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ অনুসারে প্যালেস্টাইন-ই হল ইহুদিদের প্রতিশ্রুত দেশ, সেখানেই ইহুদিরা নিরাপদ আশ্রয় পাবেন। প্রাচীন ইহুদি রাজ্যের অবস্থান আসলে প্যালেস্টাইনে। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও তাঁরা পেশ করেছেন নিজেদের সমর্থনে, কিন্তু আরবরা, এবং ইজ়রায়েলের বিরোধীরা, সেগুলোকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেন। পরবর্তী কালে আরও ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে বাস করতে শুরু করেন। কিন্তু বাঁধ ভেঙে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, যখন ইহুদিদের গণহত্যা শুরু করেন হিটলার। ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রচুর উদ্বাস্তু ইহুদি আসতে থাকেন প্যালেস্টাইনে।

ব্রিটিশরা ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল অবধি প্যালেস্টাইন নিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়েছিল। ইহুদি এবং আরবদের সংঘাত রুখতে ব্রিটেন তাদের দুটো আলাদা ভূখণ্ড বরাদ্দ করে। প্যালেস্টাইনকে দেওয়া হয় ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজ়া স্ট্রিপ এবং পূর্ব জেরুসালেম। এর পাশেই ইজ়রায়েল একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল ১৯৪৮ সালে, কিন্তু প্যালেস্টাইন ‘রাষ্ট্র’ রইল কেবল নামেই। আরবরা এই ব্যবস্থাপনাকে প্রত্যাখ্যান করলেন, পর পর কয়েকটি যুদ্ধ করলেন এবং হারলেন। গোটা ভূখণ্ডের উপরেই কব্জা করল ইজ়রায়েল। আজ প্যালেস্টাইনের রাজধানী নেই, আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সীমানা নেই, সেনাবাহিনীও নেই। তাই ১৯৩৩ সালে গৃহীত মন্টেভিডিয়ো নির্দেশিকা অনুসারে প্যালেস্টাইনকে ‘রাষ্ট্র’ বলা চলে না। কিন্তু বিশ্বের নানা দেশ তাকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক দেশে প্যালেস্টাইনের দূতাবাসও রয়েছে। অলিম্পিকে যোগদান করে প্যালেস্টাইন। রাষ্ট্রপুঞ্জ তাকে সদস্য রাষ্ট্র না করলেও, ‘স্থায়ী পর্যবেক্ষক’-এর পদ দিয়েছে, ফলে প্যালেস্টাইন বিতর্কে যোগ দিতে পারে, যদিও ভোট দিতে পারে না।

২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ইজ়রায়েলে হানা দেওয়ার পর নেতানিয়াহু হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার শপথ নিয়েছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি হাজার হাজার নিরপরাধ প্যালেস্টাইনিকে হত্যা করেছেন। অনেকে মনে করেন, নেতানিয়াহু থামতে পারছেন না, কারণ নিজের দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বহু মামলা চলছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ামাত্র তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। আর যুদ্ধ শেষ করার জন্য যে তাঁর উপর খুব চাপ রয়েছে, এমনও নয়। যদিও আমেরিকায় ইজ়রায়েল-বিরোধী মনোভাব ক্রমশ প্রবল হচ্ছে, তবু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন যে, সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা চলবে না। ইজ়রায়েলের সর্বাধিক বাণিজ্য চলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে। ইজ়রায়েলে তাদের বিপুল বিনিয়োগও রয়েছে। কিন্তু এর কোনও কিছুই ইউরোপ ব্যবহার করবে না ইজ়রায়েলকে সংযত করতে। প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করতে গিয়ে চিন বা রাশিয়াও ইজ়রায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। বলা বাহুল্য, প্যালেস্টাইনের চেয়ে ইজ়রায়েল বহুগুণ ধনী রাষ্ট্র (মাথাপিছু জিডিপি ৫৪ হাজার ডলার), তার ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি। তার উপর ইজ়রায়েলের রয়েছে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে উচ্চ দক্ষতা। প্রায় সব ধনী দেশের সঙ্গেই ইজ়রায়েলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।

ভারতের সঙ্গেও ইজ়রায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক দেশের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ। ভারত স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে সমর্থন করে, কিন্তু গত কয়েক বছর নানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইজ়রায়েল-বিরোধী প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেনি। আরব দেশগুলি প্রকাশ্যে ইজ়রায়েলের বিরোধিতা করলেও, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী, যে হেতু তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দরকার। আমেরিকাও তাদের উপর চাপ দিচ্ছে, ইজ়রায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতে। প্যালেস্টাইনের বিপর্যয় আরব দেশগুলির কাছে এক নৈতিক সঙ্কট, কিন্তু তাদের স্বার্থের পাল্লা ঝুঁকে ইজ়রায়েলের দিকেই। এই যেখানে কঠোর বাস্তব, সেখানে প্যালেস্টাইন কী করে বাস্তবিক ‘রাষ্ট্র’ হয়ে উঠতে পারবে? সম্প্রতি হামাস নেতাদের হত্যার উদ্দেশে কাতারে হানা দিয়েছে ইজ়রায়েল। তার নিন্দা করেছে সব দেশ। অনেকে মনে করছেন, আমেরিকা হয়তো চেষ্টা করবে রাষ্ট্রপুঞ্জের সভার আগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইজ়রায়েলি বন্দিদের হামাসের কবল থেকে উদ্ধার করার। যদিও ইজ়রায়েল তা মানবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। আর তেমন হলেও প্যালেস্টাইনিদের পরিস্থিতি কতটা বদলাবে? প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র হয়তো তা তখনই সম্ভব, যখন ইজ়রায়েলের বেশির ভাগ মানুষ অন্তহীন সংঘাতের চাইতে শান্তিপূর্ণ জীবনের প্রতি ঝুঁকবেন। তত দিন অবধি প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র থাকবে কেবল কাগজে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

gaza hamas

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy