Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
যাঁরা সরকারি উদ্‌যাপনে বিমুখ বোধ করেন, তাঁরাও দেশপ্রেমিক
Independent India

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন

আশঙ্কার ঘন কালো মেঘ যখন মাথার উপরে, তখনই আবার ডাক এসেছে সব বাড়িতে তেরঙা পতাকা উড়িয়ে, আনন্দ-ফুর্তিতে স্বাধীনতা দিবস পালন করার।

সূচনাদিনে: নতুন দেশের অজানা পথে রওনা, কলকাতা, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭।

সূচনাদিনে: নতুন দেশের অজানা পথে রওনা, কলকাতা, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭।

প্যাট্রিশিয়া মুখিম
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৪৭
Share: Save:

ভারতের স্বাধীনতার দিনে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতাকে বলেছিলেন, ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’ (ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি)। সাধারণ পরিস্থিতিতে এই ‘অভিসার’ বা ‘ট্রিস্ট’ শব্দটির অর্থ বা উৎপত্তির গভীরে প্রবেশ না করলেও চলত— বিলেতে লেখাপড়া-করা নেহরু এমন কম-পরিচিত ইংরেজি শব্দ বলে থাকতেই পারেন, এমনটা ধরে নেওয়া যেত। কিন্তু আজ আমাদের যা পরিস্থিতি, তাতে এক বার ফিরে দেখা দরকার, কী অর্থে নেহরু কথাটি বলেছিলেন। ইংরেজি অভিধানে ‘ট্রিস্ট’ শব্দটির মানে গোপন সাক্ষাৎ, সাধারণত দুই প্রেমিকের। দেখে প্রশ্ন জাগে, কোন পরিপ্রেক্ষিতে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন নেহরু? সম্ভবত তা এই অর্থে যে, ভারতের মানুষ এক গোপন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হল যে ভাগ্যের সঙ্গে, তা ক্রমে আত্মপ্রকাশ করবে এক স্বাধীন দেশে। স্বাধীনতার জন্মলগ্নে সাক্ষাৎ মিলেছিল যে নিয়তির, তা ক্রমে প্রকাশিত হবে ভারতের মানুষের যূথবদ্ধ কাজের মধ্যে দিয়ে, যেখানে পরস্পর শ্রদ্ধার দ্বারা তারা আবদ্ধ, আর যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মর্যাদা সুনিশ্চিত।

পঁচাত্তর বছর পরে আজ আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? স্বাধীনতা দিবসের দিনটি মহৎ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণের দিন— সেই সব সাধারণ নারীপুরুষ, যাঁরা দেশকে এত ভালবাসতেন যে অসাধারণ আত্মত্যাগ করেছিলেন। যেমন, জালিয়ানওয়ালা বাগে যাঁদের গুলিতে হত্যা করা হয়েছিল ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ সালে, তাঁরা রাওলাট আইনের মতো পীড়নকারী আইনের প্রতিবাদ করেছিলেন। যাঁরা ওই আইনের প্রতিবাদ করে গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁদের কথাও মনে পড়ছে। রাওলাট আইন পুলিশকে ক্ষমতা দিয়েছিল কোনও কারণ ছাড়াই যে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার। আইনটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদের ঢেউকে দমন করা। এই আইনের ফলে সরকার বিচার ছাড়াই বন্দিদের দীর্ঘ দিন আটকে রাখতে পারত, এবং রাজনৈতিক বন্দিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ না দিয়ে, গোপনে বিচার করতে পারত।

আজ স্বাধীন ভারতে আমরা দেখছি মণিপুরকে, যা ৩ মে থেকে হিংসার আগুনে জ্বলছে। মণিপুরের মানুষ, বিশেষত কুকি-জ়ো গোষ্ঠীর মানুষদের লক্ষ্য করে আক্রমণ হানছে সংখ্যাগুরু মেইতেই গোষ্ঠী। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মৌনব্রত নিয়েছেন, হিংসা শুরুর পর থেকে ‘মণিপুর’ শব্দটিই তিনি উচ্চারণ করেননি, মণিপুরের নির্যাতিতদের উপেক্ষা করেছেন। এমনই পরিস্থিতি যে দেশের নব-নির্মিত বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে সংসদে। সেই প্রস্তাবের আলোচনায় শেষ অবধি মণিপুরের কথা বলতে হল তাঁকে, কিন্তু অজস্র অবান্তর কথা, অযথা আক্রমণের মধ্যে কার্যত ঢাকা পড়ে গেল সেই অকিঞ্চিৎকর কথাগুলি। অথচ, ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত একশো আশি জন মানুষ, সত্তর হাজার উদ্বাস্তু আশেপাশের রাজ্যে আশ্রয়প্রার্থী। তার পরেও এই গৃহযুদ্ধের তীব্রতা কমার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মণিপুরের পাহাড় এলাকার অধিবাসী কুকি-জ়ো গোষ্ঠীর যে মানুষগুলো ইম্ফল উপত্যকায় কাজ বা পড়াশোনার জন্য যেতেন, তাঁরা এখন এতই সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছেন যে কর্মস্থলে, বা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারছেন না। তাঁদের যদি একটা বিমান ধরতে হয়, তা হলে দীর্ঘ, দুঃসহ রাস্তা পেরিয়ে যেতে হবে মিজ়োরামের আইজ়লে। ইম্ফল থেকে বিমান ধরতে যেতে পারবেন না তাঁরা। আমরা যারা এই হিংসা মুখোমুখি দেখিনি, তারা হয়তো কল্পনাও করতে পারব না কত সহজে অস্ত্র দেখিয়ে, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে উগ্রপন্থী কিছু দল। কেনই বা ইম্ফলে গির্জাগুলিকে পোড়ানো হচ্ছে? যেন তার উদ্দেশ্য আদিবাসীদের ধর্মবিশ্বাসকেও আঘাত করা, কারণ তারা প্রধানত খ্রিস্টান।

মণিপুর থেকে হিংসার দৃশ্যপট সরে আসে হরিয়ানার নুহ আর মেওয়াটে— এই দু’টি জায়গাতেই মুসলিমদের বাস বেশি। ৩১ জুলাই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দলের আহ্বানে আয়োজিত একটি ধর্মীয় মিছিল মারমুখী হয়ে ওঠে। এটা যে সুপরিকল্পিত, তা বোঝা যায় যখন দেখি খুনে অভিযুক্ত এক গোরক্ষক ওই মিছিলে ছিল। হিংসায় সাত জন নিহত হন, বহু ঘর ও দোকান জ্বলে যায়। তার পর রাজ্যের সরকার পথে নামায় সেই বীভৎস বস্তুটি— বুলডোজ়ার, যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাৎক্ষণিক বিচার ও দণ্ডের প্রতীক। যারা বিতর্কিত জমিতে বাড়ি করেছে, অবৈধ ভাবে বাস করছে বলে অভিযোগ, সেই মুসলিমদের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়। ভারতে আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক নিয়মকানুনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে বুলডোজ়ার যন্ত্রটি। পঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাই কোর্ট অবশ্য বুলডোজ়ারের গতি রুখে দিয়েছে, এবং এই যন্ত্র চালানোকে ‘এথনিক ক্লেনজ়িং’ অর্থাৎ একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে বিতাড়নের চেষ্টা বলে অভিহিত করেছে। সম্ভবত এই প্রথম ভারতের কোনও আদালত বুলডোজ়ার রাজনীতির যথাযথ সংজ্ঞা দিল।

আশঙ্কার ঘন কালো মেঘ যখন মাথার উপরে, তখনই আবার ডাক এসেছে সব বাড়িতে তেরঙা পতাকা উড়িয়ে, আনন্দ-ফুর্তিতে স্বাধীনতা দিবস পালন করার। মণিপুরে যাঁরা নিজেদের বাড়ি হারিয়েছেন, স্বজন হারিয়েছেন, আর সেই সঙ্গে হারিয়েছেন নিজেদের কণ্ঠ, মর্যাদা, তাঁরা কী করে ভারত নামক রাষ্ট্রের উপর ভরসা রাখবেন? কার্যত শৃঙ্খলবন্দি হয়ে কি স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করা যায়? আর যাঁরা নুহ বা মেওয়াটে বাড়িঘর, জীবিকা হারিয়ে আবার একেবারে গোড়া থেকে জীবন শুরুর চেষ্টা করছেন, তাঁরাও কি ভাব দেখাবেন যেন সব কুশল-মঙ্গল? যদি তাঁরা উদ্‌যাপনের কোনও কারণ খুঁজে না পান, তবে হয়তো ‘নেমকহারাম’ বা ‘দেশদ্রোহী’ তকমা লাগবে তাঁদের গায়ে। এ সব শব্দ এখন খুবই সহজে বলা হয়। আমাদের থেকে দেশপ্রেম দাবি করা হয়, আর অগণিত মানুষ দারিদ্র, অশিক্ষায় নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও সেই দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ দেখাতে হয় আমাদের। এর আগে কখনও বলা হয়নি, সরকারের সাফল্যের তালিকা বানাতে হবে। আজ সংখ্যাগুরুদের মতামতই প্রাধান্য পায়, সংখ্যালঘুরা ভয়ে মাথা নিচু করে থাকে। এই কি সেই ভারত যা পাওয়ার জন্য এত চড়া দাম দিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সব জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের দেশপ্রেমিক নারীপুরুষ?

সত্যি, কী করে আমরা ইতিহাসের এই অবস্থানে এসে পৌঁছলাম? কোথায় ভুল হল? আজ মণিপুর বা হরিয়ানায় যা হচ্ছে, কাল সেই বিদ্বেষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে আমাদের গ্রাস করবে। মোদী সরকারের দাবি, মানুষের নানা সঙ্কটের মোকাবিলায় নানা প্রকল্প তৈরি হয়েছে। কিন্তু সে সব দিয়ে কী হবে, যখন আমাদের স্বাধীনতাই নেই? আমাদের বাক্‌স্বাধীনতা কই, যা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা? ভাবুন সেই সাংবাদিকদের কথা যাঁরা জেলে দিন কাটাচ্ছেন, ক্ষমতাসীনের মুখের উপর সত্য বলেছেন বলে। চিন্তা করুন ফাদার স্ট্যান স্বামীর কথা, যিনি দরিদ্র, অসহায়কে বাঁচাতে চেয়েছিলেন বলে জেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এ নিশ্চয়ই সেই ভয়মুক্ত ভারত নয়, যার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।”

নেহরু তাঁর ‘নিয়তির সঙ্গে অভিসার’ ভাষণে কোটি কোটি ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন, যাঁরা ব্রিটিশ সরকারের হাতে নির্যাতন সয়ে এসেছেন। যাঁরা আদর্শে বিশ্বাস করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, তাঁদের শোকার্ত পরিবারকে নেহরু সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিলেন। নিয়তির সঙ্গে নিভৃত অভিসারের সেই অঙ্গীকার আজ ভঙ্গ হয়েছে। এ দেশের কিছু মানুষ জেনেবুঝে অশুভ শক্তির সঙ্গে চুক্তি করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manipur Haryana Unrest
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE