মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থানার তরতিপুর পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রাম। তরতিপুরের নাজিমুদ্দিন মণ্ডল দেড় বছর ধরে মুম্বইয়ের পালগড় নালা সোপারায় থাকে। ১৩ জুন রাতে তাঁর মতো আট জনকে থানায় তুলে নিয়ে যায় মহারাষ্ট্র পুলিশ। প্রায় দেড়শো শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন সেখানে, মুম্বইয়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে। তাঁদের প্যান কার্ড, আধার, ভোটার কার্ড সব নিয়ে নেওয়া হয়। আঙুলের ছাপও নেওয়া হয়। কেড়ে নেওয়া হয় মোবাইল ফোন। পরের দিন তাঁদের একে একে ডাকা হয় পুলিশের ঘরে। নাজিমুদ্দিন জানিয়েছেন, “আগের দিন খুব মারধর করেছিল... বারে বারে বলেছিলাম, বিশ্বাস করেন আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদ, আমি ভারতীয়। মার থামায়নি।... দু’জন পুলিশ অফিসার ছিল, আমাকে বলল, জাতীয় গান গেয়ে শোনা। প্রথমে বুঝতে পারিনি... গালি দিয়ে বলে, ‘রাষ্ট্র গানা শুনা’। আমি কাঁদছিলাম আর গাইছিলাম... ভেবেছিলাম এই গান আমাকে রক্ষা করবে। কিন্তু আমাকে তো ‘বিদেশি’ তকমা দেওয়া থেকে রক্ষা করতে পারল না।”
পুণে এয়ারপোর্টে তাঁদের বলা হয় কলকাতায় পাঠানো হবে। প্লেনে হাত বাঁধা হয়েছিল। বাগডোগরা এয়ারপোর্টে হাত খোলা হয়। সামান্য কিছু খাবার দেওয়া হয়। এয়ারপোর্টে লাইন দিয়ে দাঁড় করানো হয়, তার পর তোলা হয় গাড়িতে। বিএসএফ ক্যাম্প থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তে। ক্যাম্পে আবার মারধর করে বিএসএফ। নাজিমুদ্দিনের রোজগারের জমানো প্রায় পনেরো হাজার টাকা কেড়ে নেয় ওরা। পরের দিন বিএসএফ-এর ছোট গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় বর্ডারে। তখন রাত তিনটে। চার দিকে ঘন কালো অন্ধকার। নাজিমুদ্দিনের কথায়, “গেটের কাছে নিয়ে গিয়ে আমাদের বলল, ইন্ডিয়ায় আর আসবি না, এলে গুলি করে মেরে দেব।... ওপারে জঙ্গলের দিকে ঠেলে দেওয়া হল আমাদের।... ও-দিকে ইন্ডিয়ারও জমি ছিল, চা বাগান ছিল, আমরা ওখানেই বসে থাকলাম রাতভর।... পরে জেনেছিলাম সেই বাংলাদেশি গ্রামটির নাম পাটগ্রাম। ভয়ে আমরা গ্রামটিতে ঢুকতেও পারিনি, ওই দিকে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী, ফেরার পথ নেই। এই দিকে বিএসএফ। দু’দিন দু’রাত আমরা খোলা আকাশের নীচেই ছিলাম। ১৬ তারিখ বিকেলে বিএসএফ আসে, আমাদের নিয়ে যেতে। নিয়ে গেল মেখলিগঞ্জ থানায়। ১৭ জুন বাড়ি ফিরলাম আমি।”
২০১৫-য় ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর হয়, সাধারণ মানুষ স্বস্তি পান— ছিটমহলগুলি ভৌগোলিক ভাবে যে দেশের মধ্যে আছে সেই দেশের রাজস্ব গ্রামে পরিণত হল। বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের প্রথমে দিনহাটা কৃষি বাজারের অস্থায়ী শিবিরে রাখা হয়। পরে তাঁদের পরিবার পিছু একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। ৩১ জুলাই, ২০১৫ ছিটমহলের চুক্তি কার্যকরের দিন, বহু আন্দোলনের শেষে জয়লাভ হল। দিনটি তার পর থেকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসাবে পালিত হয় সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলগুলিতে, আর আবাসনে যথাক্রমে ‘ভারতীয়’ হওয়ার আর ‘ভারতভূমি’-তে আসার আনন্দে। কেমন আছেন ওঁরা, এই দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে?
খবর পেলাম আবাসনের সাত জনকে আটক করেছিল হরিয়ানা পুলিশ বাংলাদেশি সন্দেহে। দিনহাটার এনক্লেভ সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে কথা হল হরিয়ানার বাহাদুরগঢ়ের ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিক ও ঠিকাদারের সঙ্গে। রবিউল হক, তাঁর স্ত্রী রসিদা বেগম আর তাঁদের নাবালক দুই ছেলেমেয়েকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়েছিল। “প্রায় ন’বছর আমি লেবার নিয়ে যাওয়ার কাজ করছি। সে দিন বিকেল চারটের সময় দিল্লি পুলিশের লোকজন বলল কাগজপত্র নিয়ে দিল্লির শালিমারবাগ থানায় দেখা করতে। আমরা কী কারণে যেতে হবে জানতে চাইলে জানাল ‘তোরা বাংলাদেশি কি না তা দেখা হবে’। তিন হাজার টাকা ভাড়ার গাড়ি নিয়ে পরের দিন থানায় গেলাম। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড দেখালাম, দেখল, মোবাইল ফোন জমা নিল।” রবিউল জানাল, “কিন্তু রেসিডেনশিয়াল সার্টিফিকেট দেখাতেই অবাক হল। আমরা আমাদের ছিটমহলি জীবনের কথা বলতে শুরু করলাম, বেশ অবাক হল। আমরা বললাম, আমরা ভারতীয় ছিলাম মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে, বাংলাদেশের ভিতরে। এখন এখানে এসেছি, চুক্তি কার্যকরের ফলে। কী বুঝল কে জানে!”
পরিযায়ী শ্রমিকদের এই বিপন্নতা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির অপদার্থতার ফল। আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইনে পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষা, রোজগার ও স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তার জন্যে যে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার কোনওটাই সঠিক ভাবে পালিত হয়নি। অথচ, বাইরে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিক শুধু সেই রাজ্যের উন্নয়নে শ্রম দেয় তা নয়, নিজ রাজ্যেও তাঁর রোজগার বাজারকে শক্তি দেয়। প্রশাসন নথিভুক্তির প্রতি দৃষ্টি দেয়নি, তাই দরিদ্র, প্রায় অর্ধশিক্ষিত শ্রমিকরা বারে বারেই অন্য রাজ্যে ‘অপরাধী’ গণ্য হয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যটির বিকাশে তার অবদান নগণ্য করে তাকে গণ্য করা হচ্ছে ‘বহিরাগত উপদ্রব’ বলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অধুনা রাষ্ট্র দর্শন, যেখানে মুসলিম মানেই ‘শত্রু’, হিন্দুরাষ্ট্রের শত্রু— এই বোধটি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)