Advertisement
০১ মে ২০২৪
Moral Policing

নীতিপুলিশি চলছে, চলবে?

প্রেসিডেন্সির মতো আলোকিত জায়গায় কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশার ছবি তুলে, তাদের অভিভাবকদের ডেকে দেখানোর সাহস পান কী করে? নৈতিক বোধ এবং রুচি কতটা নিচু হলে এমন নীতিপুলিশির কাজ করা সম্ভব!

Sourced by the ABP

রঞ্জিত শূর
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৩ ০৬:৫৪
Share: Save:

এ বার স্কটিশ চার্চে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ নামের আড়ালে নীতিপুলিশি নিয়ে হইচই থামার আগেই ফের নীতিপুলিশের আঁচড় পড়ল স্কটিশ চার্চ কলেজেও। সমকামী বিবাহ বিষয়ক একটি সিনেমা প্রদর্শন ও আলোচনাসভা বন্ধ করে দিয়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজেরই কয়েকটি বিভাগ আয়োজন করেছিল এই সভার। এই নিয়ে শোরগোল যখন চলছে, তারই মাঝে জানা গেল, কিছু দিন আগেই অপছন্দের পোশাক পরে পরীক্ষা দিতে আসায় এক ছাত্রীকে হলে ঢুকতে দেননি স্কটিশ চার্চ কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে মুচলেকা দিয়ে সে দিনের মতো পরীক্ষা দিতে পারে মেয়েটি। এর কিছু দিন আগেই কলকাতার সেন্ট জ়েভিয়ার’স বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জন শিক্ষিকাকে সরাসরি ছাঁটাই করে দেওয়া হয়, ফেসবুকে সাঁতারের পোশাক পরা ছবি দেওয়ায়। দক্ষিণ কলকাতার এক সুপরিচিত ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আঠারো বছর চাকরি করার পর এক স্থায়ী শিক্ষিকাকে ছাঁটাই করে দিয়েছে, কারণ তিনি শাড়ির বদলে সালোয়ার কামিজ় পরে স্কুলে আসছিলেন।

এ সবই একেবারে হালের ঘটনা, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদে, এবং সংবাদমাধ্যমের বিরূপ সমালোচনায়, শেষ পর্যন্ত ‘আচরণবিধি’ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তবে অন্য ভাবে কিছু করবেন, সে কথাও বলে রেখেছেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, প্রেসিডেন্সির মতো আলোকিত জায়গায় কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশার ছবি তুলে, তাদের অভিভাবকদের ডেকে দেখানোর সাহস পান কী করে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নৈতিক বোধ এবং রুচি কতটা নিচু হলে এমন নীতিপুলিশির কাজ করা সম্ভব! বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন যদি বিক্ষোভে শামিল না হত, তা হলে হয়তো চালু হয়ে যেত ছাত্রছাত্রীদের আচরণবিধি। পরে প্রেসিডেন্সির উদাহরণ দেখিয়ে তা চাপানো হত সর্বত্র। গোপনে ছাত্রছাত্রীদের মেলামেশার ছবি তুলে কম্পিউটারে রেখে বাবা-মাকে ডেকে দেখানো, সন্তানকে ‘শোধরানো’-র নির্দেশ দেওয়া, এ সব চলত রাজ্যের কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই একুশ শতকে!

স্কটিশ চার্চের ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক-শিক্ষিকারা অবশ্য কোনও প্রতিবাদই গড়ে তুলতে পারেননি। সংবাদে প্রকাশ, কলেজ কর্তৃপক্ষের যুক্তি, সমকামী বিবাহ এখনও বিচারাধীন। স্কটিশ চার্চ কলেজ কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যশালী নামী কলেজ। আধুনিক মতবাদে পুষ্ট বলেই পরিচিত। শেষ মুহূর্তে কলেজ-আয়োজিত সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করে দিলেও কলেজে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তেমন প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে দেখা গেল না কেন, তা নিয়ে বিস্ময় থেকেই যায়। শিক্ষক সমাজের মধ্যে তো কোনও হেলদোল দেখা গেল না।

সমকামিতা বা রূপান্তরকামিতা বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য, সমকামী-রূপান্তরকামীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব তৈরির জন্য, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রছাত্রীদের জীবনে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির এটাই উপযুক্ত সময়। তরুণদের সংবেদনশীল মন অনেক বেশি আলোড়িত হয়, এবং এই সময়ে আহরিত মূল্যবোধগুলি বাকি জীবনের সম্পদ হয়ে থাকে। স্কটিশের যে শিক্ষক-শিক্ষিকা, বা ছাত্রছাত্রীরা এই বিষয়ে সেমিনার বা চলচ্চিত্র প্রদর্শনের উদ্যোগ করেছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁদের সমর্থন করে কেউ এগিয়ে এলেন না কেন? অথচ, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এ ‘ইউএপিএ’ আইন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আলোচনা কর্তৃপক্ষ বানচাল করার চেষ্টা করলে, শিক্ষক-শিক্ষিকারাই দাঁড়িয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীদের পাশে। নিরাপত্তা রক্ষীদের প্রতিহত করে, আমন্ত্রিত বক্তাদের বক্তব্য-সহ আলোচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল।

এ রাজ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকগুলি শক্তিশালী সংগঠন আছে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না নীতিপুলিশির ঘটনাগুলির লাগাতার প্রতিবাদ করতে। সেন্ট জ়েভিয়ার’স কলেজের শিক্ষিকার সুইমসুটের জন্য চাকরি চলে গেলেও শিক্ষক সংগঠনগুলি কার্যত নীরব থাকল। স্কুল শিক্ষকদের সংগঠনগুলিও সালোয়ার কামিজ় পরার জন্য ছাঁটাই-হওয়া শিক্ষিকার পাশে দাঁড়াল না। ছাঁটাইয়ের চিঠি হাতে নিয়ে শিক্ষা দফতর থেকে মন্ত্রীর দফতর ঘুরে আপাতত আদালতের দরজায় তিনি, একা।

তবে কি আমাদের বিদ্বৎসমাজ মানসিক ভাবে এ সব নীতিপুলিশির সমর্থক? মনুবাদের গোপন প্রেমিক? না কি শুধু ডিএ-র জন্য আন্দোলন করার জন্য, বা ভোটের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে সরব হওয়ার জন্যই কাজ করছে এ সব সংগঠন? ছাত্রছাত্রীদের বড় বড় সংগঠন, বা তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দলগুলি কেন নীতিপুলিশির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাকে একটা কর্মসূচি মনে করছে না? ভয় হয়, কর্নাটকের হিজাব নিষিদ্ধ করার মতো কোনও বিধি এ রাজ্যেও জারি হতে পারে যে কোনও সময়ে। প্রতিবাদ ফেটে পড়বে রাজপথে, সে ভরসা কম।

আজকাল সব বিষয়েই প্রশ্ন ওঠে, সুশীল সমাজের বক্তব্য কই? প্রশ্নটি ভাল, কিন্তু আজ কি সত্যিই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সুশীল সমাজ আছে, না কি তা প্রকাশ্যে বা গোপনে রাষ্ট্রের তল্পিবাহক হয়ে উঠেছে? নীতিপুলিশির বিরুদ্ধে নীরবতা দেখলে সে প্রশ্ন উঠবেই। এ রাজ্যে দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। খুব একটা চাহিদা আছে বলেও আর মনে হয় না।

দীর্ঘ সময় ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন না থাকাতেই কি ক্যাম্পাসে রাজনীতির চর্চার প্রতি বিমুখতা গড়ে উঠছে? একটা প্রতিবাদহীন সমাজ তৈরিতে সাহায্য করছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ‘অরাজনৈতিক’ পরিবেশ। সুস্থ রাজনীতির চর্চা না হলে জমি তৈরি হবে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের, মনুবাদের। নীতিপুলিশি আরও জোরদার হয়ে বসবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Presidency University
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE