এত দিন রাজনীতিকরা আমাদের ইতিহাস শেখাচ্ছিলেন, এখন ভাষাতত্ত্বও শেখাচ্ছেন। বলছেন, যাঁরা ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় কথা বলেন তাঁরা ভারতের নাগরিক নন। মনে হল, আমার এক প্রতিবেশী ঠাকুমা, যিনি দেশভাগের পর-পর ঢাকা থেকে কলকাতায় এসেছিলেন, ভাগ্যিস তিনি জীবিত নেই; নইলে তাঁরও নাগরিকত্ব নিয়ে টানাটানি হত। এমনকি আমাদের বাড়িতে কাজ করে মেদিনীপুরের যে মেয়েটি, ভাষিক পার্থক্যহেতু সে আর আমি এক দেশের নাগরিক হতে পারি না।
মনে পড়ে গেল গণনাট্য সঙ্ঘের নবান্ন নাটকের কথা, যার স্থানিক পটভূমি স্পষ্টতই মেদিনীপুর। কিন্তু নাট্যকার-পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য যশোরের ভাষা ব্যবহার করেছিলেন নাটকে, কারণ ওটাই তিনি ভাল জানতেন। আজকের দিন হলে হয়তো দেশপ্রেমিকরা গিয়ে মঞ্চ ভাঙচুর করতেন।
ওই নাটকের আর এক পরিচালক শম্ভু মিত্র গল্প করেছিলেন, এক বার ময়মনসিংহে একটি নাটক অভিনয়ের আগে স্থানীয় লোককবি নিবারণ পণ্ডিতকে তাঁরা জিজ্ঞাসা করেন, নাটকটির ভাষা তো দক্ষিণ ২৪ পরগনার, তা হলে কি ময়মনসিংহের উপভাষায় সংলাপগুলির পুনর্লিখন বাঞ্ছনীয়? নিবারণ পণ্ডিত বলেন, না, বরং ভাষাটাকে কলকাতার পরিমার্জিত ভাষার কাছাকাছি আনাই ভাল, কারণ গ্রামের মানুষ সে ভাষা বেশ বুঝতে পারে, নিজেদের ভাষার থেকে উন্নততর মনে করে।
বিশ শতকের গোড়ায় ‘লিঙ্গুয়িস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র পরিচালক গ্রিয়ারসন সাহেবও কলকাতার ভাষাকেই ‘স্ট্যান্ডার্ড কলোকিয়াল বেঙ্গলি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অন্য মৌখিক ভাষাগুলি সেই ভাষারই উপভাষা বলে গণ্য হল; যদিও গ্রিয়ারসনের মতে, “ল্যাঙ্গুয়েজ আর ডায়ালেক্টের পার্থক্য যেন ‘হিল’ আর ‘মাউন্টেন’-এর মতো।” আসলে যেটুকু পার্থক্য তা তো অনেকটাই মুদ্রণ সংস্কৃতি-ঘটিত প্রমিতকরণের ফল।
মুদ্রণ সংস্কৃতির ধারক-বাহক কলকাতার ভদ্রলোকদের ভাষিক আধিপত্য সত্ত্বেও অঞ্চল, জনগোষ্ঠী, শহর/গ্রাম, নিম্নবর্গীয়/উচ্চবর্গীয় ভেদে কথ্য বাংলায় হেরফের হয়েই থাকে। অঞ্চলভেদের মধ্যে একটা বড় ভেদ পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে। সুকুমার সেন অবশ্য উত্তর বাংলার বরেন্দ্রী, উত্তর-পশ্চিম বাংলার কামরূপী, বর্ধমানের রাঢ়ী, দক্ষিণ-পশ্চিমের ঝাড়খণ্ডী/সীমান্ত রাঢ়ীর কথাও বলেছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিবেচনায় তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রংপুরের উত্তরে উদীচ্য আর মধ্য-মেদিনীপুরের সুহ্মক বাংলা। ভাষাতত্ত্ববিদরা এমনও বলেন, পাঁচ মাইল পর পর বদলে যায় বাংলা ভাষা। এক-একটি জাতিগোষ্ঠীর সমাজ-উপভাষা বা ‘সোশিয়োলেক্ট’ ধরলে উত্তর বাংলার রাজবংশী আর দক্ষিণ বাংলার বাউরিদের ভাষা আলাদা। বৃত্তিগোষ্ঠী ধরলে খুলনার মাঝি আর বর্ধমানের মুচির ভাষা আলাদা। এমনকি, সুকুমার সেন দেখিয়েছিলেন, মেয়েদের ভাষাও আলাদা। উচ্চারণের পার্থক্য ধরলে তো বিষয়টি আরও জটিল। সুতরাং ভাষিক স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা এবং শেষ পর্যন্ত সংঘাতের সম্ভাবনা থেকেই যায়। রাজনৈতিক প্রণোদনাতেই সচরাচর তা ঘটে থাকে।
বাংলা ভাষায় কলকাত্তাই আধিপত্য নিয়েও কখনওসখনও অসন্তোষ ও প্রতিবাদ দেখা গেছে বই কি! যেমন রাজবংশীরা নিজেদের ভাষাকে বাংলার থেকে আলাদা বলে দাবি করেছেন, যদিও ছোটবেলায় সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা ব্যাকরণের বইতে সাধু ভাষায় একটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতির পরেই তার বিভিন্ন মৌখিক বিকল্পের যে নিদর্শনগুলি দেখেছিলাম তার মধ্যে রাজবংশীও ছিল। আর আমার অন্তত চট্টগ্রামের ভাষার থেকে রাজবংশী বেশি কঠিন মনে হয়নি।
আজ জোর পড়েছে ‘বাংলা’ আর ‘বাংলাদেশি ভাষা’র পার্থক্যের উপর, যেটা বুঝে ওঠা সহজ নয়। ‘বাঙাল’ ভাষা বিশেষত দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গীয় (মানে আজকের বাংলাদেশের) উদ্বাস্তুদের মুখের ভাষা নিয়ে অবশ্য ‘ঘটিরা’ ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছে, কিন্তু ‘মাসিমা, মালপুয়া খামু’ তাদের আদরও কেড়েছে। ক্রমে বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্বের উপশম হয়েছে। পূর্ব বাংলার মানুষ যখন ১৯৫২-তে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলেন, ১৯৭১-এ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার জন্য, আমরা পশ্চিমবঙ্গীয়রা তো কম আপ্লুত হইনি। তাঁদের ভাষাকেও নিজের ভাষা মনে করেছিলাম! হুমায়ূন আহমেদের গল্প, নীলুফার ইয়াসমিনের গান বাংলারই সম্পদ মনে করেছিলাম।
তবে কিনা আজ ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’পন্থী রাজনীতিকরা সম্ভবত মুসলমানদের ব্যবহৃত ভাষাকেই ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিচ্ছেন। দূরদর্শনে এক জন বললেন, ওরা ‘দুলাভাই’ বলে, আমরা ‘জামাইবাবু’, দুটো ভাষা তা হলে এক হয় কী করে! হ্যাঁ, জনগোষ্ঠীভেদে ‘কিনশিপ টার্ম’-এর পার্থক্য হয়েই থাকে। কিন্তু আমি আমার মুসলমান বন্ধুর মাকে ‘মাসি’ বললে তিনি খুশি হন, আমার মা তার মুখে ‘খালাম্মা’ শুনে। আত্মীয়তাবোধক শব্দ ছাড়া অন্য কিছু শব্দেও ফারাক হয়। মুসলমানরা হিন্দি শব্দ একটু বেশি ব্যবহার করেন, যেমন ‘জল’-এর বদলে ‘পানি’। কিন্তু তাতে তো তাঁদের ভারতীয়ত্বের আরও কাছাকাছি গণ্য হওয়ার কথা। সত্যি, গহন রাজনীতির গতি!
হিন্দুদের বাংলা থেকে মুসলমানদের বাংলার পৃথকীকরণের রাজনীতি দেশভাগের আগেও হয়েছে। উনিশ শতকে বাংলা ভাষার প্রমিতকরণ প্রক্রিয়ায় হিন্দু ভদ্রলোকরা বহুপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ সব বাদ দিয়ে ভাষাকে সংস্কৃতঘেঁষা করে তুলেছিলেন (অবশ্য প্রতিরোধও স্মরণীয়— ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮২টি ‘যাবনিক’ শব্দ বাদ দিতে চাইলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার মধ্যে ১৪৩টি সাদরে গ্রহণ করেন)। ক্রমে মুসলমান মধ্যশ্রেণির মধ্যেও সংস্কৃতায়িত বাংলার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জাগে। তাঁরা ‘মুসলমানি বাংলা’র স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করতে চান। গ্রিয়ারসন সেটা মেনে নিয়ে পূর্ব বাংলার ভাষা আর ‘মুসলমানি বাংলা’র সমীকরণ করলে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের আবহে প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, উত্তর ভারতে হিন্দি/উর্দুর মতো একটা কৃত্রিম বিভাজন এখানেও তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। বলেছিলেন, ভরসা এই যে উর্দুর মতো মুসলমানি বাংলার পৃথক লিপি নেই।
কিন্তু ভাষাবিভাজক রাজনীতি চলতেই থাকল, ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতার সুবাদে আরও বেশি করে। বাঙালি মুসলমানের ভাষা কী ও কেমন হওয়া উচিত তাই নিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হল। উর্দুকে অবশ্য বাংলায় কোনও দিনই তেমন আপন ভাবা হয়নি। মৌলানা আকরম খাঁ বলেছিলেন, “দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে— ‘বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাঙালা?’ এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে, না বেল?” তবে বাংলা থেকে সংস্কৃত শব্দগুলিকে যথাসম্ভব বাদ দিয়ে বেশি করে আরবি-ফারসি গ্রহণের পক্ষে সওয়াল করেন অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবী। যেমন কেউ বললেন, ‘বেহেশ্ত’ আর ‘দোজখ’-এর বদলে ‘স্বর্গ’ আর ‘নরক’ লেখাই ভাল বটে, কিংবা ‘গোসল’ আর ‘খানা’র বদলে ‘স্নান’ আর ‘আহার’; কিন্তু ‘উপাসনা’ আর ‘উপবাস’ পরিত্যজ্য, কারণ ‘নমাজ’ আর ‘রোজা’র তাৎপর্য তারা ঠিক বহন করে না। আবার কেউ ‘পানি’ শব্দটিকে ‘অচল’ বলায় প্রতিবাদ হল, যে শব্দ এই প্রদেশের অর্ধেক মানুষ ব্যবহার করে তাকে ‘অচল’ বলা যায় কী করে! হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিতও বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন ও সমরূপকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। মজার কথা, হিন্দু-মুসলমান দু’তরফেই এ সব আলোচনা সচরাচর সংস্কৃতঘেঁষা সাধু ভাষাতেই হত।
তবে রাজনৈতিক বিভাজন যত বাড়ে, স্বাতন্ত্র্য যত বিচ্ছেদের দিকে যায়, ভাষাগত বিভেদও বাড়ে। অন্তিম-ঔপনিবেশিক যুগে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ যোগে এমন ভাষা লেখা হয় যা সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের কাছে দুর্বোধ্য ছিল। এ রাজনীতির পরিণতি জানা। পরে অবশ্য রাজনীতির চাকা উল্টো দিকেও ঘুরেছে, সম্প্রতি আবার তার উল্টো মুখে যাত্রা। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি কত কিছুর সাক্ষী হয়ে কত জল বয়ে গেল গঙ্গা আর পদ্মায়।
মানুষ ভাষা উদ্ভাবন করেছিল সমাজবন্ধনের উদ্দেশ্যে। আবার ভাষা মানুষকে বিভাজিতও করেছে। বাইবেলে ‘টাওয়ার অব ব্যাবেল’-এর গল্পে তার ইঙ্গিত। মনে হয়, ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ই মানব প্রজাতির ভবিতব্য! কারণ আমরা বৈচিত্রের মধ্যে সমৃদ্ধির সন্ধানী নই, বরং অসহিষ্ণু সমরূপতার ভিত্তিতে (ভাষা, ধর্ম যে কোনও কিছু নিয়ে) প্রতাপ-প্রতিপত্তি বিস্তারে বিশ্বাসী। সে রাজনীতির কাছে ভাষা, ভালবাসা সবই তুচ্ছ। আজ যাঁরা বাংলা ভাষার বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাঁরাও তো রাজনৈতিক স্বার্থেই করছেন। ভাষার জন্য আদরযত্ন আমাদের কার কতটুকু আছে!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)