Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
GDP growth

প্রত্যাশা ছাপানো বৃদ্ধির মধ্যেও রয়েছে উদ্বেগের ছায়া! নিষ্ফল মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’

জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের (এনএসও) পূর্বাভাস ছিল, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশে বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের কম হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা ৭.২ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।

Symbolic Image.

২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ। —প্রতীকী চিত্র।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩ ১৩:১১
Share: Save:

সমস্ত পূর্বাভাস (তার মধ্যে এই প্রতিবেদকের পূর্বাভাসও রয়েছে) ছাপিয়ে শেষ ত্রৈমাসিক-সহ গোটা ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতে বৃদ্ধির হার আনন্দের, এবং একই সঙ্গে বিস্ময়করও।

গত ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (আরবিআই) আর্থিক নীতি কমিটি (মনিটারি পলিসি কমিটি বা এমপিসি)-র বৈঠকে জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার ৪.২ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, সেই পূর্বাভাসের থেকে বেশ কিছুটা উপরে গিয়ে ওই ত্রৈমাসিকে জিডিপি (মোট জাতীয় উৎপাদন) বৃদ্ধির হার পৌঁছেছে ৬.১ শতাংশে।

সামগ্রিক ভাবেও ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার কেন্দ্রীয় আর্থিক নীতি নির্ধারণ কমিটি (এমপিসি)-র পূর্বাভাসকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এমপিসির তরফে জানানো হয়েছিল বৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা পৌঁছে গিয়েছে ৭.২ শতাংশে। এর ফলে মূল্যবৃদ্ধিতেও লাগাম পরানো গিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির হার কমে ৫ শতাংশের নীচে নেমেছে।

আগামী অর্থবর্ষের (২০২৩-২৪) আগে যে মূল্যবৃদ্ধির হার এ ভাবে কমতে পারে, সেই ভবিষ্যবাণীও করতে পারেনি এমপিসি। শুধু তাই নয়, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে প্রত্যাশা ছাপানো জিডিপি বৃদ্ধির কারণে কমেছে রাজকোষ ঘাটতিও। এর ফলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সুস্থিত হয়েছে। অর্থনীতিতে এসেছে মিঠে স্পর্শ।

পরিসংখ্যান দেখে বোঝা যাচ্ছে, অনেকগুলি কারণে এই সুবাতাস এসেছে অর্থনীতিতে। অটোমোবাইল (যাত্রী ও বাণিজ্যিক যানবাহন), বিমান ও রেল যোগাযোগ, ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো নির্মাণ-সম্পর্কিত উৎপাদনক্ষেত্রে বৃদ্ধি; ব্যাঙ্ক ঋণের পুনরুদ্ধারের হার বৃদ্ধি-সহ আরও অনেকগুলি বিষয় এই তালিকায় রয়েছে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে বৃদ্ধির হার কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়ে। তবুও ব্যাখ্যা দিতে গেলে জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকের বৃদ্ধির হারকে অপ্রত্যাশিতই বলতে হবে।

সামগ্রিক ভাবে চতুর্থ ত্রৈমাসিক (২০২৩ সালের জানুয়ারি-মার্চ)-সহ গোটা ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার ভাল মনে হলেও, কয়েকটি ক্ষেত্রে তা আশানুরূপ হয়নি। গত অর্থবর্ষের চতুর্থ ত্রৈমাসিকের তুলনায় বৈদেশিক বাণিজ্যে রফতানি বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আমদানির হার কমেছে ৪.১ শতাংশ। অর্থাৎ ক্রেতাদের চাহিদা বাড়ছে না মোটেই। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণেই ক্রেতা-চাহিদায় এই মন্দগতি।

৪ শতাংশ রফতানি বৃদ্ধি এবং ৪.১ শতাংশ আমদানি হ্রাসের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির অঙ্ক এক লাফে ২,৬৩০ কোটি ডলার (প্রায় ২ লক্ষ ১৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) থেকে ১,০১০ কোটি ডলারে (প্রায় ৮৩ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা) নেমে এসেছে। অর্থাৎ প্রায় ৬১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মোটামুটি ১,৬২০ কোটি ডলারের (প্রায় ১ লক্ষ সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা) এই বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের অঙ্ক জিডিপি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। বস্তুত, বৈদেশিক বাণিজ্যে এই ঘাটতি হ্রাসের প্রভাবে জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রায় দেড় শতাংশ বেড়ে ৬.১ শতাংশে পৌঁছেছে। যদিও আশ্চর্যজনক ভাবে তার মূল কারণ, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা হ্রাস!

অপ্রত্যাশিত জিডিপি বৃদ্ধির গভীরে আরও একটি আকর্ষণীয় অঙ্ক। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের হিসেবে উৎপাদনের গতিও কমেছে! অশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস, নির্মাণ ও পরিকাঠামো শিল্প এবং বিদ্যুৎক্ষেত্র রয়েছে এই তালিকায়। এবং তারও নেপথ্যে রয়েছে ক্রেতা চাহিদার শ্লথ গতি। তবে কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার বেড়েছে অনেকটাই। গত অর্থবর্ষের (২০২১-২২) তুলনায় প্রায় ১.৩ শতাংশ। সামগ্রিক ভাবে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ। জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকেই তা বেড়েছে ৫.৫ শতাংশ।

বিগত ৪টি অর্থবর্ষের সামগ্রিক হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হাত ১৯ শতাংশ। অথচ ওই সময়সীমায় উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার মাত্র ১৩ শতাংশ! কোনও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ আশ্চর্যের। যেখানে উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার কৃষির চেয়েও ধীর গতিতে হচ্ছে!

এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে বলা যেতে পারে, অতিমারি পরিস্থিতির অভিঘাত কৃষির তুলনায় উৎপাদন ক্ষেত্রে অনেক বেশি পড়েছে। কিন্তু গত ৪টি অর্থবর্ষের মধ্যে ৩টিতেই কেন উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার যৎসামান্য বা শূন্য? বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি অনেকটা হলেও কেন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে ধীরগতিতে? মোটরবাইকের তুলনায় কেন বেড়ে গিয়েছে গাড়ির বিক্রি? কেন কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও গ্রামীণ ক্রেতা চাহিদা সে ভাবে বাড়ছে না? তবে কি গরিবদের উপর কোভিডের প্রভাবের সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কিত?

প্রত্যাশা ছাপানো জিডিপি বৃদ্ধিতে খুশির আবহে কিন্তু উদ্বেগের ছায়াও রয়েছে। গত অর্থবর্ষে কৃষি এবং উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় সমান হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হলেও তা মেলেনি। চতুর্থ ত্রৈমাসিকে কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার উৎপাদন ক্ষেত্রের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। অথচ কয়েক বছর আগে নরেন্দ্র মোদী সরকার জাতীয় অর্থনীতিতে উৎপাদন ক্ষেত্রের অবদান বাড়াতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়েছিল। কিন্তু তাতে যে বিপরীত ফল হয়েছে, সামনে আসা আর্থিক পরিসংখ্যানগুলিতে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। ফল মেলেনি শুল্ক সুরক্ষা বা পরিকাঠামো নির্মাণের মতো পদক্ষেপেও।

পরিস্থিতি দেখে অনেকে বলতে পারেন, কৃষিক্ষেত্রের মতো সরাসরি ভর্তুকি ছাড়া উৎপাদন ক্ষেত্রের উত্থান সম্ভব নয়। কিন্তু সেই পদক্ষেপ কি প্রতিযোগিতার বাজারে উৎপাদন ক্ষেত্রকে টিকিয়ে রাখতে পারবে? না কি অন্য কোনও ভাবে সমাধানের দিশানির্দেশ খুঁজতে হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

GDP growth GDP PM Narendra Modi Make in India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE