E-Paper

যে প্রশ্নগুলি ভেসে উঠেছে

প্রায় প্রতিটি কলেজেই শেষ হয়েছে ফর্ম জমা নেওয়ার পর্ব। অনলাইন ঝাড়াই-বাছাই সহজ, তাই লিস্টও বার হয় দ্রুত। শুরু হয়ে যায় ভর্তির প্রক্রিয়া। কিছু দিনেই ক্যাম্পাসে দেখা দেবে নতুন মুখ।

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৩ ০৪:২৮
An image of Education

—প্রতীকী চিত্র।

ইদানীং, প্রায় প্রতি বছর, প্রায় একই সময়ে, একই রকমের প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াই আমরা, শিক্ষাকর্মীরা। ঠিক এই মরসুমে একই সঙ্গে বা কিছু আগে-পরে চলতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা এবং কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া। সরকারি প্রশাসক,বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ামক, কলেজের শিক্ষক, অ-শিক্ষক কর্মী, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রী— সকলে যেন এক জটিল যন্ত্রের শাখাপ্রশাখা। যন্ত্রের কোনও একটি অংশ বিগড়ে গেলে, পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।

এই বছর, নতুন শিক্ষানীতির কারণে হয়তো এই যন্ত্রাংশগুলিকে আলাদা করে ঠাহর করা যাচ্ছে। কিন্তু এরা প্রতি বারই নিজেদের মতো নিজেদের কাজ করে চলে। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের একটি নিয়মাবলি নির্দিষ্ট থাকে, তবে প্রতি বছর তাতে কিছু সংযোজন বিয়োজন করা হয়। সেই অতিরিক্ত নির্দেশটুকু এসে পৌঁছনোমাত্রই সেটিকে কার্যকর করতে কলেজের অধ্যক্ষ, ভর্তি-পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সক্রিয় হয়ে উঠতে হয়। যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তাঁরা সব সামলান, না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। ধরুন, সরকারের আপৎকালীন সিদ্ধান্তে হঠাৎ আমূল বদলে গেল সিলেবাস কাঠামো! এ দিকে, নতুন ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়বে এক মাসের মধ্যে। তারা খোঁজ নিতে আসছে, অভিভাবকেরাও ভিড় জমাচ্ছেন। বলা হল— এখন আর কলেজে আসার দরকার নেই। হাতে-কলমে তো কিছু হয় না। সব অনলাইন। তাঁরা সে কথা কিছুটা বোঝেন, কিছুটা বোঝেন না।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। এক বার জানা গেল, এই বছরেই অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণ থাকছে। খবরটি কাগজে বার হল। নানা কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপকেরা সবাই সেই সুযোগের কথা বার বার বলছিলেন। পরিচিত এক ছাত্রী খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করে, উচ্চ মাধ্যমিকের ফলও মন্দ নয়। বাবা কারখানায় কর্মী। সেই ছাত্রীটিকেও বিষয়টি জানানো হল। বলা হল, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকার প্রমাণপত্র দেখালেই হবে।

কিন্তু, ছাত্রীটি যখন তার ফর্মের ছবি পাঠাল, দেখা গেল সে ‘জেনারেল’ বিভাগেই ফর্ম ভরেছে। অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির সুবিধা পেতে তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত, ‘ওবিসি-এ’ অথবা ‘ওবিসি-বি’ চয়নের সারিতেই থাকা আর একটি প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ লিখতে হত। সেটা তাদের বার বার বোঝানো সত্ত্বেও বুঝতে পারেনি। অভিভাবকদের সেই একই যুক্তি— “আমরা তো জেনারেল। তফসিলি সম্প্রদায়ের নই। তা হলে আমাদের কেন ওই সারিতেই অন্য একটি খোপে টিক দিতে হবে?” অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার ভিত্তিতে সংরক্ষণের জন্য এত দিনের যুক্তি-তর্ক-লড়াই যেন তাঁদের এই বিস্ময় ও বিরোধের আয়নায় হেরে ভূত হয়ে বসে থাকে। হতাশা ঘন হয়।

আশা-হতাশার আলো-আঁধারি এ ভাবেই মিশে থাকে ডিজিটাল ভর্তি প্রক্রিয়ার আন্তর্জালে। প্রত্যন্ত সুন্দরবন এলাকা থেকে কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মেধাবী মেয়েটি। “অনলাইনে ভর্তি হওয়া শুরু হতে তোমাদের তো সুবিধা হয়েছে। কলকাতায় আসতে হচ্ছে না।” অধ্যাপকের এই অজ্ঞতায় সে হেসে অস্থির। “সুবিধে? ইন্টারনেটই নেই আমাদের গ্রামে। গোসাবায় সাইবার কাফে আছে, সেখানে আসতে হয়। একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে ১০০ টাকা নেয়। তাও সব সময় সেখানে কানেকশন থাকে না।”

তবুও আশার সলতেটা জ্বলে। ডিজিটালাইজ়েশন-এর পর দালাল চক্র, আর্থিক অনিয়মের খপ্পর থেকে বেঁচেছে ভর্তির প্রক্রিয়া। অনেক কলেজের ফর্মেই ভর্তির ধাপগুলি সুনির্দিষ্ট ভাবে বিবৃত। অনলাইন ফর্মের জন্য আলাদা ফি-ও লাগে না। অর্থাৎ, একাধিক কলেজে ফর্ম তুলতে চাইলে টাকাপয়সার বাধা আর থাকছে না।

প্রায় প্রতিটি কলেজেই শেষ হয়েছে ফর্ম জমা নেওয়ার পর্ব। অনলাইন ঝাড়াই-বাছাই সহজ, তাই লিস্টও বার হয় দ্রুত। শুরু হয়ে যায় ভর্তির প্রক্রিয়া। কিছু দিনেই ক্যাম্পাসে দেখা দেবে নতুন মুখ। তাদের কেউ কেউ সুযোগ পেয়ে যাবে আরও পছন্দের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছু দিন ক্লাস করে, রওনা দেবে সেই নতুন ঠিকানায়। এই ক’দিনের চেনা-পরিচিতিও হয়তো মনে রাখবে কোনও ছাত্রী। দেখা হলে ছুটে আসবে ঠিক।

ভর্তির প্রক্রিয়ার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের কাজ কিন্তু তখনও শেষ হবে না। যে পড়ুয়াটি অন্যত্র চলে গেল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার অভিভাবক ভর্তির অর্থমূল্য ফেরত নিতে আসবেন। কেউ সৌজন্য দেখাবেন। কেউ দেখাবেন না। বাঁকা কথার তির শাণাবেন— “আপনারা টিচাররা এখন কোনও কাজই আগের মতো করেন না, টাকাটাও ফেরত দিতে চাইছেন না!”

এই সব পরিশ্রম, সব অভিযোগ আবারও শিক্ষাব্যবস্থার বহতা নদীর গর্ভে পলি হয়ে জমা পড়বে। দুই তীরে তখন নতুন আবাদ, সুফলা জমি। অর্থাৎ? এক ঝাঁক নবীন পড়ুয়ার কলতান। “ছেলেমেয়েগুলোর নাম তোলা হল রেজিস্টারে? কাল থেকে প্রথম সিমেস্টারের ক্লাস শুরু কিন্তু...।”

ওই নির্মল নতুন প্রাণগুলির দৌলতেই তো আবার যাত্রা শুরু শুভ কর্মপথে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Admission Process Colleges Universities

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy