Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
এই বন্দিরা ‘সাধারণ মেয়ে’, জেলেও লিঙ্গবৈষম্যের শিকার
Zameer Movie

জেনানা ফাটকের কথা

সম-সময়ের জেল-জগৎকে জ়ামির-এ দৃশ্যমান হয়ে উঠতে দেখলাম এমন একটা সময়ে, যখন দেশের কোথাও কোনও বন্দিমুক্তি আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না।

Arrest.

—প্রতীকী ছবি।

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৪ ১০:০৯
Share: Save:

জানুয়ারির শেষ রবিবার সকালে দক্ষিণ কলকাতার একটি হলে বসে শুনছিলাম জল-জঙ্গল-জমির অধিকার নিয়ে গত বিশ-ত্রিশ বছর লড়াই করা কয়েক জন মানুষীর কথা। স্ক্রিনে দেখা দিচ্ছিলেন শীতল সাঠে, দয়ামণি বার্লা, সোনি সোরি, সিমি সয়, আঞ্জুম জামরুদ ও তাঁদের আরও কয়েক জন সহযোদ্ধা। বন্দিশালার ভিতরে ও বাইরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নিয়ে তাঁরা কথা বলছিলেন ইতিহাসবিদ তথা চলচ্চিত্রনির্মাতা উমা চক্রবর্তীর সঙ্গে, যিনি অধ্যাপনা জীবন থেকে অবসর নিয়ে নিজের পেনশনের টাকায় গত কয়েক বছর ধরে বানিয়ে চলেছেন একের পর এক প্রতিরোধী সিনেমা। আশি-পেরোনো চিরতরুণী উমাদির সাম্প্রতিকতম ছবি জ়ামির (বিবেক)-এর প্রিমিয়ার হল দশম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে।

জ়ামির-এই প্রথম দেখলাম হিদমে মারকমকে। সোনি সোরির কথা জানলেও, ছত্তীসগঢ়ের গণতান্ত্রিক অধিকার কর্মী হিদমে মারকমকে আমি চিনতাম না, জানতাম না তাঁর লড়াইয়ের কথা। গলার কাছে একটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠছিল যখন সোনি সোরির মুখে শুনছিলাম কী ভাবে দিনের পর দিন বিধ্বস্ত, অসুস্থ, অবসন্ন সোনিকে যত্ন ও ভালবাসা দিয়ে জেলের মধ্যে চাঙ্গা করে তোলেন হিদমে, প্রবল অত্যাচার অতিক্রম করে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি হয়ে ওঠেন তাঁরা পরস্পরের। গরাদের ও-পারে তাঁদের নিবিড় ভগিনী ভাব তৈরি হওয়ার কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল পরাধীন ভারতের ও স্বাধীন দেশের কিছু রাজবন্দিনিদের কারা-কাহিনি— যে কাহিনিগুলোতে জেলব্যবস্থার শাসন-নিয়ম-দমন-পীড়ন ধরা পড়ার পাশাপাশি বন্দিদের মধ্যে সংহতি ও ভগিনী ভাবের মর্মস্পর্শী দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

সম-সময়ের জেল-জগৎকে জ়ামির-এ দৃশ্যমান হয়ে উঠতে দেখলাম এমন একটা সময়ে, যখন দেশের কোথাও কোনও বন্দিমুক্তি আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না। গত মাসেই কলকাতা হাই কোর্টে পেশ করা একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গের জেলগুলোতে বহু বন্দিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। জেলের মধ্যেই গর্ভসঞ্চার হয়েছে না কি জেলে ঢোকার আগেই, এই নিয়ে চাপানউতোর চলল কয়েক দিন। আমরা কিন্তু তখন বন্দির মৌলিক অধিকার কী ভাবে খণ্ডিত হয়ে চলেছে, তা নিয়ে কোনও কথা তুললাম না। তিন বছর আগে ৮৪ বছরের শান্তিকামী জেসুইট পাদরি স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে আমরা খানিক নড়েচড়ে বসেছিলাম। অনেকেই তখন বলেছি এটা প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা! কিন্তু স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পরে স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক ক্ষোভের মুহূর্তটা ধরে আমরা এগোতে পারিনি সব বন্দির সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা ও বিনা বিচারে আটক জনজাতি, মুসলমান, দলিত, রূপান্তরকামী ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষের মুক্তির দাবি তুলে।

জ়ামির দেখার দু’-এক দিনের মধ্যে হাতে এল সুধা ভরদ্বাজের সম্প্রতি প্রকাশিত বই—ফ্রম ফাঁসি ইয়ার্ড (২০২৩)। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ২০১৮ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর প্রথম দেড় বছর পুণের এরওয়াদা জেলে অত্যন্ত বিপজ্জনক বন্দিদের জন্য নির্দিষ্ট ফাঁসি সেল-এ রাখা হয়েছিল আইনজীবী ও মানবাধিকার তথা ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী সুধাকে। তাঁর পাশের কুঠুরিতেই ছিলেন একই মামলায় অভিযুক্ত ষাটোর্ধ্ব অধ্যাপিকা সোমা সেন, যিনি আজও মুম্বইয়ের বাইকুলা জেলে বন্দি।

এরওয়াদায় আটক থাকাকালীন প্রতি রাতে নিজের সেল-এ বসে হাতে-লেখা এই জার্নালে সুধা তুলে ধরেছেন ৭৬ জন সহ-বন্দিনির কথা, যাঁরা প্রায় সকলেই বছরের পর বছর লিঙ্গপক্ষপাতদুষ্ট অবিচার ও হিংসার শিকার হয়েছেন। এঁদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে কোর্টে যাওয়ার পথে পুলিশ ভ্যানে বা বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা হওয়ার অপেক্ষায় ‘মুলাকাত’ কামরায় বা জল ভরবার সময় জেলের কলতলায়। কখনও-কখনও নিজের কুঠুরির বাইরে পায়চারি করার সময়ে কানে আসা কথোপকথনে সুধা বুঝেছেন অষ্টপ্রহর ঘরকন্নার কাজের চাপ ও পরিবার নামক পিতৃতান্ত্রিক পিঞ্জর থেকে জেলে এসে বরং কিছু দিন ‘ছুটি’ অনুভব করছেন কেউ কেউ।

সুধার চেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থতির মধ্যে থেকেও তাঁর সহ-বন্দিনিরা যে ভাবে অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে লড়ে যান, হতাশা ঠেকিয়ে রেখে বাঁচেন, হাসেন, ভালবাসেন, ঝগড়া-বিবাদ মাঝে মাঝে হলেও পরস্পরের সাহায্যে এগিয়ে আসেন— প্রতি দিন তা-ই অপরিসীম প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছিল তাঁকে।

সুধার কথার প্রতিধ্বনি শুনি দিল্লির ছাত্রী সংগঠক নাতাশা নারওয়াল ও দেবাঙ্গনা কলিতার লেখায়। তাঁরা যখন ২০২০-তে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে অভিযুক্ত হয়ে বছর দেড়েক তিহাড় জেলে ছিলেন, সেখান থেকে ‘পিঞ্জরা তোড়’ নামে তাঁদের সংগঠনের সঙ্গীদের কিছু চিঠি পাঠান। একটি চিঠিতে দেবাঙ্গনা লেখেন— “প্রতি দিন আমি মনের জোর পাই সেই মেয়েদের দেখে যারা এখানে বহু বছর আছে, বাইরে যাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই, বহু বছর ধরে শুনানি চলছে, যারা এখানেই সন্তানের জন্ম দিয়ে বড় করছে, যারা ইংরেজি বা হিন্দি বলে না, যাদের উকিল রাখার সামর্থ্য নেই, যারা বহু দিন পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেনি, কারণ তাদের কাছে কোনও ফোন নম্বর নেই, আর কেউ তাদের চিঠির জবাব দেয় না; সেই সব মেয়ে যারা যতটা ‘অপরাধী’, ততটাই সামাজিক কাঠামোগত নিপীড়নে বন্দি” (ক্যারাভান ম্যাগাজ়িন, ১৩ জুন, ২০২১)।

বীণা দাস থেকে শুরু করে জয়া মিত্র মীনাক্ষী সেন-দের কারাস্মৃতিতে আমরা ‘সাধারণ’ বন্দিদের জীবন-কথা পাই, জেলের মধ্যে যাঁদের অধিকার নিয়ে রাজবন্দি মেয়েরা সরব হয়েছেন বার বার। তবে দেবাঙ্গনার চিঠিতে, সুধার জার্নালে, জ়ামির-এর মতো ছবিতে দেখি জেলের মধ্যে মেয়েদের সামাজিক কাঠামোগত নিপীড়নকে চিহ্নিত করা হচ্ছে স্পষ্ট ভাবে। দেবাঙ্গনা মোক্ষম প্রশ্নটি তোলেন: রাজনৈতিক বন্দি বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? যে সব ‘অপরাধী’ বছরের পর বছর জেলের মধ্যে অপেক্ষায় ও অপমানে দিন কাটাচ্ছেন, বিচারব্যবস্থার নাগাল পাওয়া যাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, তাঁরাও সকলে রাজনৈতিক বন্দি নয় কেন?

শ্রেণিগত কারণে আমরা ‘রাজনৈতিক’ বন্দিদের কথা তাও অল্পবিস্তর জানতে পারি, ‘সাধারণ’ বন্দিদের কথা একেবারেই নয়। বন্দিমুক্তি আন্দোলনগুলোতেও বেশির ভাগ সময় ‘সাধারণ’ বন্দিদের কথা ওঠে না। ফ্রম ফাঁসি ইয়ার্ড-এর মতো বই ভিতর থেকে তালা খুলে আমাদের দেখিয়ে দেয়, মনে করায় ‘সাধারণ’ বন্দিদের কথা। সুধা এক জন আইনজীবী হিসাবে জেলে বসে ভেবে চলেন আইনি সহায়তা প্রদান ব্যবস্থাকে কী ভাবে ঢেলে সাজানো যায়, যাতে তাঁর সহ-বন্দিরা একটু সহজে বিচারের জন্য লড়তে পারেন। সেই ভাবনাগুলো রাখা থাকে তাঁর জার্নালে। মূল আখ্যানের শেষে একটা ‘জেল গ্লসারি’ও থাকে, যা আমাদের পরিচিত করায় জেলের মধ্যেকার নানা নিয়ম-নিষেধের জন্য ব্যবহৃত পরিভাষার সঙ্গে, দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই সব অবমাননাকর প্রথার প্রতি যেগুলোর কথা আমরা জানতেই পারি না, আওয়াজ তোলা তো দূরের কথা।

দীর্ঘ বন্দি-জীবনে দিনক্ষণের হিসাব থাকে না, সময় থমকায়। কিন্তু ঋতু পরিবর্তন জানান দেয় নানা ভাবে। ফ্রম ফাঁসি ইয়ার্ড-এ অনন্য ভাবে ধরা পড়ে ঋতুরঙ্গ। বইয়ের ছ’টি পর্যায় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত ঘিরে আবর্তিত হয়। শীত এলে আর্থ্রাইটিসে কাবু সোমা সেনকে আধ বালতি গরম জল আনতে যেতে হয় কিছু দূরের সোলার হিটার থেকে। বসন্তের দেখা না মিললেও আমের দিনে এরওয়াদা জেলের প্রাচীন আমগাছে ফল ধরে, টিয়াপাখিরা আসর জমায়, শুরু হয় আম কুড়ানোর হইহই। খোলা হাওয়ায় পায়চারি করার সময়টুকুতে সুধার সামনেও খসে পড়ে পাকা আম। আর প্রতি বছর ১ জানুয়ারির সকালে বন্দিরা পরস্পরকে একটাই শুভেচ্ছা জানায়— তুমি যেন শিগগির খালাস পাও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Society Kolkata movie film
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE