Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Society

মেয়ে মানে অর্ধেক মজুরি

গত বছর রাহুল গান্ধী সংসদে প্রশ্ন করেছিলেন, অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের আইন (২০১৩) কার্যকর করতে কী ব্যবস্থা করা হয়েছে।

women

— ফাইল চিত্র।

নব দত্ত
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৪ ০৮:০৮
Share: Save:

অর্থনীতির ভাষ্য অনুযায়ী শ্রমিক এক জন ব্যক্তি, তাঁর মজুরি নির্ধারণ হয় তাঁর উৎপাদনশীলতার উপর। বাস্তবে দেখা যায়, শ্রমিকের সামাজিক পরিচয় তাঁর মজুরি নির্ধারণ করে। এ কথা সর্বত্রই সত্য— সারা বিশ্বে পুরুষের তুলনায় নারী গড়ে ২০ শতাংশ কম বেতন পান (আইএলও গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০১৮-১৯)। ভারতে সেই ফারাক আরও বেশি। গ্রাম ও শহর, দু’ক্ষেত্রেই একই কাজের জন্য প্রায় সর্বত্র মেয়েদের মজুরি পুরুষের অর্ধেক (এনএসএসও, ২০২২)। সম কাজে সম মজুরি পাওয়ার আইন (১৯৭৬) রয়েছে, তবে তা কেবল বইয়ের পাতায়। কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকার মেয়েদের অনুদান দিতে যত আগ্রহী, ততই অনাগ্রহী নারী-কর্মীদের আইনসম্মত মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা দিতে।

এই সুবিধার মধ্যে রয়েছে মাতৃত্বের ছুটি। কেন্দ্রের দাবি, তারা মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২ সপ্তাহের জায়গায় ২৬ সপ্তাহ করেছে। বাস্তবে ৯০ শতাংশ নারী-কর্মী মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি পান না। ছুটি দাবি করলে কাজ থেকে ছাঁটাই হয়ে যান। বরং জানা যাচ্ছে যে, মহারাষ্ট্রে আখ চাষে যুক্ত প্রায় ৩০ হাজার নারী-শ্রমিক অস্ত্রোপচার করে জরায়ু বাদ দিয়েছেন। কারণ, ঋতুচক্রের দিনগুলোয় তাঁরা মজুরি থেকে বঞ্চিত হন।

ভারতে অধিকাংশ মেয়ে নিযুক্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাঁদেরকে সরকারি খাতাতেই অস্থায়ী কর্মী, স্বনিযুক্ত কর্মী, ঠিকা, চুক্তিবদ্ধ কর্মী, স্বেচ্ছাসেবী, ফুরন বা দাদনের বিনিময়ে কর্মরত মজুর, বা বদলির কর্মী বলে লেখা হয়। ফলে, পুরুষদের সঙ্গে একই কাজ করেও অধিকাংশ মেয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, দুর্ঘটনা বিমা প্রভৃতি পান না। মজুরিতে ফারাক থেকে যায় প্রায় সব রাজ্যে। মানব উন্নয়ন সূচকে শীর্ষস্থানীয় কেরল। সেখানে পুরুষ-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৮৪২ টাকা। একই কাজ করে নারী-শ্রমিক পান ৪৩৪ টাকা। পশ্চিমবঙ্গে পুরুষ ও নারীর গড় দৈনিক মজুরি যথাক্রমে ৩৪২ টাকা এবং ২১৯ টাকা। ভারতে পুরুষ-শ্রমিকের গড় রোজগার গ্রামে ৩৯৩ টাকা, শহরে ৪১৯ টাকা, নারী-শ্রমিকের গ্রামে ২৬৫ টাকা ও শহরে ৩৩৩ টাকা। উত্তরপ্রদেশ, অসম, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক এবং ওড়িশার গ্রামে মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম মজুরি পান।

গত বছর রাহুল গান্ধী সংসদে প্রশ্ন করেছিলেন, অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের আইন (২০১৩) কার্যকর করতে কী ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শ্রম প্রতিমন্ত্রী উত্তরে জানিয়েছিলেন, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা আইন কার্যকর করতে হবে সব ধরনের সরকারি বেসরকারি সংস্থাকেও। দশের বেশি কর্মী নিয়োগ করলে সেই সংস্থাকে আইন অনুসারে অভিযোগ প্রতিকারের জন্য অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করতে হবে। এবং ছোট সংস্থাগুলির জন্য জেলাস্তরে সরকারের উদ্যোগে কমিটি গঠন করতে হবে। সম্প্রতি নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক এবং শ্রম মন্ত্রক হাজারখানেক কর্পোরেট সংস্থাকে, এবং রাজ্য সরকারগুলিকে ওই বিধি কার্যে পরিণত করতে নির্দেশ জারি করেছে। বাস্তব হল, এমন নির্দেশ গত দশ বছর ধরে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সংগঠিত বা অসংগঠিত, দু’টি মিলিয়ে কয়েক হাজার সংস্থায় আজও অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করা হয়নি পশ্চিমবঙ্গে।

সদ্য ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হল রাজ্যের শতাধিক চট কলে। চুক্তিতে ঢোকানো হল এই শর্ত, নারী-সুরক্ষা দেখতে কমিটি গঠন হবে— বিশেষত নারী-শ্রমিকরা রাতে কাজ করবেন বলে। অথচ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা আইন অনুসারে অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি করার দাবি শ্রমিক সংগঠনের যৌথ দাবি সনদে থাকলেও তা মানা হল না। রাজ্যের তিনশোটি বড় চা-বাগানের শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই মহিলা। সাকুল্যে দশটি চা-বাগানেও অভ্যন্তরীণ কমিটি নেই। এই যদি সংগঠিত ক্ষেত্রের অবস্থা হয়, তা হলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবস্থা অনুমেয়। ইটভাটা, নির্মাণ-সহ প্রায় কোনও কর্মক্ষেত্রে এই কমিটি নেই। যদিও বিভিন্ন জাতীয় ও রাজ্যস্তরের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ও নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছেন মহিলা-শ্রমিকদের একটি বড় অংশ। ঘটনাগুলি চার দেওয়ালের মধ্যে ঘটলেও সবাই সব জানেন। তবু নেতারা কখন জানি ‘পুরুষ’ হয়ে যান। চটকলে রাতের শিফ্টে নারী-শ্রমিক কাজ করানোর এখনও কোনও অনুমতি নেই। তবু মেয়ে-কর্মীরা রাতের শিফ্টে কাজ করছেন। হেনস্থার ঘটনাও ঘটছে।

মহিলা-কর্মীদের আর একটি প্রাপ্য সুবিধা হল ক্রেশ। কোনও সংস্থায় পঞ্চাশ জনের বেশি নারী-কর্মী কাজ করলে ক্রেশ রাখা বাধ্যতামূলক। কেন্দ্রীয় সরকারের এক নির্দেশে এ কথা মনে করানো হয়েছে। সামান্য কিছু চা-বাগানে ক্রেশের দেখা পেলেও, খাস কলকাতার সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাগুলিতে ক্রেশের দেখা মেলে না। অথচ, এই রাজ্যে চটকল-সহ অনেক কারখানাতেই সত্তরের দশক অবধি দেখা গিয়েছে ক্রেশ। অমিল ক্রেশ, অপরিচ্ছন্ন এবং অল্পসংখ্যক শৌচাগার— চূড়ান্ত এক অমানবিক পরিবেশে কাজ করেন মেয়েরা।

আশার কথা এই যে, চটকল, চা-বাগানে মহিলা-কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। তার প্রধান কারণ, কম মজুরিতে বাড়তি উৎপাদন চান মালিকরা। মেয়েদের শ্রম আজ ‘উদ্বৃত্ত’ নয়। তা প্রয়োজনীয় শ্রমে পরিণত হয়েছে। দাসত্বের পরিবেশে, অতি সামান্য মজুরিতে কাজ করাই মেয়েদের ভবিতব্য— এই ধারণাটাকে বদলে ফেলার সময় এসেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Women Payment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE