E-Paper

মুক্ত বাণিজ্যই সঙ্কটমুক্তির পথ

দুনিয়া জুড়েই দেশীয় শিল্প, জনসাধারণের স্বার্থ, অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য আমদানি শুল্ক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। ভারতেও তা হয়েছে।

বিশ্বজিৎ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৫ ০৬:১৭
Share
Save

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে তৎকালীন ব্রিটেন সরকার দেশের কৃষকদের চাপে পড়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যশস্যের উপরে শুল্ক ধার্য করে— যা পরিচিত ‘কর্ন ল’ নামে। তার ফলে ব্রিটেনে শস্যের দাম বাড়ে, লাভ হয় ব্রিটিশ কৃষকদের। কিন্তু বিপদে পড়েন শিল্পপতিরা, কমে যায় মুনাফা, সার্বিক বিনিয়োগ, উৎপাদন ইত্যাদি। কমে কর্মসংস্থানও। অতঃপর, মন্দা। শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় ‘কর্ন ল’। শুল্কের প্রভাব যে কখনও একমুখী নয়, এবং তা শুধুমাত্র কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এ কথাটির ধ্রুপদী প্রমাণ এই ‘কর্ন ল’র অভিজ্ঞতা।

কিন্তু, দুনিয়া জুড়েই দেশীয় শিল্প, জনসাধারণের স্বার্থ, অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য আমদানি শুল্ক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। ভারতেও তা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইনফ্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি আর্গুমেন্ট বা শিশু শিল্প সংরক্ষণ নীতি খুব জনপ্রিয় বাণিজ্য নীতি হিসেবে চর্চিত ছিল। নীতিটির উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় ছোট ছোট শিল্পগুলিকে শিশুর মতো রক্ষা করা, যাতে সেগুলি বৈদেশিক প্রতিযোগিতার সামনে মুখ থুবড়ে না পড়ে। লক্ষ্য ছিল, এই শিল্পগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠবে, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম হবে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে লড়াইয়ে হারিয়ে দেশের তো বটেই এমনকি বিদেশের বাজার দখল করবে।

তার পরে ১৯৬০-এর দশকে চালু হল আমদানি প্রতিস্থাপনকারী শিল্পায়ন। দেশের উদ্যোগপতিদের স্বাবলম্বী করতে হলে তাদের সামনে একটি বড় মাপের বাজার প্রয়োজন। এবং আমাদের দেশের বাজারের আয়তন গোটা বিশ্বের ব্যবসায়ীদের কাছে ঈর্ষণীয়। স্বভাবতই, তাঁরা আমাদের বাজারে তাঁদের দ্রব্য রফতানি করতে চাইবেন। সুতরাং প্রথমে বন্ধ করতে হবে আমদানি। শুল্ক এবং আমদানি কোটার চেয়ে বেশি কার্যকর কোনও পদ্ধতি নেই, যাতে দেশীয় বাজারকে বিদেশি রফতানিকারীদের নাগালের বাইরে রাখা যায়। কিন্তু, আমদানি বন্ধ করলে দেশের বাজারে সেই দ্রব্যের চাহিদা পূরণ হবে কী ভাবে? দেশীয় ব্যবসায়ীরা উৎপাদন করবেন সেই পণ্য, দেশের বাজারে বিক্রি করবেন। যত বিক্রি বাড়বে, তত বাড়বে উৎপাদন এবং ক্রমে ক্রমে দেশ আমদানি প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে নানা ধরনের শিল্পে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। বিদেশের উপরে নির্ভরশীলতা কমার পাশাপাশি দেশ তৈরি হবে বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতায় নামার জন্য।

তবে, বেশ কিছু বছর পরে দেখা গেল, আমাদের ছোট শিল্পগুলি বড় তো হয়নিই, বরং দিনে দিনে আরও অদক্ষ হয়েছে। উত্তরোত্তর বেড়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ। অতঃপর নব্বইয়ের দশকে এল উদার অর্থনীতি। এর অন্যতম নীতি হল দেশকে যথাসম্ভব মুক্ত বাণিজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া, এবং শুল্ক ও কোটার মতো বাণিজ্য-বিরোধী নীতি হ্রাস করা। কিন্তু তাই বলে কি ভারত তার পরে আর কোনও দিন আমদানি শুল্ক বসায়নি বা বাড়ায়নি? এখনও ভারতে গড়ে প্রায় ১৭% হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়। ১৯৯১-এর পরে অন্তত দু’বার আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এক বার ১৯৯৯-২০০০ সালে এবং পরে আবার ২০১৮-১৯ সালে।

বিশ্বায়ন, মুক্ত বাণিজ্য, শুল্ক, কোটা, আর্থিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদির কল্যাণমূলক প্রভাব নিয়ে জগদীশ ভগবতীর কাজ গোটা দুনিয়ায় অতি পরিচিত। বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি বা আর্থিক বিকাশ যে ক্ষেত্রবিশেষে দেশের সার্বিক বৃদ্ধির সহায়ক নাও হতে পারে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ভগবতীর আলোচনায় পাওয়া যায়। এই সম্ভাবনাকে পরিভাষায় বলা হয় ‘ইম্‌মিজ়ারাইজ়েশন’। ভগবতীর বিশ্লেষণের মূল ধারক ছিল বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি প্রয়োগকারী দেশের বাণিজ্য হারের গতিপ্রকৃতি। এই বাণিজ্য হারের বাড়া-কমার কারণ হল শুল্ক বা কোটার কারণে চাহিদা ও জোগানের হ্রাস-বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক দামের উপরে তার প্রভাব। এ ছাড়াও দ্রব্যের দাম পরিবর্তনের কারণে পাল্টায় উপাদানের দাম— মজুরি, সুদের হার ইত্যাদি। শ্রমের আন্তর্জাতিক সচলতা কম বলে আন্তর্দেশীয় মজুরি পরিবর্তনের সুবিধা শ্রমিকরা তেমন একটা পান না। কিন্তু, পুঁজির বেলায় তেমন হয় না। সুদ বাড়লেই আর্থিক মূলধন সেই দেশে চলে যায়। এর ফলে আর এক প্রস্থ অদলবদল ঘটে উৎপাদনের সমন্বয়ে। অর্থাৎ বাণিজ্যকে আমদানি শুল্ক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করলেই যে শুল্ক চাপানো দেশের উপকার হবে, তার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই। ফলে, রেসিপ্রোকাল ট্যারিফস বা পাল্টা শুল্ক বসিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনীতির খেলায় জয়ী হবেনই, সেই নিশ্চয়তা তাঁর নেই। তাই যদি হয়, তা হলে কেন এই শুল্ক-প্রতিশুল্ক খেলা? কারণ সহজ— বাণিজ্যসঙ্গী দেশকে ভয় দেখিয়ে কাজ আদায়ের চেষ্টা।

কোনও দেশের চরম শক্তিধর হওয়ার রাস্তা একটাই— অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখল। এটা দু’ভাবে সম্ভব— যুদ্ধ করে দেশ জয়, বা বাণিজ্য করে বড়লোক হওয়া। বুদ্ধিমানে বাণিজ্য করে, বোকারা করে যুদ্ধ। বড়লোক হতে চাওয়া বাণিজ্যের পোশাকি নাম মার্কেন্টিলিজ়ম, যা শুধু রফতানি বাড়ানোর কথা বলে। এটা অবাস্তব। তবু রফতানি না বাড়ালে কোনও মতেই অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। সেখানে ঘা পড়লেই যত সমস্যা। আমেরিকার উৎপন্ন দ্রব্যের উপরে অন্যান্য দেশের আমদানি শুল্ক থাকার কারণে তাই ট্রাম্পের এত ক্ষোভ। সেই কারণেই আমেরিকান প্রেসিডেন্টের চাপের কৌশল।

মুক্ত বাণিজ্য ও নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য, দুইয়ের কারণেই দেশের মধ্যে দুটো গোষ্ঠী তৈরি হয়। এক দল লাভ করে, অন্য দলের ক্ষতি হয়। এদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে রাষ্ট্র। শুল্কের বেলাতেও তাই। আমদানি শুল্ক বাড়ালে দেশের বাজারে সেই দ্রব্যের দাম বাড়ে। সে ক্ষেত্রে দেশীয় বা বিদেশি উৎপাদকের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। জিনিসের দাম বাড়লে দেশের গরিব মানুষের সমস্যা। অন্য দিকে, বর্ধিত দামে দ্রব্যটি যাঁরা কেনেন, তাঁরা অবশ্যই তুলনায় সচ্ছল। এবং আমদানি শুল্কের সমপরিমাণ অর্থ দিতে হয় তাঁদেরই। অর্থাৎ তাঁরাও লাভ করতে পারেন না। তা হলে লাভ করে কারা? এক, রাষ্ট্র— যারা শুল্ক রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু, বর্ধিত শুল্কবাবদ অর্জিত অতিরিক্ত অর্থ কী ভাবে ব্যবহৃত হবে, তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের পরিচালকদের উপরে। দুই, দেশীয় শিল্পপতিরা— যাঁরা ওই আমদানিযোগ্য দ্রব্যের বিকল্প উৎপাদন করেন। কারণ, শুল্কের আড়ালে দেশীয় বাজারে দ্রব্যের দাম তুলনায় বাড়ে। তাই সন্দেহ হয়, ঠিক কী কারণে পাল্টা শুল্কের মতো জটিল নীতি এতটা সহজে গ্রহণ করলেন ট্রাম্প।

অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন বলেছিলেন, বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি হল চর্ম রোগের মতো— সহজে সারে না। এক জায়গায় সারলেও আবার অন্য জায়গায় দেখা দেয়। তাই, পুরোপুরি মুক্ত বাণিজ্য বিপুল সময়সাপেক্ষ একটি কর্মসূচি। কিন্তু মুক্ত বাণিজ্যের মন্ত্রেই সঙ্কট-মুক্তি।

অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

trade Tariffs industries Economy

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।