E-Paper

নিশ্চিন্ত অবসরজীবন

বাজার-বিমুখ হয়ে অবশ্য লাভ নেই। কারণ বাজারের কাছাকাছি না-থাকার ফল কী হতে পারে, তা কিছু কাল হল বেশ টের পেয়েছি আমরা।

নীলাঞ্জন দে

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৬

—প্রতীকী ছবি।

মহা ধুমধাম করে প্রবর্তিত হয়েছিল পেনশনের নতুন ব্যবস্থা (ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম বা এনপিএস)। তার গতি ইতিমধ্যেই রুদ্ধ হয়েছে। ঘটনাটি দুঃখের, কারণ অবসরকালীন তহবিল গঠন সংক্রান্ত নতুন নিয়মের মধ্যমণি যে ধারণা, সেই ‘ডিফাইনড কনট্রিবিউশন’— অর্থাৎ, সেই তহবিলে সরকার কত টাকা দেবে আর কর্মীর থেকে কত টাকা নেওয়া হবে, সেই পরিমাণটি নির্দিষ্ট করা— তা আজকের পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলে। এর উল্টো দিকে রয়েছে পুরনো প্রথাটি, যাকে ‘ডিফাইনড বেনিফিট’ বলা হয়— অর্থাৎ, নির্দিষ্ট অঙ্কের পেনশনের নিশ্চয়তা— তা একপেশে। এই বাজার নির্ভরতার যুগে কিছুটা অবাঞ্ছিতও বটে।

‘ডিফাইনড কনট্রিবিউশন’ ব্যবস্থাটি বাজারকেন্দ্রিক, যেখানে রিটার্ন আসবে স্বাভাবিক ভাবে লগ্নির নিয়মকানুন মেনে। সেই ব্যবস্থার নিয়ম সহজ— পেনশনের জন্য সঞ্চয় করুন, বিনিয়োগ করুন, তহবিল তৈরি করুন এবং অবসর নেওয়ার পর তার উপর নির্ভর করুন। যাঁরা এই নতুন ব্যবস্থার বিরোধী, তাঁদের আপত্তি মূলত বাজার নিয়েই। সেখানে নির্ধারণ করা হবে রিটার্ন, এটা না-পসন্দ অনেকের। অবসরকালে অনিশ্চিত রোজগার কে আর চান!

বাজার-বিমুখ হয়ে অবশ্য লাভ নেই। কারণ বাজারের কাছাকাছি না-থাকার ফল কী হতে পারে, তা কিছু কাল হল বেশ টের পেয়েছি আমরা। বিশেষত শেয়ার বাজারে যে ধারা বার বার দেখতে পেয়েছি, তা থেকে দূরে থাকার মোটা মাসুল দিয়েছি। অবসরকালীন জীবনে যাঁরা আর্থিক দুরবস্থা দেখেছেন, তাঁরা এই কথার পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।

চাকরিজীবনের পরবর্তী সময় বাঁচার মতো যথেষ্ট অর্থ হাতে নেই, এমন মানুষের সংখ্যা এ দেশে প্রচুর। যাঁরা সারা জীবন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেছেন, তাঁদের কথা যদি বাদও দিই, সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি করেছেন এমন মানুষদের মধ্যেও অনেকেই এই সঙ্কটে রয়েছেন। মূল্যস্ফীতির আঘাত তাঁদের উপরে অতি তীব্র। এরই সঙ্গে বাড়ছে গড় আয়ু, ফলে চাকরি-পরবর্তী জীবন দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দীর্ঘজীবী প্রবীণ নাগরিকদের একাংশ যদি আর্থিক টানাটানির মধ্যে পড়েন, অন্যের উপরে নির্ভর করতে হয়, তার থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? বয়স হলে পরিবার যে দেখাশোনা করবেই, এ যুগে তার নিশ্চয়তা কোথায়?

অনেকেই আজীবন ফিক্সড ডিপোজ়িট বা স্থায়ী আমানত গোছের প্রকল্পের উপর প্রবল বিশ্বাস রেখেছেন। বিশ-ত্রিশ বছর সে রকম জায়গায় টাকা জমিয়ে ঠিক কতখানি লাভবান হলেন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা বিশেষ কেউ করেন না। সেখানে রিটার্ন অল্প, তাই মূল্যস্ফীতির ক্ষুরধার আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব। সঞ্চিত অর্থের মূল্য দ্রুত হারে কমছে, এ কথাটি তাঁরা যখন টের পান, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। উদাহরণ হিসাবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে খরচের বহর বৃদ্ধির কথাটি ভেবে দেখতে পারেন।

এখানেই নতুন পেনশন ব্যবস্থার মস্ত জিত হতে পারে। ফান্ড ম্যানেজার যখন ঠিক মতো মেয়াদি লগ্নি করবেন, অল্প বয়সে বিনিয়োগ শুরু করবেন কর্মক্ষেত্রে পা রাখা মানুষ, অনেক কাল ধরে চালিয়ে যেতে পারবেন পরিকল্পনামাফিক, তখন রিটার্নের নিরিখে নীতি রূপায়ণ সার্থক হবে। ভারতের সাধারণ নাগরিক যথাযথ পেনশন ব্যবস্থার সুবিধা পাবেন।

পঞ্জাব-সহ একাধিক রাজ্য ইদানীং পুরনো পেনশন ব্যবস্থায় ফিরতে চেয়েছে, ফিরেও গেছে পিছনের দিকে গুটিগুটি পা ফেলে। এর ফলে রাষ্ট্রের উপর ব্যয়ভার বাড়তে চলছে। উদার পেনশন নীতির সমর্থকদের মতে, পুরনো পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার জন্য রাজ্যগুলিতে খেসারত দিতে হবে আনুমানিক ২০৩৪-৩৫ সাল থেকে, যখন নতুন পেনশন ব্যবস্থার প্রথম দিকের গ্রাহকরা অবসর নেবেন।

নতুন ব্যবস্থাটিকেও আরও বেশি যুগোপযোগী করে তোলা সম্ভব। যেমন, অ্যানুইটি পেমেন্ট সংক্রান্ত পরিবর্তন নিয়ে আসা। সেই পেমেন্টের হার যথেষ্ট আকর্ষণীয় কি না, তাও দেখা উচিত। অবসর নেওয়ার পর নিজের পেনশন প্রকল্প থেকে টাকা তোলার ব্যাপারে আরও স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। পেনশন ফান্ড নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ ক্ষেত্রে হালে কিছু অদলবদল করেছে।

পেনশন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধ্যান-ধারণা তৈরি হওয়া প্রয়োজন। ঠিক যে ভাবে এখন তরুণ প্রজন্ম উপার্জন শুরু করেই বিনিয়োগ করার কথা ভাবতে শিখেছে, সে ভাবেই অবসরের বিষয়েও ভাবতে হবে। দ্রুত শুরু করে ধীরে ধীরে সেই তহবিলে অর্থ লগ্নির পরিমাণ বাড়াতে হবে। তরুণদের ‘ভাবা প্র্যাকটিস করো’ বললেই যে এই সব দায়িত্ব পালন করা যাবে, তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এই চিন্তাধারার। বয়স্কদের হাতেকলমে করে দেখাতে হবে, তবেই অল্পবয়সিরা অনুসরণ করবে, শিখতে পারবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society Economy money

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy