Advertisement
E-Paper

নিলাম হল শুরু

ভারতে মেয়েদের যে একটা নিজস্ব মতামত রয়েছে, ধর্ম-জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে, ঘরে-বাইরে পুরুষদের চাপকে অগ্রাহ্য করে, মেয়েরা নিজেদের স্বার্থ বিচার করছে, এটা ভাল কথা।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:০৬
Share
Save

এ বার পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের পালা। নিলাম হাঁকা শুরু হল বলে। সামনে ভোট না? দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীওয়াল মাসে একুশশো টাকা দর হেঁকেছিলেন মেয়েদের ভোটের জন্য। নরেন্দ্র মোদীর দল আড়াই হাজার টাকা ঘোষণা করল, তাতেই কেল্লা ফতে। মেয়েদের ভোট গিয়েছে বিজেপির ঝুলিতে। মহারাষ্ট্রের নতুন মুখ্যমন্ত্রী তো স্বীকারই করেছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যাচ্ছেতাই ফল করার মাত্র কয়েক মাস পর বিধানসভায় যে জিততে পেরেছে, তার অন্যতম কারণ ‘লাডকী বহীণ’ প্রকল্প— মাসে দেড় হাজার টাকার অনুদান। ঝাড়খণ্ডে ইন্ডিয়া মঞ্চের শরিক হেমন্ত সোরেনকে তরিয়ে দিয়েছে ‘মাইয়া সম্মান’-এর বার্ষিক বারো হাজার টাকা।লোকসভার আগে মেয়েদের অনুদান বাড়িয়ে আশাতীত ভোট পেয়েছে তৃণমূল। ধাক্কা সামলাতে এ বার বাজেটে লক্ষ্মীর ভান্ডারের বরাদ্দ এক ধাক্কায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে— চোদ্দো হাজার কোটি টাকা থেকে ছাব্বিশ হাজার কোটি টাকা। ২০২৬-এ বিধানসভা ভোটের আগে হাজার-বারোশো টাকা থেকে ফের অনুদান চড়তে পারে।

এ কি ভাল, না কি মন্দ? ভারতে মেয়েদের যে একটা নিজস্ব মতামত রয়েছে, ধর্ম-জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে, ঘরে-বাইরে পুরুষদের চাপকে অগ্রাহ্য করে, মেয়েরা নিজেদের স্বার্থ বিচার করছে, এটা ভাল কথা। লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-প্রভাবিত এলাকাতেও মেয়েদের ভোট তৃণমূলে গিয়েছে, মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে মুসলিম মেয়েরাও বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। এতে নারী স্বাতন্ত্র্যের একটা ইঙ্গিত মেলে। অন্য দিকে, প্রবল অস্বস্তিও হয়। তবে কি কিছু টাকা ছাড়া মেয়েরা আর কিছু বোঝে না?

গরিবের কাছে ওই টাকার মূল্য কম নয়— ভারতে রোজগেরে নারী-পুরুষের অর্ধেকের আয় গড়ে দিনে দু’শো টাকা। অধিকাংশই রোজ কাজ পায় না। মাসে পাঁচ-ছ’হাজার টাকায় যাকেসংসার চালাতে হয়, তার কাছে বাড়তি হাজার-বারোশো টাকা বড় আশ্বাস। বহু মেয়ের ওটাই একমাত্র নগদপ্রাপ্তি— পরিবার তার শ্রমকে ঘরে-বাইরে ব্যবহার করে কেবল খোরাকির বিনিময়ে। নগদ যে ভোটের ফল বদলে দিতে পারছে, তা এই জন্যই যে, মেয়েদের এই অন্যায়কে স্বীকার করছে রাজনীতি।

কিন্তু মেয়েদের জীবনে কি বদল আসছে? আজ যে মাসে বারোশো টাকা পাচ্ছে, কাল সে যদি দেড় হাজার-দু’হাজার টাকাও পায়, তাতে কী হবে? তাতে তো সংসার চলবে না। খেতখামারে, কলকারখানায়, বাজারে, নির্মাণে, খাদানে, লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর লক্ষ্মীরাই কাজ করছে। তখন কে তাদের শিশুকে বসিয়ে সকাল-দুপুর ভাত-ডাল মেখে খাওয়াচ্ছে? অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র খিচুড়ি বিলি করে ঝাঁপ ফেলে দেয়, শিশুদের বসিয়ে খাওয়ায় না, পড়ায় না। কারণ, কর্মী-সহায়িকার শূন্য পদ পূরণের টাকা নেই। ইস্কুলে প্রি-প্রাইমারি ক্লাস শুরু হয়েছে, অথচ শিক্ষক নেওয়ার টাকা নেই। ক্রেশ তৈরির জন্য, পরিযায়ী শ্রমিক মায়ের শিশুর হস্টেল তৈরির জন্য টাকা নেই।

তাই আজও ছোট শিশুদের দেখে একটু বড় শিশুরা। সে দিন একটি সভায় এক কিশোরী মেয়ে বলছিল, “আমাদের বাবা-মা ধরে নেয়, আমরা মেয়ে বলেই ছোট বাচ্চাদের দেখতে পারি। আমাদের আবেগকে কাজে লাগানো হয়। এ হল মেয়েদের লুকোনো শ্রম, যা কেউ দেখতে পায় না।” হাই স্কুলের ছাত্রী যে কথা বুঝেছে, রাজনীতি তা বোঝে না, তা কি হতে পারে? বোঝে, কিন্তু মুখে আনে না। সে কথাটা হল, শিশু-পরিচর্যার পরিকাঠামো তৈরিতে টাকা বার করছে না সরকার। সেই ঘাটতি পূরণ করছে শিশুকন্যারা।

অনুদানের টাকা দিয়ে জল, জ্বালানি, শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা কিনতে পারবে না শ্রমিক মেয়ে। যাকে কলসিতে জল ধরতে দিনে দু’বার লাইন দিতে হয়, উনুনের কাঠকুটো কুড়োতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়, অনুদান তার জীবনে কোনও পরিবর্তন আনছে না। অথচ, কেরোসিনে ভর্তুকি উঠে গেল, রান্নার গ্যাস নাগালের বাইরে চলে গেল, পুকুর সংস্কার একশো দিনের কাজের তালিকা থেকে বাদ পড়ায় অগণিত পুকুর মজে গেল, সরকারি প্রকল্পের পাইপ শুকনো রয়ে গেল— এর কোনওটা ‘মেয়েদের সমস্যা’ বলে দেখাই হল না। যখন জল-জ্বালানির বাজেট কাটছাঁট হয়, দলীয় কোন্দলে আর নেতাদের তোলাবাজিতে বরাদ্দ খরচ না হয়ে ফেরত যায়, তখন মেয়েদের কথা মনে পড়ে না? কেবল করদাতার টাকা বিলিয়ে মেয়েদের উন্নয়ন হবে?

কেবল ধর্ষককে ফাঁসি দিয়ে মেয়েদের সম্মান রক্ষা হবে? মেয়েরা যে পুরুষের সমান কাজ করে টাকা পায় ত্রিশ-চল্লিশ শতাংশ কম, তাতে মেয়েদের সম্মানহানি হয় না? সমান মজুরি আইন অর্ধ শতকে পড়তে চলেছে, পাঁচ শতাংশ পেশাতেও মেয়েরা পুরুষদের সমান কাজ করে সমান টাকা পায় না। আইন অনুযায়ী, মেয়েদের মজুরিতে বৈষম্য হচ্ছে কি না, তা জানতে রাজ্য সরকারের একটি পর্যবেক্ষক কমিটি গঠন করার কথা। মেয়েরা অভিযোগ করলে লেবার অফিসার ও অন্য আধিকারিকদের সুরাহা করার কথা। সেই কমিটি আছে কি না, তারা শেষ কবে রিপোর্ট দিয়েছে, অসম মজুরি, ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার ক’টা অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে, প্রশ্ন করলে কর্তারা ফাইল খুঁজে পাবেন না।

অথচ, কথাটা হাসির নয়। বারুইপুরের পেয়ারা বাগানে আট ঘণ্টা কাজ করে মেয়েরা পায় দৈনিক ১৭০ টাকা, পুরুষেরা চারশো টাকা। যদি সমান হারে মজুরি পেত, তা হলে (২৬ দিন কাজ করে) মেয়েটির বাড়তি রোজগার হত ৫৯৮০ টাকা। নির্মাণে জোগাড়ের কাজ করে মেয়েরা পায় গড়ে পুরুষদের থেকে তিনশো টাকা কম। সমমজুরি হলে দশ দিন কাজ করেই বাড়তি দু’হাজার টাকা পেত সে। আর ন্যূনতম মজুরি যদি সত্যিই মিলত, বিড়ি বেঁধে মেয়েরা বাড়তি হাজার তিনেক টাকাও আয় করত মাসে। কেন্দ্র আর রাজ্য, দুটো সরকারই সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চার বছর এনআরইজিএ বন্ধ রেখেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাতে মেয়েদের যতমজুরি লুট হয়েছে, তার পাশে অনুদানের অঙ্ক কোথায় তলিয়ে যায়!

সরকার মেয়েদের অ্যাকাউন্টে কত টাকা দেবে, এটা তো প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, সরকার মেয়েদের জন্য কী করছে? বাজারের লেনদেন যাতে লিঙ্গবৈষম্যে দূষিত না হয়, তা দেখার কথা কার? শিল্প, কৃষি, পরিষেবায় মেয়েদের বেতন-মজুরি-পিএফ যেন মার না যায়, সর্দার-সুপারভাইজ়রকে ‘খুশি করা’ যেন কাজের শর্ত না হয়, তা দেখবে কে? প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, সকলে যেন জোট বেঁধে বৈষম্য আর হিংসাকে ‘স্বাভাবিক’ করেতুলছে। অগণিত জীবনে এই অসহনীয় ক্ষতিকে অস্বীকার করে ক’টা টাকা মেয়েদের হাতে তুলে দিচ্ছে রাজনীতি। এ যেন নৈবেদ্য দেওয়ার বদলে ‘মূল্য’ ধরে দেওয়া। তাতে রাজনীতির ভারী সুবিধে— পুরুষতন্ত্রকে অটুট রেখে মেয়েদের খুশি করে দেওয়া যায়।

একটা চুটকি শোনা যায়— ধাবায় বাটার চিকেন খেয়ে বাবু বললেন, ‘মুরগিকে কী খাওয়ান?’ মালিক বুক ফুলিয়ে বললেন, ‘পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ।’ বাবুটি ইনকাম ট্যাক্সের লোক, হিসেব তলব করলেন। মালিকের ভালই গচ্চা গেল। পর দিন আর এক বাবু একই প্রশ্ন করতে মালিক বললেন, ‘কী আর দেব, পোকামাকড় ধরে খেতে দিই।’ এই বাবুটি হেলথ ইনস্পেকটর, জরিমানা করে দিলেন। পর দিন আর এক বাবু ফের বাটার চিকেন চাইতেই মালিক বললেন, ‘দেখুন স্যর, আমি মুরগিদের রোজ কুড়িটা করে টাকা ধরিয়ে দিই, কে কী খায় আমি জানি না।’

রাজনীতি এমন করেই দায় সারছে। ক’টা টাকা নিয়ে উন্নয়ন খুঁজে ফিরছে মেয়েরা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India Politics

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}