Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্য: এক অন্য পরাধীনতার কাহিনি
Syama Prasad Mukherjee

একটি ডায়েরি থেকে

ধারাভাষ্য শুরু হচ্ছে ১৯৩৯ সালের শুরুর দিকে, যখন গান্ধীকে অমান্য করে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি পদে লড়তে এবং জিততে চলেছেন গান্ধী মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে।

শরৎচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ফজ়লুল হক ও সরোজিনী নাইডু, ১৯৪১, কলকাতা।

শরৎচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ফজ়লুল হক ও সরোজিনী নাইডু, ১৯৪১, কলকাতা। ফাইল ছবি।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০০
Share: Save:

ঠিক দৈনন্দিন দিনলিপি নয়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ডায়েরি। কয়েক দিন বাদ দিলে বেশির ভাগই একটানা লেখা এবং কিছুটা অনুলিখিত রাজনৈতিক ধারাভাষ্য, যা পরবর্তী কালে লিভস ফ্রম আ ডায়েরি নাম দিয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এর কিছুটা ইংরেজিতে, কিছুটা বাংলায়। ইংরেজি অংশটা লেখা হয়েছে মূলত ১৯৪৫-৪৬ সালে এবং লেখার বিষয় ১৯৩৯-৪৬ পর্যন্ত ঘটনাবলি। এই অংশটা পড়া এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা, এ যেন এক অজানা ‘পরাধীন’ ভারতের বিবরণ।

ডায়েরির প্রথম থেকেই চমক। ধারাভাষ্য শুরু হচ্ছে ১৯৩৯ সালের শুরুর দিকে, যখন গান্ধীকে অমান্য করে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি পদে লড়তে এবং জিততে চলেছেন গান্ধী মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে। সুভাষের উপরে শ্যামাপ্রসাদ মোটেই খুশি নন, কারণ সুভাষের এই নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিতই হয়নি। কিন্তু সুভাষের উল্টো গোষ্ঠী, অর্থাৎ বল্লভভাই পটেল এবং গান্ধীর উপরেও শ্যামাপ্রসাদ রীতিমতো ক্ষিপ্ত। নির্বাচনের পর গান্ধীর বিবৃতি প্রসঙ্গে স্পষ্ট বলছেন, ‘এটা গণতন্ত্র তো নয়ই, বরং খুব নিচু মানের ফ্যাসিবাদ’। গান্ধীর মূল্যায়নে একেবারে ফ্যাসিবাদে বোধ হয় আর কেউ কখনও পৌঁছে যাননি।

কিন্তু কংগ্রেসের প্রতি এই তীব্র ক্ষোভের কারণ কী? সেটাই দ্বিতীয় চমক। পরাধীনতা বা শুরু হওয়া বিশ্বযুদ্ধ নয়, ওই টালমাটাল ১৯৩৯ সাল শ্যামাপ্রসাদের কাছে চিহ্নিত হয়ে থাকছে মূলত ‘হিন্দুদের উপর ফজ়লুল হকের নেতৃত্বে এক সাম্প্রদায়িক মন্ত্রিসভার চলমান নিপীড়ন’-এর বছর হিসেবে। কংগ্রেসের দোষ হল, সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা ‘হিন্দুদের অধিকারের পক্ষে খোলাখুলি লড়াই করেনি’। বলা বাহুল্য, সে বছর কংগ্রেসের মূল মাথাব্যথা ছিল ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধরন নিয়ে। এই প্রসঙ্গে গান্ধী-সুভাষের দ্বন্দ্বে কংগ্রেস দু’টুকরো হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কার্যত বিতাড়িত হয়ে সুভাষ ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ তখন ইংরেজদের নিয়ে নয়, ব্যস্ত হিন্দু-মুসলমান নিয়ে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল বিল এবং মাধ্যমিক শিক্ষা বিলে মুসলমানরা বেশি সুবিধা পেয়ে যেতে পারে, এই হল তাঁর মাথাব্যথার বিষয়।

তাঁর অবশ্য তখনও কোনও রাজনৈতিক দল নেই, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে গিয়েছেন বিধানসভায়। অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সাভারকর এলেন কলকাতায়, ডিসেম্বরে হল মহাসভার সম্মেলন, শ্যামাপ্রসাদ খুঁজে পেলেন তাঁর নিজস্ব দল, যার প্রথম কাজই ছিল কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ১৯৪০-এর মার্চ মাসে। বাংলায় আসল জোর তখন সুভাষেরই। শ্যামাপ্রসাদ সুভাষের কাছে গেলেন হিন্দুত্বের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর অনুরোধ নিয়ে। সুভাষ-শরৎ রাজি হলেন না। বরং সুভাষ শ্যামাপ্রসাদকে বললেন যে, এমন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করতে অগ্রসর হলে, “জন্মানোর আগেই সেটা কী করে ভেঙে দিতে হয়, দরকার হলে বলপ্রয়োগ করে, সেটা তিনি (সুভাষ) দেখবেন।” কথাটা খুবই অন্যায় এবং অযৌক্তিক, লিখেছেন শ্যামাপ্রসাদ।

কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর সুভাষ জোট করেন মুসলিম লীগের সঙ্গে। তাতে শ্যামাপ্রসাদ খুবই ক্ষিপ্ত, এ রকম এক জন ‘বামপন্থী এবং মুক্তির দূত’ (‘দ্য গ্রেট লিবারেটর অ্যান্ড লেফটিস্ট’), শেষে মুসলমানদের সঙ্গে জোট বাঁধলেন? গান্ধীর পরে এ বার তিনি সুভাষকে বেঁধেন: “এর চেয়ে ডক্টর জেকিল এবং মিস্টার হাইড বেশি ভাল কিছু করত কি?”

কিন্তু আসল অবাক-কাণ্ড এর পরে। এই জোটের পূর্ণ সুযোগ তাঁরা নেন, লিখেছেন শ্যামাপ্রসাদ, সুভাষের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য। তবে ঠিক নিজের জোরে না, ডায়েরি অনুযায়ী, কংগ্রেসের দুর্বল সরকারি গোষ্ঠী এবং কিছু সংবাদপত্র তাঁদের পিছনে ছিল। প্রচারটা কী নিয়ে? তাঁরা সুভাষকে সরাসরি ‘হিন্দুবিরোধী’ ও ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দেন। বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে সুভাষকে ‘দেশদ্রোহী’ বলা? অবিশ্বাস্য মনে হলেও, শ্যামাপ্রসাদ লেখেন, “সুভাষ আর লীগের হাত-মেলানোকে আমরা খোলাখুলি হিন্দুবিরোধী দেশবিরোধী বলে নিন্দা করেছিলাম।” পড়তে পড়তে যেন এক অলৌকিক ‘দেজা-ভু’র অনুভূতি তৈরি হয়। কংগ্রেসে গণতন্ত্র নেই, বামপন্থী সুভাষ মুসলিম-তোষণকারী, হিন্দুবিরোধী, অ্যান্টিন্যাশনাল। আশি বছর পর, হিন্দুত্ববাদী আক্রমণ অবিকল এক আছে, সুভাষ আর গান্ধীর মধ্যে শুধু পাত্র বদলে গিয়েছে, পার্থক্য এইটুকুই।

এখানেই অবশ্য রোমহর্ষক ঘটনাপরম্পরার শেষ নয়। এর পর গভীর দুঃখের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ জানাচ্ছেন, তাঁরা টাউন হল-এ একটা সভা ডেকেছিলেন, কিন্তু “শ্রীমতী হেমপ্রভা মজুমদার, শ্রীমতী লীলা রায়, নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী এবং আরও কয়েক জনের নেতৃত্বে সুভাষের ভাড়া করা দালালরা সেটা ভেঙে দেয়।” কয়েক জন আহতও হন। গুন্ডাদের নেতৃত্ব দিতে মহিলাদেরই কেন পাঠানো হল, সেটা অবশ্য লেখেননি। যেটা লিখেছেন, তা হল, এর পর সুভাষ যত দিন কলকাতায় ছিলেন, তত দিন মহাসভা তাঁকে নিয়ে উপহাস করে গিয়েছে এবং মুখোশ খুলে দিয়েছে। এতে এতই আলোড়ন তৈরি হয় যে, বাংলার মাটিতে শেষে সুভাষকে ‘দৃষ্টি আকর্ষণের রাজনীতি’তে নামতে হয়। তিনি হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার আন্দোলন শুরু করেন, গ্রেফতার হন, এবং আবার পাদপ্রদীপের নীচে ফিরে আসেন। ডায়েরি বলছে, এর পর তিনি দাড়ি রাখেন, অসুস্থতার ভান করেন, এবং ২৬ জানুয়ারি রহস্যজনক ভাবে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান। গ্রেফতার হওয়ার আগে দেশবাসীকে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে আহ্বান জানিয়ে কয়েকটা আগুনে-বক্তৃতাও দিয়েছিলেন, এই হল মহানিষ্ক্রমণ পর্যন্ত সুভাষ সম্পর্কে শ্যামাপ্রসাদের বক্তব্য।

বিশ্বযুদ্ধ তখন দানা বেঁধে উঠেছে, যার সুযোগ নিতেই সুভাষের দেশত্যাগ। মহাসভার এ ব্যাপারে অবস্থান কী ছিল? এতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই— জানা ঘটনা যে, ওই বছর ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক তারা স্থগিত রাখে। শ্যামাপ্রসাদের বয়ানানুযায়ী, সাভারকর জোর দিয়েছিলেন একটি বিষয়েই— এই যুদ্ধের সুযোগে ফৌজে হিন্দুদের আনুপাতিক সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে বাড়াতে হবে। যদি হিন্দুরা যুদ্ধে যোগ না দেয়, তবে শিখ এবং মুসলমানরা সেই সুযোগ নিয়ে নেবে। আর ইংরেজের পক্ষে যোগ দিলে হিন্দুরা যুদ্ধবিদ্যার অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, যেটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। বক্তব্য শুনে, যুদ্ধটা অক্ষশক্তি-বনাম-মিত্রশক্তি, না কি হিন্দু বনাম মুসলমান হচ্ছিল, বোঝা মুশকিল।

এর পর সুভাষচন্দ্র যখন আজ়াদ হিন্দ ফৌজ সংগঠনে জড়িত, কংগ্রেস আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে— হিন্দু মহাসভা কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে আপসহীন সংগ্রাম করে চলেছে বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে।

চমকপ্রদ ঘটনাপরম্পরায় এর পরই আসে ক্লাইম্যাক্স। ইংরেজ গ্রেফতার করে শরৎ বসুকে, আর মন্ত্রী হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ যোগ দেন বাংলা সরকারে। ব্যাপারটা আশ্চর্য এই কারণে যে, সেই মন্ত্রিসভায় যোগ দেন ফজ়লুল হকও। যে ফজ়লুল হকের সরকারকে তিনি সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়েছিলেন, যে ফজ়লুল হক ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’-এর ঘোষণাকার, তাঁর সঙ্গেই এক সরকারে কেন? শ্যামাপ্রসাদ সোজা কোনও ব্যাখ্যা দেননি। পরে এক জায়গায় লিখেছেন, “সেই সময় আমি আর হক ছিলাম যথাক্রমে হিন্দু এবং মুসলমানদের নায়ক (protagonist)। খুব আশ্চর্যজনক এক ঘটনাচক্রে আমরা ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে সহকর্মী হিসেবে কাজ করতে শুরু করলাম।” শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুদের ‘নায়ক’ ছিলেন কি না জানা নেই, তবে ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক, সেটা নিয়ে তাঁরও দেখা যাচ্ছে বিশেষ সন্দেহ নেই।

এই বৃত্ত-সম্পূর্ণ-হওয়া-ক্লাইম্যাক্সের পর ইংরেজি ধারাভাষ্যে অবশ্য আর নতুন চমক নেই। এর পর বছরখানেক শ্যামাপ্রসাদের কাজকর্ম বলতে ঢাকার নবাব আর ফজ়লুল হকের সঙ্গে যৌথ মন্ত্রিত্ব পালন, এবং একই সঙ্গে একটু-আধটু হিন্দুত্ব। এর মধ্যে ১৯৪২-এর অগস্ট মাসে শুরু হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন, গোটা কংগ্রেস নেতৃত্ব জেলবন্দি হয়। শ্যামাপ্রসাদের এই ব্যাপারে অবদান হল, তিনি আপত্তি জানিয়ে ভাইসরয়কে একখানি চিঠি পাঠান, মেদিনীপুরে সরকারি নিপীড়ন থামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, এবং অবশেষে পদত্যাগ করেন নভেম্বর মাসে। পুরো ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময়টাতে তিনি এক বারই প্রায় গ্রেফতারের সামনে পড়েছিলেন। না, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতায় নয়— সাম্প্রদায়িক গোলযোগ হতে পারে, এই আশঙ্কায় ভাগলপুরে মহাসভাকে ইদের সময় সম্মেলন করতে বারণ করা হয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে। তাঁকে এক গেস্ট হাউসে আটক রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে মহাসভা আর এক বার ইংরেজের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলনের প্রস্তাব খারিজ করে। মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর তিনি পুরোপুরি হিন্দুত্বে ফিরে আসেন, পুরো সময়টাই ক্রিপস, পটেল, গান্ধী এবং আরও নানা লোকের সঙ্গে নানা দফায় আলোচনা করেন, যার অন্যতম মূল বিষয় ছিল, মুসলিম লীগ যেন কোনও মতেই অতিরিক্ত গুরুত্ব না পেয়ে যায়। এর কোনওটাই সে ভাবে ফলপ্রসূ হয়নি, সেই বেদনা নিয়েই এই ইংরেজি ধারাভাষ্য শেষ হয়, ১৯৪৬ সালে। তখন পর পর নানা ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে— আজ়াদ হিন্দ ফৌজের বিচার, নৌবিদ্রোহ, স্বাধীনতা আসন্ন, কিন্তু ধারাভাষ্যের শেষ অনুচ্ছেদেও তাঁর মূল সুর অক্ষতই থাকে যে, হিন্দুরা এখনও নিজের অধিকারের পক্ষে জেগে উঠল না, আর কংগ্রেস কখনওই হিন্দুদের পক্ষে কিছু বলল না।

বলতেই হয়, এই ডােয়রি এক অবিশ্বাস্য নথি। যেন এক অজানা ‘পরাধীন’ ভারতের বিবরণ, যেখানে মূল লড়াইটা ইংরেজের সঙ্গে নয়, হচ্ছিল আসলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE